শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৪

​আসল ও সুদ ~ লোপামুদ্রা মিত্র পাল

আসলের থেকেও সুদের মোহ বেশী। জগত জুরে ফ্রী র যে রমরমা তা কি অনস্বীকার্য ? আমাদের ছোটবেলায় খালি পয়লা বৈশাখের আগে যা চৈত্র সেল দেখতাম কিম্বা গান্ধী জয়ন্তী বা দুর্গাপুজোয় খাদি থেকে রিবেট। কিন্তু এমন আগ্রাসী "ফিরি" র চক্কর ছিল না তখন। কথায় বলে ছেলেমেয়ের থেকে নাতি-নাত্নির আদর বেশি তা ওই আসলের থেকে সুদের কদর বেশি সেই সুত্রানুসারেই। সেতো অনবরতই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আমাদের যা যা করতে মানা করা হোতো তা অবলীলায় নাতি – নাতনি দের করতে দেওয়া হয়। যাক এ লেখা তা নিয়ে নয়।

প্রথম কলকাতায় এসে মাসির কল্যানে ফ্রি র সাথে পরিচিতি। মাসি পাড়ার গনেশের দোকান থেকে আটা কিনে প্রথম সত্যেন্দ্র ছাতুর প্যাকেট ফ্রি পেয়ে ফ্রি ওয়ার্ল্ডে জয়যাত্রা শুরু করে। বাড়িময় সে কি উৎসাহ – উদ্দীপনা !! এক মাসের ছাতু ফ্রি পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? বাবা শুনে বললেন " লেগে থাক, এই করে করেই একদিন বাড়ি- গাড়ীও ফ্রি তে হবে।" তার পর থেকে মাসি নিবিড় অধ্যাবসায়ে স্তেইনলেস স্টিলের চামচ, সাবান, শ্যাম্পুর পাউচ, কলম, মুখে মাখার লোশন, ব্যাটারি এরূপ নানাবিধ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিশ পেয়েছে।

আমার পূর্বোক্ত কোম্পানিতে হটাত একদিন একজন বসের কাছে জলদি ছুটি চাওয়ায় সবাই চেপে ধরে কারন জানতে। কিছুতেই বলতে রাজী হয় না। অনেক সাধ্য- সাধনার পর জানা যায় যে সিনেমা দেখতে গিয়ে এক লাখ টাকার লটারির টিকিট ফ্রি পেয়েছিল। আজ ফোন করে তারা জানিয়েছে যে লটারি লেগেছে। বিকেল ৫ টায় অমুক হোটেলে যেতে বলেছে। আমরা কজন জোর - জবরদস্তি করে ওর ঘাড় ভেঙ্গে আরসালানের বিরিয়ানি সাঁটিয়ে দিলাম সেদিন যাবার আগে, বস ও ছিল। নয়ত আর্লি লীভ আপ্রুভ করবে না হুমকি দিয়েছিল। তা যাক পরদিন সে এল কাঁচুমাচু মুখে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল কতৄপক্ষ এক লাখ টাকার ইন্স্যুরেন্স গছিয়েছে হাজার টাকার প্রিমিয়ামের বদলে আর সাথে অবিশ্যি একটা কাচের বাটির সেট "ফ্রি" মিলেছে।

এরকম হরেক কিস্যা ফ্রি নিয়ে। আমার বাড়ি বালতিতে ছয়লাপ, পা ফেলার জায়গা নেই। নামকরা ডিটারজেন্টের সাথে প্রতিবার বালতি দেয় আর প্রতিমাসে একটি করে নীল বালতি আমার প্রাপ্তি ঘটে । প্রথমে দুটো বাথরুমে বালতিতে ছেয়ে ফেললাম। তারপর ব্যাল্কনিতে বালতির মনুমেন্ট বানালাম। তাও তারা ফ্রি বন্ধ করল না আর বদলালও না। তখন আর কি করি একে তাকে ধরে বালতি গছানোর ধান্দা করি। মা কে দুটো গছানোর পর যেই তৃতীয়টা গছাতে গেছি, মা বলল খবরদার, হ্যাঁরে তোর কি আমায় দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই? মুঝ্যমান হয়ে পরলাম। তারপর উপায় ঠাউরেছি মাসোহারা তো দেই, মাসোহারার সাথে ওই বালতি ফ্রি। তাতে খামখা চটে গেল। অভিমান করে বলল মাসোহারাও চাই না। কী বিপদ!!! কাজের দিদি দের গোটা কয়েক করে দেবার পর তারাও আর নিতে রাজী হয় না। সেদিন এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, তিনি সুগারের রোগী। প্লেট ভর্তি মিষ্টি সাজিয়ে দিলে তিনি বেশ খুশি হন। কারন ভালবাসাও মেটে আর নিজের হাতে পাপ ও করতে হয় না। তাকে খেতে দিয়ে বালতির কথা পাড়লাম। মিষ্টি গলায় আটকে বিশম খেয়ে একশা। সন্দিহান হয়ে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। বললেন তোর কি মাথা খারাপ? আমি বালতি বয়ে বেহালা যাব !!! আমি বললাম হয় নি তবে অচিরেই হবে। অবশেষে মুস্কিল আসান – " কাবাড়িওয়ালা" নতুন এলে পুরনো বেচে দাও। খেতাব ও পেয়েছি " বালতি বউদি" ।

এবার আসি পিসির গল্পে। নামকরা শপিং মলে কেনাকাটায় মোবাইলে কথা বলার জন্য টক টাইম সহ সিম ফ্রি। এদিকে নেই মোবাইল। তাতে কি ফ্রি তো বটে । ধরিয়ে দিতে বরং চটে গেল। বললেন আরো একটা জিনিষ পেয়েছি-৫০,০০০ টাকার বেড়াবার কুপন। সেই নিয়ে কদিন কি আলোচনা। যাই হোক নির্ধারিত দিনে পিসি – পিসু দুই বয়স্ক মানুষ গরমের রোদে ভাজা হতে হতে ট্যাক্সি ভাড়া করে গিয়ে সেই কুপন আনলেন খুশিতে গদগদ হয়ে। বাড়ী ফিরে শর্তাবলি পড়ে বেড়াবার ইচ্ছেয় ইতি টানলেন। বোধহয় গ্রীষ্মে রাজস্থান, বর্ষায় চেরাপুঞ্জী, শীতে কাশ্মীরে , এরকম ই কিছু ছিল। তাছাড়াও খাওয়া – দাওয়া ও ট্রান্সপোর্ট এই প্যাকেজ বর্জিত, বিলাস কর আলাদা, ও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভ্রমন করতে হবে ইত্যাদি ও প্রভৃতি।

বাবাকে নিয়ে গেছি নামকরা ব্র্যান্ডের টি সার্ট কিনে দেব। গিয়ে দেখি ৭৫% ফ্রি মানে রিবেট , আর সেদিনের জন্য আরও এক্সট্রা ২০% ফ্রি। মানে টোটাল ৯৫% ফ্রি। তাতে দাম দাঁড়াচ্ছে ৩৫০ টাকা। বাবা ফস করে বলে বসলেন এই জামার আসল দাম ৭০০০ টাকা। এরা তো গাঁটকাটা । যত বলি খুব ভাল ব্র্যান্ড, ওরকম বলতে নেই। কে শোনে কার কথা। শেষমেশ তড়িঘড়ি সম্মান বাঁচাতে বেড়িয়ে পড়ি দোকান থেকে কিছু না কিনেই।

সবচেয়ে রোমহর্ষক ও করুন ঘটনা দিয়ে "ফ্রি" তে ইতি টানি। মা একদিন একতা পুচকি পেপার কাটিং নিয়ে খুব উত্তেজিত। তাতে লেখা আছে কুপন নির্বাচিত কয়েকটি মুদির দোকানে দেখালে ২০ কেজি বিস্কুট "ফ্রি" । অভিভুত হয়ে বললেন এদ্দিনে বুঝি ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। সবাইকে বলে বেড়াতে লাগ্লেন আমার ফ্রি বাতিক নিয়ে ঠাট্টা !! লেগে থাকলে কি না হয়। সামনেই বোনের বিয়ে ছিল। আমার দূরদর্শী বর শ্বশুরের পয়সা বাঁচাতে পরামর্শ দিল বড় টিন কিনতে। অতিথি- অভ্যাগতের চা এর সাথে একটা বড় খরচের সুরাহা হল। এয়ার টাইট টিন কেনা হল ও যথাসময়ে বাবা চেনা রিক্সাওয়ালা ও দুটো বড় থলি সহযোগে বেশ খানিকটা ঠেঙ্গিয়ে ঐ নির্বাচিত দোকানে গেলেন। ঘণ্টা খানেক পড়ে ফিরলেন। হাতের থলি তে কিছুটি নেই। আমরা উৎকণ্ঠিত । হুমড়ি খেয়ে সমস্বরে জিজ্ঞেস- " দিল না আজ?" বাবা বললেন দিয়েছে। কোথায় ?? কোথায় ?? পকেট থেকে স্যাতান খবরের কাগজে মোড়া দুটো ন্যাতান মেরী বিস্কুট বার করে বললেন , "এই যে" আমাদের ছ-জোড়া চোখ ঠিকরে বেরচ্ছে। বাবা ফের বললেন, "ওটা ২০ গ্রাম লেখা ছিল, তোমার মা ভুল করে ২০ কেজি দেখেছেন। আর এর জন্য আমায় অত দুরের দোকানে গিয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হল।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন