সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯

মিসিং গার্লস ~ স্বাতী রায়

        এক

শেষরাতের আধোঘুমের সর চোখের উপর লেগে থাকার সময়ে নানান স্তরের স্বপ্ন আসে। সে স্বপ্ন অনেকটা মেঘের উপর ভাসতে থাকা, আলতো দোলায় নেমে আসার মত। স্বপ্নভেলায় ভেসে ভেসে শিশিরে ভেজা নরম ঘাসের উপরে নেমে আসার ঠিক আগেই আজ  টানা কলিং বেলের ডিং ডং আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো ডঃ সাম্যদর্শী বর্ধনের। কেউ মরিয়া হয়ে বেল টিপেই চলেছে। ধরমর করে ঘুম ভেঙে উঠে কোনো মতে রাতপোশাকের উপরে হাউজকোট টা চাপিয়ে নিয়েই দরজা খুলতে ছুটলেন। দরজা খুলতেই দড়াম করে পায়ের উপর উপুর হয়ে পড়লো ফুলিয়ার বাবা মা। পাশের বস্তির ফুলিয়ার মা এ বাড়ির ঠিকে কাজ করে আর বাবা টোটো চালায়। ষোড়শী ফুলিয়া এবার মাধ্যমিক পাশ করেছিলো। চটকদার সাজুনি ফুলিয়াকে কাল বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এই নিয়ে এ বছর পঞ্চম মেয়েটি কারো সাথে পালিয়েছে। হ্যাঁ এরকমই হয় এই বস্তিতে। বছরে আট দশটি মেয়ে পালিয়ে বিয়ে থা করে নেয়, বছর ঘুরতে ক্ষয়াটে চেহারা, কোলে বাচ্চা নিয়ে ফিরে এসে ফ্যামিলি ট্রেন্ড অনুযায়ী কারো বাড়িতে কাজে লেগে পড়ে। কেউ কেউ ফেরেনা আর। পুলিশ কিছুদিন খোঁজখবর করে অন্যান্য গুরুতর কাজের চাপে এদিকে সময় দিতে পারেনা, দিন আনা দিন খাওয়া লোকজন গুলিরও অত সময় থাকে না যে রোজ গিয়ে  থানায় ধর্না দেবে। ফলতঃ পুলিশ ও বস্তিবাসী দুই পক্ষর কাছেই এরা মিসিং গার্ল হয়ে থেকে যায়। 

দুই

আজ বছর পনেরো ধরে এই বস্তিতে একটি ফ্রি স্কুল চালান ডঃ বর্ধন। অনেক অনিচ্ছুক, হত-দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের পড়াশোনা করায় উদ্বুদ্ধ করে মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনে সরকারী স্কুলে পাঠিয়েছেন তিনি। পড়াশুনায় অপেক্ষাকৃত ভালো ও ইচ্ছুক দের আর্থিক সাহায্যও করে থাকেন। নিজের নার্সিংহোমে সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করার পর বাকি দুটি দিন তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করেন এই বস্তিবাসীদের উন্নয়নে, মানে তাঁর একার পক্ষে যতটা সম্ভব। তাঁকে দেখে আরও কিছু কলেজস্টুডেন্ট এগিয়ে এসেছে এই মহান কাজে তাঁর অংশীদার হয়ে। বস্তিবাসী ও প্রতিবেশীদের কাছে এই ডাক্তার ঈশ্বরের আরেক রূপ। বাবা মেয়ের সংসারে কাজ খুব বেশী কিছু নেই। বছর বারোর মেয়ে জোনাকি কে নিয়ে এই গোটা দোতলা বাড়িতে থাকেন তিনি। জোনাকি কথা বলতে পারেনা, কিন্তু অসম্ভব ট্যালেন্টেড বাচ্চা। দুর্দান্ত ছবি আঁকে ও গিটার বাজায়। মা নেই বলে জোনাকির মনের সব খবর ডঃ বর্ধনকেই রাখতে হয়। 

তিন

"হামি কুছু জানিনা ডাগতার বাবু, হামার বিটিয়াকে আপনি ঢুণ্ডিয়ে দিন।" সেই সকাল থেকে বসে এই একই কথা সুর করে বলে কেঁদেই চলেছে ফুলিয়ার মা। এতদিন ধরে এত কিছু বলে বুঝিয়েও লাভ হয়নি এই উঠতি বয়েসের মেয়ে গুলোর। কী বলবেন ভেবে না পেয়ে খানিক থমকে ডঃ বর্ধন জিজ্ঞাসা করলেন "আচ্ছা পুলিশে রিপোর্ট করেছো তো?"
"পুলিশ তো বল্লো দেখ কার সাথে পালিয়েছে, একবছর বাদেই পেট করে ফিরে আসবে"। "আমার ফুলিয়া পালায়নি বাবু, কেউ উকে ধরে লিয়ে গ্যাছে।"
একটু নড়ে বসে জিজ্ঞাসা করলেন "কি করে জানলে?"
"ফুলিয়া বলছিলো একটা হিরো কাটিং ছেলে উকে দেখে, পিছে পিছে স্কুল তক যায় গো বাবু" 
"আর কী বলেছিলো ফুলি?" 
"বলেছিলো উ পড়বে, অনেক বড় হবে, আপনার মত ডাগতার হবে বাবু। ফুলিয়া রেএএএএ" 

চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন ডঃ বর্ধন। এ বস্তির বাচ্চা থেকে বুড়ো অবধি সব্বাইকে তিনি চেনেন। হিরোপানা ছেলেটা কে? 

"ঠিক আছে, তোমরা বাড়ি যাও, আমি দেখছি কী করা যায়।" বলে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বললেন। লা মার্টস এ জোনাকি কে নামিয়ে দিয়ে নার্সিং হোম চলে যাবেন তিনি।

সিটে বসে মেয়ের রেশম রেশম চুলে ভরা মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বললেন সিট বেল্ট টা লাগিয়ে নাও জনাই। বাধ্য মেয়ের মত সিট বেল্ট বেঁধে ভাসা ভাসা চোখের জনাই সামনের রাস্তায় মন দিলো। হ্যাঁ, সব শুনতে পায় সে, হয়তো একটু বেশীই শুনতে পায়। নিস্তব্ধ দুপুরের পাতা ঝরে পড়া বা হিমেল রাতের শিশিরের শব্দও জোনাকির কানে ধরা পড়ে। 

চার

খুব উচ্ছাসের সাথে গাড়িতে বসে বাবাকে তার ইনভিটিশন লেটার টা দেখালো জোনাকি। ব্যাঙ্গালোরে একটি মিউজিক কনফারেন্সে ডাক পেয়েছে সে। তার করা কম্পোজিশন সিলেক্টেড হয়েছে বলে টিচার ও তার বন্ধুরা সব্বাই দারুণ খুশী। হাত পা নেড়ে চোখের ইশারায় বাবাকে এটাই বলছিলো জোনাকি। হঠাৎ বাবার পিছনে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলো একটি খুব সুন্দর দেখতে ছেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুব ঠাণ্ডা, নির্মম একটা দৃষ্টি। 

বাড়ি ঢোকার সময় আবার ফুলিয়ার বাবা ও মা - বারান্দায় হেলান দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে বসে ছিলো। ডাগতার সাবের গাড়ি ঢুকতে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। হাতে একটা প্রায় দোমড়ান ছবি। একমাথা মেটে সিঁদুর পরা ফুলিয়া, পাশে সেই খুব সুন্দর দেখতে ছেলেটি। আবেশে ফুলিয়ার চোখ বুজে আছে, গলায় কানে ঝুঠো সোনার গয়না। ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডঃ বর্ধন বললেন "বলেছিলাম"! 

পাঁচ

শহরের বাতাসে শীতের ছোঁয়া লাগছে। ফুলিয়ার গল্প চাপা পড়ে গিয়ে সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। ডঃ বর্ধনের স্কুলে নতুন কিছু স্টুডেন্ট এসেছে। তার মধ্যে চারটি মেয়ে। বয়স ১২-১৪র মধ্যে। শোয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় জানলা বন্ধ করতে গিয়ে জোনাকি দেখলো দরজা খুলে কে একজন চোরা পায়ে এগিয়ে আসছে। চুপি চুপি দরজা খুলে একতলায় নেমে এলো সে। বাবার ঘর থেকে হালকা কথার চাপান উতোর শোনা যাচ্ছে। মিনিট খানেক সেখানে কাটিয়ে থমথমে মুখে নিজের ঘরে ফিরে গেলো জোনাকি। 

ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ডঃ বর্ধন, সঙ্গে একটি খুব সুন্দর দেখতে ছেলে। হাতে তার পেট মোটা একটি খাম। "কয়েকদিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাও, নতুন পাখি পেলে ডেকে নেবো। এখন দিন কয়েক ফুলিয়াকে যে সিডেটিভ টা দিয়েছিলাম সেটাই অঞ্জুকেও খাইয়ে রাখবে। খুব দরকার না পড়লে আমায় ফোন করবেনা।" বলতে বলতে তাকে গেট খুলে বের করে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ডঃ বর্ধন দেখলেন তার ঘরের সাদা দেওয়ালে চারকোল দিয়ে পাকা হাতে সদ্য আঁকা নিটোল একটি নারীমূর্তি, নীচে লেখা ১০৯৮। 

জনাইয়ের ঘর থেকে মৃদু ভেসে আসছে - "জানি সে কোথায়, এই শহরের কোন বাগানে সে হয়ে আছে ফুল।
প্রতি সন্ধ্যায়, পাপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।"... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন