রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯

ফ্যাসিবাদ এবং প্রফেসর শঙ্কু! ~ সংগ্রাম চ্যাটার্জী

এই শীতের মরসুমে যখন গোটা দেশ ক্রমাগত জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদের কালো ছায়ার মোকাবিলায় উত্তপ্ত হচ্ছে ক্রমাগত, ঠিক সেই সময়েই রিলিজ করল প্রফেসর শঙ্কু'র এল ডোরাডো! ফলে এই সময়েই এই লেখাটা পোস্ট করতে ইচ্ছে হল। মূল লেখাটা অনেক বড়, প্রকাশিত হয়েছিল এই বছরের শারদীয়া পর্বে। সেটাকেই কেটে ছেঁটে এইটে হল। এটাও কম বড় না! তাও পারলে পড়েই দেখেন...

১)
স্বর্ণপর্ণী ১

"মাই ডিয়ার শঙ্কু— তোমার মহৌষধ বিশ্বের হীনতম প্রাণীর উপকারে আসবে এটা আমি চাইনি, চাইনি, চাইনি।"
চেনা অংশ? না চিনতে পারলে বলেই দিই— এটা সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত শঙ্কু কাহিনী 'স্বর্ণপর্ণী' থেকে নেওয়া। গল্পটা কার্যত শেষ হচ্ছে এই কথাটার পরেই। 
গল্পটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের বিরক্তির উদ্রেক না করেই যাঁরা পড়েন নি এখনও— তাঁদের জন্যে একটু বলে দেওয়া ভালো—
প্রেক্ষাপটে ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাস, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর ঠিক কিছুটা আগে। ফ্যাসিস্ট হিটলারের নাৎসী বাহিনী তখন জার্মানির একচেটিয়া শাসক। জার্মানি জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ইহুদীদের চিহ্নিত করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর কাজটা! সেই সময়ে জীবনদায়ী ওষুধ 'মিরাকিউরল' আবিষ্কারের পর জার্মানি গিয়ে তা দিয়ে এক জার্মান ইহুদী অধ্যাপকের জীবন বাঁচান প্রফেসর শঙ্কু। খবরটা জানাজানি হতেই ব্ল্যাকশার্ট বাহিনীর মাধ্যমে খোদ গোয়রিং (নাৎসী বাহিনীর 'নাম্বার টু', হিটলারের পরেই যার স্থান!) তুলে নিয়ে যায় শঙ্কুকে। উদ্দেশ্য— নিজের চিকিৎসা, এবং ঐ মহৌষধ নাৎসী বাহিনীর কুক্ষিগত করা। সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে ঐ ইহুদী পরিবারটিকে দেশত্যাগ করতে সাহায্য করে তাদের জীবন রক্ষা করলেন, কীভাবে নিজের জীবন বাঁচালেন এবং সর্বোপরি কীভাবে গোয়রিং এবং গোটা নাৎসি বাহিনীকে ঐ মহৌষধ 'মিরাকিউরল' দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলেন প্রফেসর শঙ্কু— এই নিয়েই এই গপ্পো!
প্রথমে যে অংশটা কোট করেছি সেটা আরেকবার পড়ে দেখুন। ফ্যাসিস্টদের সম্পর্কে সত্যজিৎ লিখছেন— "বিশ্বের হীনতম প্রাণী"।

২)
ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু

এটা ঠিকই যে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলনায় সত্যজিতের ফেলুদা কাহিনী অনেক বেশিই জনপ্রিয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রথম শঙ্কু কাহিনী 'ব্যোমযাত্রীর ডাইরি' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে, অর্থাৎ ফেলুদারও আগে। এর ঠিক পরে পরেই প্রকাশ পেয়েছিল ছোটদের জন্যে লেখা গল্প 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'। তার আরো প্রায় বছর চারেক পর আত্মপ্রকাশ ঘটে ফেলুদার।
ফেলুদার কাহিনীগুলোয় সরাসরি রাজনীতি প্রায় আসেনি বললেই চলে। যেটুকু এসেছে সে' একমাত্র 'টিনটোরেটোর যীশু'তে। কিন্তু সেটাও ঐ একইভাবে ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েই। তবে এখানে জার্মানি আর হিটলারের বদলে পটভূমিকায় ইতালি, অর্থাৎ মুসোলিনি।
যাঁরা ঐ উপন্যাসটা পড়েছেন, তাঁদের পক্ষে মনে করা সহজ যেখানে ঐ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র চন্দ্রশেখর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভগওয়ানগড়ের রাজা ভূদেব সিং বলছেন—
"মুসোলিনি তখন ইটালির একচ্ছত্র অধিপতি। বেশির ভাগ ইটালিয়ানই তাকে পুজো করে। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী— শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংগীতকার— ছিলেন মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট পার্টির ঘোর বিরোধী। চন্দ্র ছিল তাদেরই একজন। কিন্তু তার ছেলেই শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। তার এক বছর আগে কার্লা মারা গেছে ক্যানসারে। এই দুই ট্র্যাজেডির ধাক্কা চন্দ্র সইতে পারে নি। তাই সে দেশে ফিরে আসে। ছেলের সঙ্গে সে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।"

সত্যজিৎ রায়ের ফেলু কাহিনীগুলোর মধ্যে এই  'টিনটোরেটোর যীশু'তেই একমাত্র ফ্যাসিবাদের প্রতি সত্যজিতের তীব্র ঘৃণা সরাসরি প্রকাশ পেয়েছে। আর সম্ভবতঃ কোথাওই না। অথচ ঠিক এর উল্টোদিকে আরেকটু কমবয়সীদের জন্য সৃষ্ট চরিত্র' প্রফেসর শঙ্কু'র একাধিক কাহিনীতে বারবারই এসেছে সত্যজিতের এই মনোভাব। মোট ৩৮ টা পূর্ণাঙ্গ এবং দুটি অসম্পূর্ণ শঙ্কু কাহিনীর খবর আমরা জানি। এর মধ্যে ঐ 'স্বর্ণপর্ণী' ছাড়াও আরো অন্ততঃ গোটা চারেক ক্ষেত্রে তা পরিষ্কার ভাবেই দেখা গিয়েছে।
প্রথম শঙ্কু কাহিনী 'ব্যোমযাত্রীর ডাইরি'র প্রায় ১৩ বছর পরে লেখা 'ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি'তে সরাসরি ফ্যাসিবিরোধিতা না থাকলেও, শঙ্কু কাহিনীতে সম্ভবতঃ এই প্রথমবার সত্যজিতের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ দেখা গেল। 'বি এক্স ৩৭৭' নামক আণবিক মারণাস্ত্রের ফর্মুলা যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁচ্ছানোর আগেই কীভাবে সেই ফর্মুলা ধ্বংস করা সম্ভব হল— সেই নিয়েই এই গপ্পো।
এর ঠিক পরের শঙ্কু কাহিনীই 'হিপনোজেন', যেখানে প্রথমবার শঙ্কু মোকাবিলা করছে এক ভয়ংকর ডিক্টেটরের— উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলেকজান্ডার ক্রাগ। বিজ্ঞানী, বা বলা ভালো অপবিজ্ঞানী। লক্ষ্য— একদিকে মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবন, আবার আরেকদিকে সেই বেঁচে ওঠার এবং বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে গোটা পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা। যার হাতিয়ার— একটা আবিষ্কার, একটি গ্যাস। নাম হিপনোজেন। যে গ্যাসের একটিমাত্র কণা একজন মানুষকে ২৪ ঘন্টা সম্মোহিত বা হিপনোটাইজড্ করে রাখতে সক্ষম! আর সত্যিই তো, "লোকের মন একবার দখল করতে পারলে তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে অসুবিধা কোথায়?"
অনবদ্য চরিত্রায়ণ এক ডিক্টেটরের। চেনা লাগছে না?

এর পরের একাধিক শঙ্কু কাহিনীতে সরাসরি ফ্যাসিস্টদের প্রতি মনোভাব চিত্রিত করেছেন সত্যজিৎ। যেমন ধরুন 'শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান'। এখানে এক জায়গায় পরিষ্কার উল্লেখ আছে বুখেনওয়ালড্ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং সেই ক্যাম্পে ইহুদি বন্দিদের উপর অত্যাচারের। ঐ উপন্যাসেই শঙ্কুর জবানিতে লিখছেন সত্যজিৎ— "আমি অবাক হয়ে দেখছি হাইমেনডর্ফের দিকে। চোখে ওই ক্রূর দৃষ্টি, ওই ইস্পাত শীতল কন্ঠস্বর— একজন প্রাক্তন নাৎসীর পক্ষে মানানসই বটে।"

এর আরও প্রায় এক যুগ পরের লেখা 'শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন'। পটভূমি আবারও জার্মানি, এবং এবার ফোকাসে নিও-নাৎসীরা। আবারও দ্বন্দ্ব শুভ-অশুভের মধ্যে, এবং পরিশেষে নিও নাৎসী নেতা রেডেলকে নিও ফ্যাসিস্ট থেকে নতুন জীবনে পাঠানো, অমানুষ থেকে মানুষে রূপান্তরিত করা। যার পরিণতিতে শঙ্কুর জবানিতে লেখা হচ্ছে— "যতদূর মনে হয় হিটলারপন্থী দল এবার নিশ্চিহ্ন হবে।" 
এর বছর দুয়েক পরের লেখা 'স্বর্ণপর্ণী'।

৩)
স্বর্ণপর্ণী ২

'স্বর্ণপর্ণী' উপন্যাসটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর আরও দুটো শঙ্কু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু দুটোই অসম্পূর্ণ। ফলে এটাই শেষতম সম্পূর্ণ শঙ্কু কাহিনী।
ঘটনা পরম্পরা দেখলে আবার এটাই শঙ্কুর প্রথম কাহিনী! পুরোটাই ফ্ল্যাশব্যাকে বিবৃত। অন্য শঙ্কু-কাহিনীগুলো রোজনামচা আকারে, ডাইরির একের পর এক দিন ধরে এগিয়ে চলা কাহিনী। আর এইটেতে ডাইরির পাতা একটা দিনেই (১৬ জুন) আটকে, নিজের জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করার ঢংয়ে বিবৃত গপ্পো।
জীবনসায়াহ্নে এসে স্মৃতিচারণা শঙ্কুর (বা হয়তো  সত্যজিতেরও)। এই স্মৃতিচারণার ফর্মেই লেখা হল শঙ্কুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী। কোনোরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না, সরাসরি ফ্যাসিস্ট জার্মানির কথা। সরাসরি সেই মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সর্বোপরি সরাসরি "বিশ্বের হীনতম প্রাণী" ফ্যাসিস্টদের সামান্য একটু হলেও হারানোর কাহিনী। মানবতার জয়ের কাহিনী।
__________________________

সত্যজিৎ দেখে যেতে পারেন নি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের দিনটিকে, যেদিনটা আমার দেশের ইতিহাসে এক মোটা কালো লাইন টেনে দিয়েছে। সত্যজিতের দেখার প্রশ্নই নেই এখনকার এই NRC-CAA'র পর্বটা। কিন্তু জেনেছিলেন ইহুদীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর ন্যূরেমবার্গ আইনের কথা। দেখেছিলেন গোটা বিশ্ব জুড়ে নিও ফ্যাসিস্ট প্রবণতার সাময়িক হলেও মাথাচাড়া দেওয়াটাকে। দেখেছিলেন নিজের দেশে সংঘ পরিবারের ক্রমশ বাড়বাড়ন্তকে।

একেবারে ছোটদের জন্য লেখা শঙ্কু কাহিনী। সবচেয়ে বেশি দিন যারা থাকবে, সবচেয়ে বেশি লড়াই যাদের করতে হবে মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে— তাদের জন্যে লেখা। তার জন্যই আরেকবার ইতিহাস থেকে শেখার জন্য এবং আশার পক্ষে, মানবতার পক্ষে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ইতিহাস থেকে শেখার জন্যেই বোধহয় একদম শেষ লগ্নে 'স্বর্ণপর্ণী'র মত লেখাটা আসে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন