এই লেখা অনেককে অখুশি করবে জেনেও লিখলাম। কোন অসহিষ্ণু মন্তব্য করবেন না, দয়া করে।
দিনদুয়েক আগে উত্তরপ্রদেশে একটা ট্রেনের কামরায় গনপ্রহার ও ছুরিকাঘাতে একটি ১৬ বছরের বালকের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় সব কাগজেই খবরটা বেরিয়েছে। আমার বাড়ীতে Indian Express নেওয়া হয়, ওখানে খবরটা আছে। আর কয়েকটি কাগজেও খবরটা বেরিয়েছে এবং যদি যুক্তি দিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে বলতে হবে যে কেবলমাত্র আসন নিয়ে ঝগড়ায় কাউকে গনপ্রহারের মরতে হয়, এ অসম্ভব। অসহিষ্ণুতা ছাড়া এ ঘটনার অন্য ব্যাখা সম্ভব নেই। এই সংবাদটি আমি শেয়ার করার পর বেশীর ভাগ লোকই আমার প্রোফাইলে ঘটনাটার নিন্দা করেছে। তার মধ্যে একজন দেখলাম লিখেছে কাশ্মীরেও "একজন মুসলমান" পুলিশকে সন্ত্রাসবাদীরা মেরে ফেলেছে, কেন আমি তার নিন্দা করছি না। আর একজন লিখেছে, আমি নাকি নিজেকে আর পাঁচটা মুসলিমের থেকে আলাদা "প্রমান করার চেষ্টা করি" তাহলে এই "ফেক নিউজ" কেন শেয়ার করলাম। আমি বেশ কিছু প্রোফাইল খুলে দেখলাম আরো অনেকেই এই সংবাদটি শেয়ার করেছেন কিন্তু তাদেরকে কেউ এই পরামর্শ দিচ্ছেন না। কেন দিচ্ছেন না তার কারন অনুসন্ধান করলেই বুঝতে পারবেন কেন অসহিষ্ণুতা এই সমাজের অন্যতম প্রধান সমস্যা। তাই, পরামর্শটা আমাকে নয়, আমার নামকে দেওয়া হচ্ছে। কথা হল খবরটা যে ফেক তা প্রমান হল কিভাবে? সরকার কী কোন বিবৃতি দিয়ে বলেছে খবরটা মিথ্যা? একটা বাচ্চা মারা গেল গনপ্রহারে, প্রশাসন চুপ কেন? বোঝা যাচ্ছে, আরবী ভাষায় নাম হলে statutory warning ঝুলিয়ে রাখতে হবে। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে আরবী নামের কেউ মানুষ খুন করলেই তার নিন্দা করতে হবে, আরবী নামধারী কাউকে অন্য ধরনের নামধারী কেউ মারলেও চুপ করে থাকতে হবে। তাহলে প্রমান হবে যে লোকটি দেশভক্ত। এ না করলে "you exposed your true colour"!
আমি কাউকে জবাবদিহি করতে এসব লিখছি না। আমি যা ভাল মনে করবো তাই লিখবো ও বলবো। কে কী ভাবলো তা নিয়ে আমার তত মাথাব্যাথা নেই। ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে, এটা আমার নীতি। আমার অনেক ঘনিষ্ট বন্ধু আছে যারা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য। তারা সবাই খুব আ্যান্টি মুসলিম এমনও নয়। অনেক মুসলিম বন্ধু বিজেপি দলে কাজ করছেন- কিন্তু কারো সাথে মনোমালিন্য হয়েছে এমন ও নয়। তথাগতদার সাথে আমার যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে কিন্তু তাই বলে পরস্পরকে সমালোচনা করা যাবে না, এমন দাসখত কেউ লিখে দেয় নি।
যতক্ষন সমালোচিত ব্যক্তিকে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন পরিচিতি না দেওয়া হচ্ছে ততক্ষন পাব্লিক ডিবেটে কোন অসুবিধা নেই। সমস্যা হল যখন কোন একক পরিচিতি নিয়ে কোন সাধারন সূত্রে ফেলে বিচার শুরু হয়।
১৯৭৯ সালে আমি যখন কলকাতায় যখন পড়তে আসি বাঙলা ছাড়া কোন ভাষা জানতাম না। অনেকে আমাকে বলতো- তুই বাংলায় কথা বলছিস, উর্দুতে বলছিস না কেন? একদিন একটি ছেলে, নামটা মনে হয় রিয়াজ, আমাকে বলল- উর্দুতে কথা বল না তুমি কেমন মুসলমান? আমি তো কোনদিন মুসলমান হিসেবে বড় হই নি, তাই তখন এর মর্মার্থ বুঝতে পারি নি, যেমন এখনো বুঝতে পারছি না। কিন্তু, ১৯৯৯ সালে একটা ঘটনা আমাকে খুব আহত করে তুলেছিল। আমার একটা বাসস্থানের দরকার। অজয় ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে পি এন বি মোডে একটা বাড়ী দেখাতে নিয়ে গেলেন। সব কিছু যখন ঠিকঠাক তখন আমার নাম শুনে ভদ্রলোকের মুখ কালো হয়ে উঠল। বললেন- আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলে আসি। মিনিট পাঁচ পরে ভদ্রলোক বললেন- দেখুন আমার স্ত্রী পুজো আচ্চা করেন, আপনাকে ভাড়া দিতে আমাদের অসুবিধা আছে। আমরা আর কি করতে পারি, ওখান থেকে চলে এলাম। অজয়দা খুব লজ্জিত।
তারপর থেকে বহু চেষ্টা করে দেখেছি যে বিশেষ কিছু এলাকা ছাড়া বাড়ী ভাড়া পাওয়া যায় না। এসব কিছু নিয়েই জীবন।আমি বিশেষ গায়ে মাখি না। কিন্তু আমার মেয়েদের আমি ধর্মের আঁচ লাগতে দিই না। সব পালাপার্বনে অংশগ্রহন করি। যে মন্দিরে ধর্মীয় বিভাজন নেই সেখানে মন্দিরে ও যাই। একসময়ে চার্চে যেতাম বেশ নিয়ম করে। আমি বিশেষ ভাবে মনে করি যে, সমাজের এই যে বিভাজন তার জন্য সাম্প্রদায়িক আইন সবচেয়ে বেশী দায়ী। সবার জন্য একই আইন হলে অন্তত: ধর্মীয় বিভাজন এত স্পষ্ট হতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় নেতারা ভেবেছিলেন, মুসলিমরা যথেষ্ট পরিমান পরিনত নয় ও সবার জন্য একই আইন তারা গ্রহন করতে পারবে না। সেই যে "রেখেছো মুসলিম করে মানুষ করো নি", সেই বিষবৃক্ষের ফল এখন লাভ করছি। মুসলিম মানেই খারাপ এই ধারনার জন্য মুসলিমরাই বহুলাংশে দায়ী। তারা সাধারন শিক্ষায় তেমন আগ্রহী নয়, আলাদা ব্যক্তিগত আইন, আরবীয় নাম সবকিছুতেই নিজেদের আলাদা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস মানুষ মোটে ভালভাবে নেয়নি। কিন্তু এরা তা বুঝবে না। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও কাশ্মীর সমস্যাও মুসলিমদের সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা না জানে হিন্দুত্বের আদর্শ, না ইসলাম। রমজানের মাসে যে টুপি তারা পরে ভোট কেনে বছরভর সেই টুপিটাই বোকারামগুলোর মাথায় পরিয়ে কর্যোদ্ধার করে। এদেশের যত "সেকুলার" লিডার আছে, সবার পছন্দ সাম্প্রদায়িক মৌলভীদের- এই অশিক্ষিত ধর্মনেতারা সম্প্রদায়ের ও দেশের বারোটা বাজাক তারা ক্ষমতা নিয়ে খুশি। এক একটা ভোট আসবে আর দল বেঁধে সুপারি কিলার দিয়ে এলাকা দখল হবে। আসবে সাম্প্রদায়িক ঘেটোগুলো থেকে। যেকোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এসবই খুব অস্বস্তিকর। ব্যক্তির দোষে পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করতে শুরু করলে, এমন অবস্খার সৃষ্টি হয় যে, কেউ ভাবার চেষ্টা করে না যে সব মানুষই স্বতন্ত্র দোষগুণ নিয়ে জন্মায়। একই বাঁধাগতে কাউকে বিচার করা উচিত নয়। আমাদের পরিবারে ছোটবেলা থেকেই কখনো এসব শেখানো তো দূর অস্ত, হিন্দু পরিবারে আমাদের ব্যক্তিগত আত্মীয় স্বজন আছেন। তাই ধর্ম আমাদের জীবনের চালিকা শক্তি নয়। আমাকে অনেকে বলেছে, মেয়েদের বিয়ের সময় মজাটা টের পাবে। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, আমার অর্থের অভাব থাকতে পারে উদারতার অভাব নেই। আমার মা একবার আমাকে বলেছিল ( তখনো একথাগুলো racial abuse র মর্যাদা লাভ করে নি, joke করে বলা যেত) হাডী-ডোম-চণ্ডাল যা বিয়ে করবে তাকেই বরন করবো। আমার মতও তাই। কাবাব মে হাড্ডি আমার না পসন্দ, কে কোন ধর্মে বিয়ে করলো, অং বং চং বলল নাকি আরবী আওডাল তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই- আমার মেয়েদের তো নেইই। তা যাক, কথা হল- এসবের নিশ্চয় একটা সমাধান আছে। আমার মতে সমাধান হল আধুনিক শিক্ষা, সবার জন্য একই আইন, ওয়াহাবী সংস্কৃতির বদলে সুফিবাদের প্রসার। রাজনীতির লোকেরা যদি অশিক্ষিত মৌলবীদের পাত্তা না দেয় তো একাজটা অবিলম্বে হতে পারে। হিন্দু সমাজে পূজো আর বিয়ে ছাড়া পূজারীদের ভূমিকা তেমন নেই। মুসলিমদের ঠিক উল্টো- যে যত বড় মৌলবী, হিন্দু ধর্ম-নিরপেক্ষ নেতানেত্রীর কাছে তার বাজার দর তত বেশী। মনে আছে সিপিএমর নন্দীগ্রামে বুখারীকে দিয়ে জনমত ঘোরাতে চেয়েছিল। আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে ও রাজনীতির ক্ষেত্রটিকে ধর্মের পরিসরের বাইরে রাখার জন্য লড়তে হবে। এ দেশের শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ মানুষ কোন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পছন্দ করে না। কাজেই, মুসলিমরা এক পা এগোলে সেকুলার হিন্দু দশপা এগিয়ে আসবে এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন