সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১১

রক্তে ভেজা কোলাজ ~ সদানন্দ কারিগর

রক্তে ভেজা কোলাজ

-সদানন্দ কারিগর

ঘটনা ১ : বাঁকুড়া সন্মিলনি মেডিকেল কলেজের মর্গ-এর উল্টো দিকের চা'য়ের দোকান। বহুদিন পর হঠাৎ দেখা এক কমরেড-এর সাথে। চিৎকার করে ডাকি- আরে কমরেড, কি খবর? এখানে? সেই চেনা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। মুখটা একটু শুকনো। মনটা খচখচ করে উঠল। তাহলে কি কোন আত্মীয়-স্বজন


অদ্ভুত ক্ষমতা এদের অন্যের মনের কথা বোঝার। হাতটা চেপে ধরে বললেন, বাড়িতে সব ভালই। পার্টী থেকে দায়িত্ব দিয়েছে মর্গ সামলানোর। সারেঙ্গা বা বাঁকুড়া জেলা লাগোয়া অঞ্চলে প্রায় রোজই কমরেডরা খুন হচ্ছেন। 'বডি'গুলো এখানেই আসছে। আমরা সাহায্য না করলে গ্রামের মানুষ আরও বিপদে পরবে। তাই


শহুরে মধ্যবিত্ত - অবাক চোখে আকাশটাকে আঁকড়ে ধরে পালাতে চায়। পারেনা। আবার সামাল দেয় সেই কমরেড। পকেট থেকে একটা কালো সুতোর বিড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ছাড়ো ওসব। মুহূর্তে স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে বলি, এখনও কতো এসেছে? উনি বললেন- প্রথম প্রথম হিসেব থাকতো। এখন আর থাকেনা। তবে জান কমরেড, একটা ঘটনা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিনা। রাতে শুতে গেলেই মনে পড়ে। ঘুমাতে পারিনা। সেপ্টেম্বর- এর ১০ তারিখ। সারেঙ্গাতে খুন হন ৭১ বছরের প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক কৃষ্ণ কুণ্ডু। পরের পরের দিন, মানে ১২ তারিখ ওনার ছেলে এসেছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ছেলেটা আমার পাশে। খেয়াল করিনি, কখন আমার কাঁধে মাথাটা রেখেছে। 'বডিটা' বের করা হচ্ছে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি লাল পতাকাটা নিয়ে। ঢেকে দিতে হবে। হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠল- 'কাকু, বাবার মুখটা একটু পরিষ্কার করে দেবে? এত রক্ত, ভাল করে দেখাই যাচ্ছে না।' বিশ্বাস করো কমরেড, ঘুমোতে গেলেই কথাটা কানে বাজে। মনে হয় ছুটে যাই জঙ্গল মহলে। দেখি একবার ওদের কত শক্তি। পার্টী হাত বেঁধে রেখেছে, আমাদের কিচ্ছু করার নেই। 

 

ঘটনা-২ : ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের শেষ সমাবেশ। একটু আগে লালগড়ের বিনপুর জোনাল কমিটির মিছিল এসে ঢুকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সহযোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়েছে মাঠ। ওঁরা বসলেন মাঠের এক কোণে। মঞ্চে বুদ্ধদেব ভাষণ দিচ্ছেন। আমি থাকতে না পেরে চলে গেলাম ওদের কাছে। বললাম- 'লাল সেলাম কমরেড, দারুণ লড়ছেন আপনারা'। প্রত্যুত্তরে হাতের মুঠি শক্ত করে লাল সেলাম জানালেন। কিন্তু মুখে কোন কথা নেই। আবার অবাক হই। ভাবি তাহলে কি আমার পোশাক বাধা হ'য়ে দাঁড়াল? আমাকে কি কমরেড ভাবতে পারছেন না? বসে পরি ওদের পাশেই।

বক্তৃতা শেষ করলেন বুদ্ধদেব। পাশের মানুষগুলো উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন। বছর পঁচিশের এক যুবক শূন্যে হাতটাকে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন- 'ই ই ই ইনকিলাব', চারপাশ কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠলো 'জি ই ই ই ন্দা বা আ আ দ' 


এক মাঝবয়সী কমরেড এবার তাকালেন আমার দিকে। জানতে চাইলেন আমি সাংবাদিক কিনা। বললাম না না তেমন কিছু না। এবার তাকালেন সোজা। বললেন, লেখেন নিশ্চয়ই? কিছু জানতে চান? আমতা আমতা করে বললাম- 'ইয়ে মানে পেপার পড়েতো সব ঠিকমতো জানা যায় না। আপনাদের মুখেই তাই শুনতে এসেছি আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা'

-আপনারা শহরের লোক, পারবেন শুনতে ওসব? আমার বাড়ী শালবনী। ২০০৯ সালের জুন মাসে, ১০ জন কমরেড কে ধরে নিয়ে গেছিল ওরা।  দীনবন্ধু সরেন, প্রবীর মাহাত, মলয় মাহাত, সঞ্জয় মাহাত, কেশবচন্দ্র মানা, ধীরজ মানা, মোহন সিং, দেবব্রত সরেন, অসিত সামন্ত আর নাড়ু সামন্ত। হাত-পা বেঁধে রোদের মধ্যে ফেলে রেখেছিল সারাদিন। প্রচন্ড তেষ্টায় জল চাইলে মুখে পেচ্ছাব করে দিয়েছিল মাওবাদীর দল। তারপর একটা ছোটো ঘরে লঙ্কার বস্তায় আগুন ধরিয়ে সেখানে সবাইকে ঢুকিয়ে দম বন্ধ করে মেরে লাশগুলো গায়েব করে দিয়েছে। শালবনী হাইস্কুলের মাষ্টার মশাই, একমাত্র ছেলে মলয় মাহাত-র ছবি নিয়ে আজো জনে জনে জিজ্ঞেস করে তার ছেলের কথা। মা-বাবা দুজনেই আজ সন্তান শোকে পাগল।


বৈতার স্নেহাশীষ দাস। ওর বৌটার সেদিন 'সাধ'। ভজালি দিয়ে গলাটা কেটে আনন্দে চীৎকার করেছিল ওরা। পাগল বৌটার একমাস বাদে একটা মেয়ে হয়েছিল।


কানাই দিগনায়েক। বৌ-ভাতের দিন ঘর থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে গুলি করে মারে। সদ্য বিয়ে আর একই সাথে বিধবা হওয়া বৌটা এখন শুধু তাকিয়ে থাকে। কথা বলেনা।


আকাশ বেজ আর তাপস মণ্ডল। গুঁড়ি গ্রামে বাড়ি। মকর সংক্রান্তির নতুন জামা কাপড় কিনতে গেছিল ছেলে-মেয়েদের জন্য বিনপুর হাটে। গুলি করে মেরে দেয় ওরা।


বেলাটিকরি অঞ্চলের জামদা হাইস্কুলের শিক্ষক কার্ত্তিক মাহাত। পড়াচ্ছিল। ছাত্রদের সামনেই গুলি করে মারে। দুজন ছাত্র তারপর থেকে ভয়ে বোবা হয়ে যায়।


আমার ভেতরটা গুলিয়ে ওঠে। থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, এর পরেও লড়ছেন, ভয় করেনা? অদ্ভুত হাসি হেসে ওঠেন উনি। হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন- 'একটু আগে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কি বলল শুনলেন? এভাবে আমাদের শেষ করা যায় না। জয় আমাদের হবেই'


গোটা দলটা উঠে দাঁড়ায়। এবার ওদের ফিরতে হবে। মরার জন্য, নাকি অনেককে বাঁচাতে? উত্তরটা অজানাই থেকে যায়।


ঘটনা ৩ : সন্ধ্যে ৭টার প্রেস ক্লাব। কোণের TV তে প্রাক্তন নকশাল নেতা কতিপয় বুদ্ধিজীবী পরিবেষ্টিত হ'য়ে 'রেজিমেন্টেড পার্টী-র' বাপান্ত করছেন। একটু আগেই বামফ্রন্টের আসন্ন পরাজয়-এর সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষন করে আসা ক্লান্ত সাংবাদিক কেরাম-এর বোর্ড থেকে ঘার ঘুরিয়ে এক ঝলক সেটা দেখে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন 'শালা রেড-বুকটাও পড়েনি। শংকর দুটো লার্জ বিপি আর সোডা দিস্‌'।।   


************


সাত্রে'র নাটকটা মনে পড়ে? কিভাবে একজন সাংবাদিক একটু একটু করে Pathological liar-এ পরিণত হয়? যদিও তারা জানে, তারা যা লিখছে তা আসলে মিথ্যে। একসময় তারাই সেটাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে।


এই মুহুর্তে আমরাই বা কম যাই কিসে? আপাদমস্তক মিথ্যেয় মোড়া অর্ধশিক্ষিত এক ছিটেল মহিলার পেছনে মনে মনে একবারো কি দৌড়াইনি? একবারও কি মনে হয়নি, জঙ্গলে রক্ত ঝরছে কারন অনুন্নয়ন? যেন শ'খানেক গরিব মানুষ মরলেই ওখানে উন্নয়নের বন্যা বয়ে যাবে? একবারও কি মনে হয়নি, যাক না একবার বামফ্রন্ট সরকারটা বছর খানেকের জন্য? সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল কি, গোটা রাজ্যটাই জঙ্গলমহল বানিয়ে দিতে পারে ওরা? সপাটে নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয় কি তার জন্য?


এখনও সময় আছে। অথবা এই তো সময়। লাল পতাকাটাকে আরো উঁচুতে তুলে ধরুন। এ লড়াই জিততেই হবে।

1 টি মন্তব্য: