আমি বহুদিন ধরেই একটা কথা বলি – "কাজ একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র। এই কাজ করতে করতে মরে যাওয়াটা একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র"।
শুনে আমার সহকর্মীরা হাসে। কেউ কেউ আমাকে পাগল বলে। কেউ বিশ্বাস করে না।
বিশ্বাস করুন, আমি একফোঁটা মিথ্যে বলিনা।
সভ্যতার গোড়ায় মানুষকে বেঁচে থাকতে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হতো। শুধু বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মানবসভ্যতার শুরুর থেকেই পথ চলা শুরু করেছে বিজ্ঞান, এবং তার ঘাড়ে চেপে প্রযুক্তি। প্রতি পদক্ষেপে তারা মানুষের কাজের বোঝা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে, কমিয়েছে মানুষের পরিশ্রম, পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা।
এর সাথে পুঁজি বা বাজারের বা অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিকষ স্বভাব। তাদের একমাত্র কাজ মানুষের জীবনকে সহজ করা, মানুষের পরিশ্রমের বোঝা লাঘব করা।
সেই সভ্যতার শুরু থেকে এই সহস্র সহস্র বছর মানুষের সাথে পথ চলে আজ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে তার উপকারিতার সমবণ্টন হলে পৃথিবীর মানুষের দিনে গড়ে দু'ঘন্টার বেশি কাজ করতে হওয়ার কথা নয়।
সত্যিই দরকার নেই। অবিশ্বাস্য শোনালেও সেটা সত্যি।
আমি আমার অজ্ঞতার ফলে পরিসংখ্যানটা বাড়িয়েও বলে থাকতে পারি, কারণ আমি বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ নই। আমি সঠিক জানিনা বর্তমানে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওই সময়টা দৈনিক দেড় ঘন্টা বা এক ঘন্টাও হতে পারে। আমি নিশ্চিত ওটা দু'ঘন্টার বেশি নয়।
কিন্তু তা হয় না। সমস্যাটা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে নয়। সমস্যাটা বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে। সমস্যাটা আমাদের ভাবনায়।
বুঝলেন না তো?
আচ্ছা, একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি। ধরুন একটা কারখানায় ১০০ জন শ্রমিক প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কাজ করেন। মানে দৈনিক ৮০০ ম্যান-আওয়ারের* কাজ হয়। মালিকের মুনাফা নিশ্চিত করতে ওটার প্রয়োজন।
এবার বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য সেই কারখানার মালিক নামমাত্র খরচে এমন একটা প্রযুক্তি সেই কারখানায় নিয়োগ করলেন যার ফলে ৪০০ ম্যান-আওয়ারের কাজ সেই প্রযুক্তি করে দেবে।
ফলে সেই ১০০ জন শ্রমিকের গড়ে দৈনিক ৪ ঘন্টা উদ্বৃত্ত হয়ে গেল, কিন্তু মালিকের মুনাফার পরিমাণ (প্রফিট মার্জিন) একই থাকলো।
ভাবুন এবার। ৪০০ ম্যান-আওয়ার উদ্বৃত্ত।
কি মনে হয়? মালিক কি করবেন? সেই ১০০ জন শ্রমিককে বলবেন যে এখন আর তোমাদের দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার দরকার নেই? তোমরা দিনে ৪ ঘন্টা কাজ করো আর বাকি বেঁচে যাওয়া ৪ ঘন্টা নিজের বউ বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, গল্পের বই পড়তে, বা নিছক ল্যাদ খেতে ব্যবহার করো?
ভাবতে পারছেন? সম্ভব এটা?
না, আমরা সবাই জানি সেটা সম্ভব নয়। মালিক ওই ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনকে ছাঁটাই করে দেবেন আর বাকি ৫০ জনকে বলবেন দিনে ৮ ঘন্টা কাজ চালিয়ে যাও।
এর ফলে তিনি বিজ্ঞান/প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে যে লাভটা এলো সেটা সম্পূর্ণ একাই ঘরে তুললেন। ওনার মুনাফার জন্য দরকারি ৮০০ ম্যান-আওয়ারের ৪০০ ম্যান-আওয়ার প্রযুক্তি দিয়ে দিল, বাকি ৪০০ ওই ছাঁটাই না হওয়া শ্রমিকরা। ৫০% শ্রমিকের চাকরি গেল, আর বাকি ৫০%কে সেই আগের মতোই দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে যেতে হলো।
সমস্যাটা এখানেই।
এই সমস্যাটাও সহস্র সহস্র বছর ধরে একই থেকে গেছে। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সমস্যাটা শুধু পুঁজির বা সম্পদের সমবণ্টনের নয়। সমস্যাটা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির থেকে লব্ধ উপকারিতার পুঁজির কুক্ষিগত হয়ে যাওয়াটাও। সমস্যাটা বহুমাত্রিক।
আজ পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তার উপকারিতার সমবণ্টন হলে সত্যিই মানুষকে গড়ে দিনে দু'ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। মানবসভ্যতার বাকি যা কাজ দরকার তা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি করে দেবে।
আমার আপনার অনেক সময় উদ্বৃত্ত হয়ে যাবে আমরা নিজেরা যা পছন্দ করি তার পেছনে দেওয়ার জন্য। পরিবারকে, শখকে, নেশাকে অনেক বেশি সময় দিতে পারব।
পাশ্চাত্যের সভ্য এবং সম্পদশালী দেশগুলোতে এই নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশেই শ্রম-সপ্তাহ এবং শ্রম-দিবস কমিয়ে আনা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কাজ করতে বাধ্য করাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
মাইরি বলছি, এক ফোঁটাও মিথ্যে বলিনি যখন বলেছি "কাজ একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র"!
শুধু আমাদের মতন নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদ-শাসিত দারিদ্র্য-জর্জরিত দেশেই ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে কাজ করতে করতে মরে যাওয়াটাই আমাদের অলঙ্ঘনীয় ভবিতব্য। এর বাইরে ভাবতে আমাদের শেখানো হয়নি।
আপনারা বরং আরেকটু পড়াশুনো করুন। আরেকটু ভাবুন। চোখগুলো খুলুন।
________________________________________
*"ম্যান-আওয়ার" কথাটা লোকের বোঝার সুবিধার জন্য ব্যবহার করলাম। নারীবাদী এবং জেন্ডার-অ্যাক্টিভিস্টরা ক্ষমাঘেন্না করে দিন। আমার পেশাদার ব্যবহারিক জীবনে আমি পার্সন-আওয়ারই ব্যবহার করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন