বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

শ্রেণী ~ আর্কাদি গাইদার

সে এক সময় ছিলো বটে। তখন ফেসবুক, টিভি, কিছুই ছিলো না। রেডিও ব্যাপারটা অর্ধেক লোক চেনে না। সংবাদপত্র পড়বার মতন শিক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠের নেই। তখন যদিও নারী ছিলো। নারীদের লড়াই ছিলো। সম কাজে সম বেতনের দাবিতে লড়াই। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের দ্বারা হেনস্থাকে প্রতিহত করবার লড়াই। নারীদের ভোটাধিকারের লড়াই। নারীদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই। শিক্ষার অধিকারের লড়াই। অনেকেই জানেন না, বা ভুলে গেছেন হয়তো, রুশ বিপ্লবটা শুরুই হয়েছিলো ৮ই মার্চ, ১৯১৭ এর পেত্রোগ্রাদে মহিলা শ্রমিকদের মিছিল দিয়ে। International Working Women's Day র মিছিল। 

তারপর ভলগা থেকে গঙ্গা হয়ে বহু জল গড়িয়েছে। এর মধ্যে Working টা বাদ পড়ে গিয়ে International Women's Day হয়ে গেছে। আমরা পুরনো প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণা ত্যাজ্য করে নতুন করে ভাবতে শিখেছি। আমাদের শেখানো হয়েছে যে নারীর ক্ষমতায়নের মাপকাঠি হলো সে কতটা দক্ষতার সাথে অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভেঙে ক্ষমতার কাঠামো বেয়ে উঠছে, এবং স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে সাহায্য করছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন 'দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী'দের লিস্ট ছাপিয়েছে বছরের পর বছর। সেখানে স্থান পেয়েছেন পেপসিকোর সিইও ইন্দ্রা নুয়ী। কারন তিনি নারী হয়ে সেই কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরে পৌছাতে পেরেছেন, যারা এই দেশের মাটিতে পানীয় জলস্তরকে নিঃশেষ করেছে, হাজার হাজার একর জমিকে বিষিয়ে দিয়ে নষ্ট করেছ। স্থান পেয়েছেন হিলারি ক্লিন্টন। কারন তিনি আরেকটু হলেই হাতে পেতেন দুনিয়ার সবচেয়ে ভীতিপ্রদর্শক সামরিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, তার হাতে থাকতো মার্কিন পারমাণবিক শক্তি সমাহারের বোতাম, যা এতদিন ছিলো শুধু পুরুষদের কুক্ষিগত। স্থান পেয়েছেন বায়োকনের কিরণ মজুমদার শ, এবং তার পরেই তার খ্যাতির জৌলুষ নিয়ে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাড়িয়েছেন। স্থান পেয়েছেন অরুন্ধুতী ভট্টাচার্য্য, যিনি স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান থাকাকালীন রিলায়েন্সকে বানিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের প্রমোটার, আর রিটায়ারমেন্টের পরেই রিলায়েন্সের ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা হাততালি দিচ্ছি, কারন স্বাধীন ভারতের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ভরা বাজার, যা এতদিন ছিলো শুধু অবাঙালি পুরুষদের কুক্ষিগত, সেখানে মাথা উচু করে প্রবেশ করেছেন একজন বাঙালি নারী।

না, ফোর্বসের এই লিস্টে স্থান পাননি জগমতি সাংগোয়ান, যিনি বছরের পর বছর গোবলয়ের খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। স্থান পাননি সোনি সোরি, যার সারা শরীরে পুলিশ লিখেছে সন্ত্রাসের উপকথা, আর যার মুখে এসিড ছুড়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে দেশভক্ত নাগরিক। স্থান পাননি দীপিকা সিং রাওয়াত, যিনি নিজের পেশায়, নিজের পরিসরে, নিজের সমাজে সম্পূর্ন একা হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একটি আট বছরের শিশুকন্যার বিধ্বস্ত লাশের হয়ে। স্থান পাননি অংগনওয়াড়ি কর্মীদের বহু বছরের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া ডাক্তার হেমলতা। কারন এনারা কেউই সেই অমোঘ কাঠামোর অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভাঙতে পারেননি হয়তো। আমরা তো তাই শিখেছি, আসল ক্ষমতায়ন তো সেইখানেই - যখন কাঠামো আপন করে নেয় প্রান্তিক পরিচিতিকে, যখন 'মুসলমান' কালাম রাষ্ট্রপতি হন, যখন 'নারী' অরুন্ধুতী ডিরেক্টর হন, যখন 'কালো' ওবামা প্রেসিডেন্ট হন, যখন আমাদের শেখানো হয় 'বাঙালি' প্রধানমন্ত্রী তোমার চাহিদা, কারন তুমি বাঙালি - আর কাঠামো বলে - দেখো, ক্ষমতায়ন একেই বলে, পরিচিতির স্বীকৃতি আমার থেকে ভালো আর কে দিতে পারবে?

আর চারিদিকে এই হিন্দু, মুসলমান, বং, গুজ্জু, খোট্টা ইত্যাদি আইডেন্টিটির ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যেতে থাকেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মানেক হোমি আর জামশেদজি টাটার ভাইপো, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং এমপি সাপুরজি সাক্লাতওয়ালা, দুই পারসি কমিউনিষ্ট, যারা একইসাথে ডান্ডিতে আর জামশেদপুরে লেবার ইউনিয়নের স্ট্রাইক শুরু করেছিলেন, পারসি মালিকানার টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে। হারিয়ে যায় তাদের পারসি পরিচিতি, যেমন হারিয়ে যায় সেই লোকটির পরিচিতি যাকে টাটারা জামশেদপুরে নিয়ে এসেছিলো 'প্র‍্যাগম্যাটিক' ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসেবে এবং যিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটিয়ে স্ট্রাইক ভেস্তে দেন। হারিয়ে যায় টাটাদের ভরসার সেই দুর্দান্ত তরুন নেতা সুভাষ চন্দ্র বোসের 'বাঙালি' পরিচিতি। পারসি, বাঙালি, ভারতীয়, ব্রিটিশ সব ছাপিয়ে একটাই পরিচিতি মূখ্য হয়ে ওঠে - শ্রেণী।

রাজনৈতিক দলের পুজোর বুকস্টলে ঘুরতে ঘুরতে দেখি স্টল সাজানো হয়েছে পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দিয়ে। রাজস্থানে শম্ভুলাল রেগারের হাতে আফরাজুলের খুনের খবর। সেইসময়কার শিরোনামের সাথে মেলাতে চেষ্টা করি - 'রাজস্থানে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হলো বাঙালিকে', 'রাজস্থানে খুন মুসলিম'। মেলাতে পারি না। খবরের কাগজের শিরোনাম গালে সপাটে থাপ্পড় মারে - 'রাজস্থানে আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হলো শ্রমিককে'। কেউ যেন মুখের সামনে চিৎকার করে - শ্রেণী, শ্রেণী, শ্রেণী। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর পাশ থেকে একজন প্রৌঢ়া বই ওলটাতে ওলটাতে মন্তব্য করে - রাজস্থানে দারুন ব্যাপার ঘটছে, বলো? ওরকম একটা গোবলয়ের অঞ্চলে কৃষকদের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের রাজ্যের লোক। উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘুরে দাড়াই, ভাবি বলবো - হ্যা, ভেবে দেখেছেন, একজন বাঙালি মুসলমান, হান্নান মোল্লা, তার নেতৃত্বে রাজস্থানের এতগুলো চাষী এরকম মারমুখী হয়ে নেমেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। যেন ম্যাজিক। 

কিন্তু বলবার আগেই থেমে যাই, নিজেকে শুধরে নিই। ম্যাজিকের কি আছে এতে? পরিচিতির ভরাবাজারে যাকে যাদুমন্ত্র মনে করছি - শ্রেনী, শ্রেনী, শ্রেনী! - আসলে একমাত্র সেই পুরনো সাবেকি unfashionable ব্যাপারটাই তো বাস্তব। বাকিটাই আমাদের বোকা বানানোর ম্যাজিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন