রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৩

শান্তিগোপাল, লেনিন ও আমরা ~ শুদ্ধ্বসত্ত্ব ঘোষ

কালীপূজো এসে গেল। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হত। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।

ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। 
শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।   

সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, সোনা কাকু, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। অজিতেশ-কে দেখছি আসলে। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? 

কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে। 

সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। 

মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। 

শান্তিগোপাল, রস্ট্রাম ব্যবহার শুরু করলেন। মাইক্রোফোন এল। চিৎকার করেই যাতে শুধু শোনাতে না হয়। নেপথ্যে টেপরেকর্ডার থেকে শব্দ-প্রক্ষেপণ। এ সব এলো হিটলার-এ। শান্তিগোপাল বলতেন পার্টি ইত্যাদি নয় মানুষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাকী সব নিয়ে সচেতন করছেন।

আসলে আমরা ভুলেই গিয়েছি নবান্ন, নবনাট্য বাংলার মাঠেঘাটে যত না ঘুরেছে তার চেয়ে বেশী ঘুরেছে যাত্রাপালা। ভক্তিরসের বন্যায় গিরিশেরা পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ চুবোচ্ছেন, কারণ যাত্রাতেও ঐ চলছে। একা মুকুন্দদাস বাদ দিলে কেউ আর নীলদর্পণ-এর লড়াইতে ছিল না। যাত্রার দর্শক, গ্রাম-মফস্বলের মানুষই এসেছে সেকালের থিয়েটারে দর্শক হয়ে। একালের দর্শকভেদ আগেই বোধহয় হতে থেকেছে। শহুরে বাবুরা যাকে নাট্য বলবেন, বাকীদের তাকেই নাট্য বলতে হবে। তারপরেও জনগণের কাছাকাছি কিন্তু একমাত্র যাত্রা। জন-রাজনীতিরও কাছাকাছি।

শান্তিগোপাল বুঝেছিলেন। শুধু উৎপল দত্তের কথা আমরা বলি রাজনীতি প্রসঙ্গে। তাঁর কথা বলি না। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো কমিউনিস্ট দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! 
শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল  আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। 
আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। 
শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। 

ঋত্বিক যখন 'আমার লেনিন' করছেন তখন 'লেনিন লেনিন লেনিন লেনিন/ নূতন আশা নূতন দিন' গানের যুদ্ধতৎপরতায় চরিত্র আর ক্যামেরা এগিয়ে যায় যাত্রার মঞ্চের দিকে। 'লেনিন, কথা বলছেন, বোঝাচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই গ্রাম্য রাজ্যের মাঝে'। নেপথ্যে ভয়েস ওভার বলছে। বলছে লেনিন বাংলার মঞ্চে গাইছেন ইন্টারন্যাশনাল। এই-ই সম্ভবত সেকালের রাজনৈতিক যাত্রার একমাত্র ফুটেজ। যিনি জানেন কোথায় তাকাতে হয় কোন রাজনীতি নিয়ে - তিনিই দেখেন, বাকীরা দেখি দেখি ভাণ করে মাত্র।

ঋত্বিক দেখেছেন। দেখিয়েছেন। আমরা ফাত্রা লোকেরা দেখেছি। রাজনীতি ঠান্ডা ঘরে বসে, গাড়ি চড়ে ঘুরে, ভোট মাপবার বস্তু নয় জেনেছি। বাবুরা পুলিশ-গুণ্ডা দিয়ে বুথস্তরের সংগঠন গড়ে ক্যাডার বেস্‌ড পার্টি হবার খোয়াব দেখেছে। দেখে এখনও। নির্বাচনে হারা জেতা নয়, আদপেই বাংলার মাঠে মাঠে পুলিশ-গুণ্ডা বাদ দিয়ে কত মানুষ হাতের লাঠি কিম্বা কাস্তে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সেখানেই জোর, ভুলে গেছে তারা। 

এখনো, গ্রামে-মফস্বলে, শহরে বিদ্বেষের পারদ উর্ধগামী। ক'টা সিটে জেতার আনন্দে সেদিকে কারো নজর নেই। এখন নেই শান্তিগোপাল। রাতের পর রাত জেগে, নিঃস্ব হয়ে গিয়েও মাঠে মাঠে আদর্শের বীজ বোনার চেষ্টা নেই। খিল্লি আছে শহুরে আমোদগেঁড়ে মধ্যবিত্তের 'কে তুই শান্তিগোপাল' বলে। আর আছে রাজনৈতিক ভয়াবহ শূন্যতা যেখানে যা খুশীকেই রাজনীতি বলে চালিয়ে হাততালি নেবার পালা। ঘৃণ্যকে ঘৃণা না করতে পারার অক্ষমতাই চিনিয়ে দেয় কে কোন শ্রেণীর পক্ষে, কে কোন রাজনীতির পক্ষে। স্তাবকতা আর সাপলুডোর দিনকালে শান্তিগোপালকে তাই মনে পড়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন