শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯

হল্লা বোল ~ অরিজিৎ গুহ

কমরেড সফদার হাশমি
দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রটি পড়াশোনার ফাঁকেই কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছিল এসএফআই আর আইপিটিএ র সাথে। পড়াশোনার পাশাপাশি চুটিয়ে চলত নাটকে অভিনয়। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর যখন সিপিআই(এম) এর সদস্য পদ পেল তখন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে কবিতা লেখা, নাটক লেখা, বাচ্চাদের জন্য গল্প লেখা। ৭০ সালের একটা পথ নাটক কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লি আর আশেপাশের অঞ্চল। একজন রাজা, তিনি যেখানেই যান, সাথে তাঁর সিংহাসনটা নিয়ে ঘোরেন। যদি কখনো সেটা বেহাত হয়ে যায় সেই ভয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর কুর্সির প্রতি আশক্তিকে ব্যঙ্গ করে 'কুর্সি, কুর্সি, কুর্সি' নাটকটা নিউ দিল্লির বোট ক্লাবের লনে প্রতি সপ্তাহে অভিনীত হত। সেখান থেকেই উঠে আসে 'জন নাট্য মঞ্চ' বা সংক্ষেপে 'জনম' গ্রুপ তৈরি করার চিন্তা ভাবনা। ৭৫ সাল অব্দি জনম একের পর এক পথ নাটক করে গেছে যেসব নাটকের মূল সুর ছিল শ্রমজীবী মানুষ৷ সাধারণতই পছন্দ হয় নি শাসকদের। ৭৫ এ এমার্জেন্সি ঘোষণা করার পর দেশে সমস্ত রকম রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দিতে হয়। সাথে সাথে রাজনীতির গন্ধ যেখানে রয়েছে সেসবও বন্ধ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই জনমের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়৷ সেই সময়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে গাঢ়োয়াল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয় সফদার হাশমি। এমার্জেন্সি উঠে যাওয়ার পর আবার ফিরে আসে মানুষের মাঝে রাস্তায়। শুরু হয় 'আওরত', 'মেশিন' ইত্যাদির মত যুগান্তকারী পথ নাটক।
   ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের ঝাণ্ডাপুরে লোক ভেঙে পড়েছে সিআইটিইউ আর কিষান সভার উদ্যোগে শ্রমিক আর কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে তৈরি পথনাটক 'হাল্লা বোল' দেখার জন্য৷ ইতিমধ্যে নাটকটার কথা ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশের দারিদ্র্য সমন্বিত বিভিন্ন অঞ্চলে। খেটে খাওয়া মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের লড়াইকে উঠে আসতে দেখছে নাটকের দৃশ্যে। কিন্তু মানুষকে এভাবে প্রভাবিত করলে যে কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগবেই! সেই কায়েমী স্বার্থের আঘাত তারা ফিরিয়ে দিল সফদারকে পিটিয়ে মেরে। কংগ্রেসি গুণ্ডাবাহিনী নাটকের ওপর হামলা চালাল। গাজিয়াবাদ মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রামানন্দ ঝা এর সমর্থনে চলছিল সেই নাটকের শো৷ কংগ্রেসি প্রার্থী মুকেশ কুমারের গুণ্ডার দল নৃশংসভাবে পেটাল নাটকের দলকে। ঘটনাস্থলে সাথে সাথেই মারা গেল নেপালী অভিনেতা রাম বাহাদুর। সফদারকে ভর্তি করা হল রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। সেই রাতে হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছিল সফদারের বন্ধু সহমর্মীরা। হাসপাতাল লাগোয়া পার্ক আর বাস স্ট্যান্ড সেদিন ভরে গেছিল মানুষে। শুধু মানুষ আর মানুষ। সফদার হাশমির টানে ছুটে এসেছে সবাই। ছুটে এসেছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, কিন্তু লোকের প্রবল বিক্ষোভে তিনি আর ঢুকতে পারেন নি ভেতরে।  মৃত্যুর সাথে লড়াই করে পরদিন মারা যায় সফদার। থেমে গেছিল কালের কন্ঠ। কিন্তু থামানো যায় নি হাল্লা বোলকে। দুদিন পর সেই একই জায়গায় সফদারের বন্ধু কমরেড ও স্ত্রী মলয়শ্রী হাশমি কমরেডের মৃত্যু শোক নিয়েই মঞ্চস্থ করে হাল্লা বোল। 
   সফদার বা সফদারদের আসলে মৃত্যু হয় না। ১২ ই এপ্রিল জন্মদিনটা আসলে ছুঁতো, সফদারদের মনে রাখার জন্য জন্মদিন সব নয়। আনন্দ পটবর্ধন কবিতা লিখেছিলেন সফদারের স্মৃতিতে

'বাবরি মসজিদ ভাঙতে তুমি দেখো নি
তুমি দেখো নি তার পরের হিংসা আর ঘৃণাকে
তুমি রামাবাঈ আর অন্যান্য দলিতের মৃত্যু দেখো নি
পরমাণু বোমার জন্য দেশের আকুলতা তুমি দেখো নি
২০০২ এ গুজরাটের সাম্প্রদায়ীক হিংসা তুমি দেখো নি
প্রতিবেশি পাকিস্তানে তালিবানের উৎপত্তি তুমি দেখো নি
আর এখানে তুমি হত্যাকারীর রাজ্যাভিষেক দেখো নি
আমরা যারা এখনো বেঁচে রয়েছি তারা এগুলো সব দেখেছি
কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।'

"So you missed the demolition of the Babri Masjid
And the violence and hate that followed
You missed Ramabai and other Dalit massacres
You missed your nation's love for the atom bomb
In 2002, you missed the Gujarat pogrom
And in neighbouring Pakistan you missed
The creation of the Taliban and here
This year you missed the coronation of killers

We who survived you missed none of these
We missed you."

কমরেড সফদার হাশমি অমর রহে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন