শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৪

আজ আমাদের ন্যাড়া-পোড়া, কাল আমাদের দোল: কিঞ্জল ঘোষ

বড় হওয়াটা আধা শহর এক জায়গায়, যদিও পিন্‌ কোডে কলকাতা-৬০। টালি আর টিনের চালের-ই ম্যক্সিমাম্‌ ছাওয়া। বাদামতলা থেকে গড়াগাছা তেঁতুলতলার মাঠ অবধি ছিল আমার জগৎ। ‘হারামজাদা’ শব্দটাকে জানতাম আদরের-ই ডাক হিসেবে। আদরটা সত্যি-ই ছিল। এই ডাক্‌টা বড় মিঠে করে ডাকতে পারত ছোড়দিদা। পাড়ার ছোটপিসি। একটা পৌনে পাঁচ ফুটের টিঙটিঙে শরীর থেকে কি করে যে অমন পাড়া কাঁপানো আওয়াজ বের’ত, আজ-ও রহস্য। কালোকুলো আজীবন আইবুড়ো মানুষটা একটা আন্‌কোয়েশ্চনেব্‌ল হেজিমনি এবং সময় বিশেষে ডমিনেন্স্‌ বজায় রাখত গোটা পাড়ায়। আমার ঠাম্‌ কে বৌদি বলে ডাকত, যাবতীয় ফাই ফরমাশ হাসিমুখে করে দিত। বদলে গোপাল-জর্দা পানেই এক মুখ হাসি।
হাওয়া বাতাস লাগলে নুন-পোড়া, জল-পড়া, পক্সের দয়া হলেই পোড়া-শিবের তেল, আর আমাদের ন্যাড়া-পোড়ায় ন্যাড়া-গাছ বাঁধার জন্য শাড়ির ছেঁড়া পাড়, সর্বদা মজুত থাকত। এবং আমাদের ন্যাড়া-পোড়ার পাতা পাহারা দেবার জন্য অমন বিশ্বস্ত প্রহরী ইন্দো-পাক্‌ সীমান্তেও পাওয়া যাবে না। সরু সরু হাতে ওই শাবল চালানো যে দেখেনি, এক মাত্র সেই “অবলা নারী” শব্দটা বলতে পারে। নতুন পয়সার বারফাট্টাই দেখলেই স্ট্যন্ডার্ড লাইন ছিল ছোড়দিদা’রঃ “এ ছেলে বাঁচলে হয়”। ভোটের দিনের চা আর ভোটের আগের যত্ত জ্বাল দিয়ে আঠা। ছানি পড়ার পর একবার ভোট দিতে গিয়ে ব্যালট্‌ পেপার নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে গিয়ে বক্তব্যঃ “আঁট্‌কুড়ির ব্যাটা... কাস্তে হাতুড়ি নেই ক্যন্‌ রে?” সিম্বল দেখিয়ে দেওয়ার পর ভোট্‌ দিয়ে বের’নোর সময় সেই প্রিসাইডিং অফিসারের মাথায় হাত বুলিয়ে “বেঁচে থাক বাবা। আমি তোর মার বয়সি। গালাগাল করেছি বলে কিছু মনে করিস না, তোর পর্‌মায়ু বাড়বে”। আজ ছোড়দিদাদের ইঁট বার করা বড় বড় আড়াইখানা ঘর আর পেঁপে গাছ, নিম গাছ কিচ্ছু নেই। জি প্লাস, সেভেন্‌ অ্যাপার্ট্‌মেন্ট্‌, তলায় গ্যরেজ্‌ স্পেস্‌।
আমাদের ঠিক যেই সময়টা আড় ভাঙার, বই-পড়া এনলাইটেন্‌মেন্ট ফলানোর, আমার ঠিক সেই বয়সে ছোড়দিদা’র চোখে বা কানে আমি গেলেই আমার “মেলেচ্ছপনা” নিয়ে নাক সিঁটকিয়ে বলতঃ “চার মাসে ডায়েরি (ডায়ারিয়া) হয়ে ও ছেলে মরো মরো। তবে থেকে কোল্‌ করেছি। ফেলতে তো আর পারি না। মরুগ্‌গে যাক...” শেষের ক’টা দিন জানালা দিয়ে আমাকে দেখলেই চালভাজা খাওয়াতে বলত। কে কেমন আছে, যানতে চাইত যাদের ম্যাক্সিমাম-ই বহু আগে মারা গেছে। আর একটা কথা বলতঃ “মোচ্ছব বেশি হলেই মন্বন্তর আসে রে...”। অযত্নে অপ্রাসঙ্গিক মৃত্যু হল তার চার বছর আগে।
হ্যালোজেন্‌ ভেপারের এত আলো এখন, ন্যাড়া-পোড়ার আর প্রয়োজন নেই অশুভের অগ্নি-নিরঞ্জনের। আমরাও আর তালে তালে তালি দিতে পারব না “আজ আমাদের ন্যাড়া-পোড়া কাল আমাদের দোল... পূর্নিমাতে চাঁদ উঠেছে”।

1 টি মন্তব্য:

  1. অসম্ভব ভালো হয়েছে লেখাটা. অনেক কিছু মনে পড়ে গেলো. নিষ্পাপ সুন্দর সেই দিন গুলো।

    উত্তরমুছুন