সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০২৩

মণিপুর ~ সুমিত সান্যাল

জীবিকার কারণে বহুদিন মনিপুরে যেতে হতো। প্রতি মাসে ৪ দিনের জন্য ইম্ফল যেতাম। আর প্রতি দুমাসে একবার চূড়াচাঁদপুর যেতাম। মণিপুরের মানুষ গুলোকে খুব কাছ থেকে চিনি। এখনও অনেক বন্ধু আছে মনিপুরে।
মণিপুরের শহরাঞ্চলে মিতেই সম্প্রদায়ের বাস। মিতেই সম্প্রদায় মণিপুরের মূল উপজাতি। এদের বেশিরভাগ পদবী সিং। ধর্ম হিন্দু। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের পরে শ্রীহট্ট থেকে বৈষ্ণব ধর্মগুরুরা গিয়ে এদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করে। মিতেই দের সংখ্যা শহরে প্রায় ৮২%। আর মণিপুরের পাহাড় ঘেঁষা গ্রাম গুলোতে মূলত কয়েকশ বছর ধরে নাগা, মিজো আর কুকিরা বাস করে।
 কুকিরা মূলত নাগাল্যান্ডের উপজাতি। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা মিজো, কুকি ও নাগাদের বেশিরভাগ উপজাতি কে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করে। আর আছে মুসলিম এদের সংখ্যা ৮.৫% সারা রাজ্য। মণিপুরের রাজা ১০০০ মুসলিম সৈন্য বঙ্গ দেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের উত্তরাধিকারীরা মুসলিমদের মূল অংশ। মনিপুর রাজ্য ৪২.৪% হিন্দু ৪২.৩% খ্রিষ্টান আর ৮.৫% মুসলিম। তবে মিতেইরা বেশিরভাগ শহরে বাস করে।

 মিতেইরা মনে করে যে তাদের অঞ্চল কুকি,নাগা,মিজোরা অনুপ্রবেশ করে দখল করেছে। যা আংশিক সত্যি। তাই ছোটখাট জাতিভিত্তিক গন্ডগোল চিরকালই হয়। বড় গন্ডগোলও মিতেইদের সাথে কুকি বা নাগাদের হয়েছে। কিন্তু এতদিন এটা ছিল সম্পূর্ন জাতি ভিত্তিক। এমনিতে মিতেইরা ঠান্ডা প্রকৃতির ধর্মপরায়ণ জাতি। কয়েকশ বছর ধরে শ্রীহট্টর বাঙালিদের সাথে মিতেইদের সংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক। মণিপুরের ভাষার হরফ বাংলা হরফ। মিতেইদের ওপর বাঙালিদের প্রভাব কয়েকশ বছর ধরে। মিতেইরা শিক্ষিত জাতি ও প্রায় ১০০% হিন্দু বৈষ্ণব। কিন্তু এবার মিতেইদের সাথে কুকি বা নাগা বা মুসলিমদের গন্ডগোল কোন জাতি ভিত্তিক গন্ডগোল নয়। একে বারে ধর্ম ভিত্তিক গন্ডগোল। মণিপুরের জাতিসত্তা বজায় রাখতে কংগ্রেসের ও কমিউনিস্টদের একটা প্রধান ভূমিকা ছিল।
 কংগ্রেস তো এখানকার প্রধান দল ছিল আর কমিউনিস্ট বিশেষ করে সিপিআই এর একটা বড় সংগঠন ছিল। আর ছিল এমপিপি বা ওখানকার মনিপুর পিপলস পার্টি যারা জাতি ভিত্তিক রাজনীতি করত। কুকি ও নাগাদের রাজনৈতিক দল ছিল কিন্তু সব আঞ্চলিক ভিত্তিক। কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি আসার পরই শুরু হলো ধর্মভিত্তিক দ্বন্দ্ব। কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দের সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিজেপি ও আরএসএস মিতেইদের বোঝালো যে ওরা হিন্দু আর কুকি,মিজো ও নাগারা খ্রিষ্টান। বোঝালো যে একদিন খ্রিস্টানরা হিন্দুদের হটিয়ে মনিপুর দখল করে নেবে। সরলপ্রাণ মিতেইরা এটা বিশ্বাস করল আর একটা জাতিগত বিদ্বেষ সম্পূর্ন ধর্মগত বিদ্বেষে পরিণত হলো। মণিপুরের মানুষ নারীদের ভীষণ শ্রদ্ধা করে। ওখানে মহিলারা জাতির মূল চালিকা শক্তি। সেই মহিলাদের ধর্ষণ করে নগ্ন করে ঘোরানো মণিপুরের মিতেইদের সংস্কৃতির সম্পূর্ন পরিপন্থী ও আমার ভাবনার বাইরে।




 মার্কস বলেছিলেন ধর্ম মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে দেয় এটাযে কতটা সত্যি সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আজ মনিপুর তার জীবন্ত প্রমাণ। একটা হিন্দু বৈষ্ণব শান্ত শিক্ষিত জাতি ধর্মের ভাবাবেগে জন্তুতে পরিণত হয়ে গেল। এতদিনের গড়ে উঠা সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেল। বিজেপির ভোট রাজনীতি শুধু হিন্দু ভোটকে নিজের দিকে সংহত করতে ও কংগ্রেসের হিন্দু ভোট নিজের দিকে নিয়ে আসতে এরা মণিপুরের সব অংশের মানুষের বিরাট ক্ষতি করে দিল। এই ক্ষত শুকাতে কয়েক দশক লাগবে। একটা শিক্ষিত বৈষ্ণব ভাবধারায় বিশ্বাসী জাতিকে বিশ্ববাসীর সামনে ধর্ষক খুনীতে পরিণত করল। বিজেপির মতো দেশদ্রোহী পার্টি ভূ ভারতে তৈরি হয়নি। নিজের ক্ষমতা রক্ষা করতে এরা কতটা নীচে নামতে পারে মনিপুর তার একমাত্র প্রমাণ। আজ সুপ্রিম কোর্ট মণিপুরের ব্যাপারে একতরফা প্রক্রিয়া গ্রহণ করার ঘোষণা না করলে নরেন্দ্র মোদী সাংবাদিক ডেকে দুঃখের এই নাটক করত না। দুর্ভাগ্য ৭৮ দিন পর একটা গণধর্ষনের ব্যাপারে বিজেপি প্রশাসন মুখ খুললো বা খুলতে বাধ্য হলো। কারণ বিজেপি জানত হিন্দু ভোট সংহত করতে এই পুরো হিংসা,খুনের পটভূমি তাদের ও আরএসএস এর মস্তিষ্ক প্রসূত। এই গন্ডগোল চললে তাদের লাভ। ২০০২ সালে গুজরাট গনহত্যার পর ভারতে মণিপুরের মতো এত বড় গনহত্যা আর হয়নি। দুটো গনহত্যার পেছনেই বিজেপির মূল ভূমিকা। এই হলো বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার যে সরকার সরাসরি ধর্ম ভিত্তিক বা জাতি ভিত্তিক দাঙ্গা স্পন্সর করে। আজকের মনিপুর আমার কাছে সম্পূর্ন অচেনা। এ মনিপুর আমি দেখিনি এ মনিপুর আমি চাইনা। আমি আবার দেখতে চাই সেই মনিপুর যেখানে মিতেই,কুকি,মিজো,নাগা,মুসলিম সবাই একসাথে বাস করে। হিন্দু,খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মধ্যে কোন ধর্মগত বিবাদ নেই।
 চার্চ আর মন্দির পাশাপাশি সহাবস্থান। তবে বিজেপি সরকারে থাকলে এটা কখনই সম্ভব নয়। ক্ষমতার জন্য এরা ধর্মে ধর্মে জাতে জাতে  হানাহানি করবেই। এদের মূল শত্রু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই আবার বলব ২০২৪ সে বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন