বিশ্বব্যাপী সংবাদ সংস্থা, এসসিয়েটেড প্রেস বলছে তাদের সাংবাদিকদের ২৬ তারিখ সকালবেলাই বালাকোটের সেই কুখ্যাত পাঁচতারা টেররিস্ট ক্যাম্প, যা ভারতীয় বায়ুসেনা বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেখানে নিয়ে গেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সঙ্গে পাকিস্তানি মিডিয়ার সাংবাদিকরাও ছিল। এসসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকরা সেই পাহাড়ে কিছু উপড়ে পড়া গাছ আর দুটো ভাঙা মাটির বাড়ি ছাড়া কিছু দেখতে পায়নি। (লিংক: https://www.apnews.com/e64d72f76c4f475493e4d41501ebab06 )
চলে আসা যাক আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল রক্ষণশীল সংবাদপত্র, ওদের মালিক হলো কুখ্যাত ফক্স নিউজের মালিক - রুপার্ট মারডক। ওরা ট্রাম্প সমর্থক, খোলাখুলি ইসলাম বিদ্বেষী না হলেও কেউ ওদের ইসলামপন্থী বলে প্রশংসা করতে পারবে না। তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটা সম্মানীয় পত্রিকা, ফক্স নিউজের মত নয়। তো সেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও জানাচ্ছে যে বালাকোটে যেখানে বোমা ফেলা হয়েছে সেখানে কিছুই নেই কয়েকটা গাছ ছাড়া। (লিংক: https://bit.ly/2TphqtS )
একই কথা বলছে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং লন্ডনের টাইমস। ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকাও সন্দেহ করছে যে ফাঁকা জঙ্গলে বোমা ফেলেছে বায়ুসেনা। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে যে পাকিস্তানে বহুদিন যাবৎ বড় বড় টেররিস্ট ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেছে, যা আছে তা হলো ছোট ছোট টেররিস্ট সেল যারা কয়েকদিন পর পর জায়গা বদলায়। বালাকোটে, এক দশক আগে জঙ্গি ঘাঁটি থেকে থাকলেও এখন কিছুই নেই। (লিংক: https://nyti.ms/2GLbe9B , https://www.thetimes.co.uk/article/india-bombs-terror-camp-inside-pakistan-9cggx6lmt )
বিবিসি, সিএনএন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট - তাবর তাবর সংবাদমাধ্যম ঘেঁটেও কোথাও পেলাম না যেখানে তারা পাঁচতারা জঙ্গিঘাঁটির কথা বিশ্বাস করেছে।
একমাত্র আলজাজিরা বালাকোটের কাছে জৈশে মোহাম্মদ পরিচালিত একটা ছোট মাদ্রাসার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ হোক না হোক, অন্তত জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট যে হত সেইটা ধরে নেওয়াই যায়। কিন্তু সেই একচালা মাদ্রাসা কোনোভাবেই সুইমিং পুল শোভিত পাঁচতারা জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির বলা যাবে না এবং সেই মাদ্রাসাটি অক্ষতই আছে, বোমার আঘাত লাগেনি। জেহাদী মতবাদে দীক্ষা দেওয়ার জন্য এরকম ছোট ছোট মাদ্রাসা গোটা পাকিস্তান অকুপাইড কাশ্মীরে ভুরি ভুরি আছে, তাই এটা খুব হাই প্রোফাইল টার্গেট বিশ্বাস করাও কঠিন। (লিংক: https://bit.ly/2H5B7QO )
এতগুলো রিপোর্ট দেখেও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই ভক্তদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেশ, জেহাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করা দেশ - ইজরায়েলের সংবাদমাধ্যম ঘাঁটলাম। বায়ুসেনা যে বোমাগুলো ফেলেছে সেগুলোও তো ইজরায়েলি, ওরা নিশ্চই পাঁচতারা সন্ত্রাসবাদী ক্যাম্পের কথা লিখবে। ইজরায়েলের সব থেকে বড় সংবাদপত্র হারেতজের ওয়েবসাইটে গেলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য ওরাও বলছে যে বালাকোটের সেই পাহাড়ে দু চারটে কুঁড়ে ঘর ছাড়া কিছু নেই!! (লিংক: https://bit.ly/2Nyf06O )
এবার আমি পড়লাম বিপদে। কাকে বিশ্বাস করবো? বিশ্বের সেরা সংবাদমাধ্যমগুলোকে, যাদের সাংবাদিকরা ভুরি ভুরি পুলিতজার পুরস্কার পায় নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য, নিজেদের প্রাণ সংশয় করে যারা সংবাদ জোগাড় করতে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যায় হামেশা - সেই সব সংবাদমাধ্যমকে? নাকি ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোকে, যারা স্টুডিওয় বসে, ভিডিও গেমের ফুটেজ, পুরোনো ছবি, কুৎসিত গ্রাফিক্স সাজিয়ে বোমায় মৃতের সংখ্যা ২০০-২৫০-৩০০ বলে হাঁকাচ্ছে? আমি দেশদ্রোহী হতে চাই না তাই ভারতের সংবাদমাধ্যমকেই বিশ্বাস করলাম। বিশ্বাস করতেই হবে কারণ বিশ্বাস না করলে মেনে নিতে হয় যে ৪৪ জন সিআরপিএফ জওয়ান, দুজন পাইলটের বদলায় আমরা শুধু কিছু গাছ মেরেছি।
আজকে দেখলাম অনেকে ইমরান খানের প্রশংসায় গদগদ কারণ সে বলছে যে শান্তি চাই, বায়ুসেনার পাইলট অভিনন্দনকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছে সে। তাদের বলবো যে ৪৪ জন সিআরপিএফ জওয়ান, দুজন বায়ুসেনা পাইলট - এই সংখ্যাগুলো ভুলবেন না । ৪৬ জনের কফিনের সামনে দাঁড়ালে ইমরান খান কত শান্তির বাণী শোনাতেন তা আমার জানা আছে। প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেললে সহজেই মহান সাজা যায়।
আমাদের এই ব্যর্থতা জন্য কিন্তু বায়ুসেনা একেবারেই দায়ী নয়। অন্ধকারে ৫ হাজার ফিট ওপর থেকে বোঝা সম্ভব নয় কোনটা জঙ্গি ঘাঁটি কোনটা নয়। বায়ুসেনাকে টার্গেট দিয়েছিল আমাদের গোয়েন্দারা, তারা সেই মত দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে বোমা ফেলে এসেছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এই গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে অজিত দোভাল নামের এক অপদার্থ। ভুলে গেলে চলবে না যে এই অজিত দোভাল গোয়েন্দা বিভাগের সব স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে মোদি নামক এক চূড়ান্ত অপদর্থের পায়ে তাকে সপে দিয়েছে, যাতে করে দেশের নিরাপত্তা, তার সামরিক নীতি - সবকিছু থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারে বিজেপি।
মোদির মত অপদার্থ সত্যিই খুব কম হয়। সারা মিডিয়া কিনে নেওয়ার পরও নিজের অপদর্থতা লুকোতে পারছে না। ভারত পাকিস্তানের সাথে খোলাখুলি যুদ্ধে যেতে পারবে না এটা অর্ণব গোস্বামীও জানে আর ভারতের পক্ষে জেহাদী জঙ্গি দিয়ে পাকিস্তানের সাথে ছায়াযুদ্ধ করাও সম্ভব না। উপায় একটাই - কূটনৈতিক চাপ। ভারত সোজাসুজি দাবি করতে পারতো মাসুদ আজহারকে ইন্টারপোলের হাতে যতক্ষণ না তুলে দিচ্ছে পাকিস্তান ততক্ষণ কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে না। সারা বিশ্বে পাকিস্তানকে শুধু মাসুদ আজহারের ইস্যুতেই একলা করে দেওয়া যেত, সমস্ত রাষ্ট্রকে দিয়েই চাপ দেওয়ানো যেত যাতে মাসুদ আজহারকে ইন্টারপোলের হাতে তুলে দেয়। সেটা করতে গেলেই ইমরান খানের বিচি শুকিয়ে যেত কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে বহু মাসুদ আজহারের ভক্ত রয়েছে। কিন্তু সেই কূটনৈতিক লড়াই মোদি সেদিনই হেরে গেছে যেদিন পাকিস্তানকে বিপুল সাহায্য ঘোষণার পরদিনই সৌদি রাজপুত্রকে এয়ারপোর্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।
তাই আজ এই বিরাট ব্যর্থতা ও অসহায়তার মাঝে, ভারতীয় মিডিয়ার পাঁচতারা জঙ্গি ঘাঁটিতে ২০০-৩০০ জঙ্গির লাশ গোনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের। অবস্থা এতটাই করুন যে সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকে বিবৃতি দিতে হচ্ছে প্রকাশ্যে, যাতে সেনাবাহিনীর মনোবল না নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যর্থ সরকারকে ছুঁড়ে না ফেললে আরো বেইজ্জত হবে দেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন