আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের গ্রামগুলো থেকে যখন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জাহাজের খোলে গাদা করে নিয়ে আসা হতো, তখন তাদের মধ্যে অর্ধেকের কিছু বেশি জীবিত অবস্থায় আমেরিকা, কিউবা বা ক্যারীবিয়ান দ্বীপগুলোতে পৌছাতো। বাকিরা জাহাজের মধ্যেই মারা যেতো। তাদের মরদেহগুলো অতলান্তিক মহাসাগরের জলে ফেলে দেওয়া হতো। অতলান্তিকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত - এই লম্বা সমুদ্রযাত্রায় নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যে নাবিকরা মহিলা বন্দীদের লাগাতার ধর্ষন করতো। একবার আমেরিকায় পৌছানোর পরে পরিবারগুলোকে ভেঙে ফেলা হতো। বাবা, মা, সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া হতো আলাদা আলাদা মালিকের কাছে ক্রীতদাস হিসেবে। শ্বেতাঙ্গরা চিরকালই বুদ্ধিমান জাতি - তারা চেষ্টা করতো যাতে একই মালিকের কাছে এক পরিবার, এক গ্রাম, বা এক উপতাজির সদস্যরা বিক্রি না হয়। নিজেদের মধ্যে চেনাপরিচিত থাকলে, সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ করবার সম্ভাবনা বেশি। আলাদা আলাদা উপজাতির ভাষা আলাদা, এদের সদস্যদের বেছে বেছে আলাদা রাখলে নিজেদের মধ্যে কোনরকম যোগাযোগের মাধ্যম থাকবে না। কিছু কিছু মালিকের তাতেও ভয় যেতো না, তারা তাদের অধীনে সমস্ত ক্রীতদাসদের জীব কেটে দিতো, যাতে নিজেদের মধ্যে কথা না বলতে পারে। মালিকের প্লান্টেশনে এরা খাটতো, জীবনযাপন করতো, প্রেম করতো, বিয়ে করতো, আগামী প্রজন্মের জন্ম দিতো, তারপর দেখতো মালিক তাকে বেচে দিচ্ছে, চাবুক খেতো, গুলি খেতো। এত করেও এদের ইতিহাসকে মালিকরা মুছতে পারতো না। রাতের বেলায় সবাই জড় হতো আগুনের চারপাশে, আফ্রিকায় ফেলে আসা নিজেদের গ্রাম, নিজেদের দেব দেবী, নিজেদের ফেলে আসা মাটির প্রতি উৎসর্গ করতো নিজেদের। নেচে, গেয়ে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না, তাই অধিকাংশ শব্দ শুধু শব্দই থাকতো, কথা না। একটা কাঠের তক্তার দুপ্রান্তে পেরেক গেঁথে একটা তার বাধা, ফাঁপা কুমড়োর খোল, মুরগী বা ছাগল বা মানুষের হাঁড়, মাটির জগ, এই ছিলো বাদ্যযন্ত্র। সাথে ছিলো উদ্দাম নৃত্য আর গোঙানো। প্রতিদিন রাতে এই ভাবে তারা আমেরিকা থেকে পালিয়ে নিজেদের দেশ আফ্রিকায় ফিরে যেতো। এই আদিম সংগীতে আস্তে আস্তে কথা বসলো, সুর বসলো। মালিকদের ভাষাকেই আপন করলো ক্রীতদাসেরা। সেই ভাষাতেই নিজেদের গান লিখলো। ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা, বিচ্ছেদ পুরোটা উজার করে বন্দী করলো গানে। জন্ম নিলো 'ব্লুজ / Blues'।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলো। শ্বেতাঙ্গ মালিকদের নতুন অস্ত্র আবিষ্কার করতে হলো - ধর্ম। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠলো নিগ্রোদের জন্যে আলাদা চার্চ, সেখানে নিগ্রোরা শিখলো বাইবেল, যীশু, অহিংসা, আনুগত্য। এবং শিখলো গান। চার্চের হীম থেকে নিজেরা নিজেদের মতন তৈরি করে নিলো 'গোস্পেল মিউজিক'। আস্তে আস্তে নিগ্রোদের হাতে এলো ইউরোপিয়ান বাদ্যযন্ত্র। শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্যে বিভিন্ন জায়গায় বিনোদনকারী হিসেবে কাজ পেলো তারা। শিখলো পিয়ানো, গীটার, ড্রাম, ভায়োলিন। এবং Blues আর Gospel এর হাত ধরে Jazz আবিষ্কার হলো। যা গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে পৃথিবীকে মাতিয়ে রাখলো।
এর আশেপাশের সময়কালে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ভারত ভুখন্ড তখন ঘটনাবহুল জায়গা। ইউরোপ থেকে একে একে বিভিন্ন জাতি পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ছে এই দেশে। ইংরেজ, পর্তুগীজ, ফরাঁসী, ওলন্দাজ সবাই যাত্রা করছে ভারতের পূর্ব উপকূলে বাংলা নামক এক ভুখন্ডে। সেখানে একের পর এক অঞ্চল দখল করে নিজেদের পতাকা ওড়াচ্ছে, মানুষকে পরাধীন বানাচ্ছে। আর তাদের সাথে ঝাকে ঝাকে হাজির হচ্ছে আইরিশ এবং পর্তুগীজ ক্যাথোলিক পাদ্রী। তারা চার্চ তৈরি করছে গ্রামে গ্রামে। এরকমই কোন এক সন্ধিক্ষনে গ্রামের চাষীরা ভয়ে ভয়ে চার্চের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছে ভেতরে সন্ধ্যেপ্রার্থনার ক্যারল। তাদের গ্রাম্য লোকগীতির থেকে তা একেবারেই আলাদা। এবং শুনতে শুনতে কখন তাদের অজান্তেই তাদের লোকগীতির সাথে মিশে যাচ্ছে আইরিশদের লোকগীতি। ভারতের অন্য প্রান্তে তখন রাজস্থানের যাযাবর উপজাতি আস্তে আস্তে যাত্রা করছে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে দিয়ে ইউরোপের দিকে। এদেরকে কেউ বলে 'রোমা', কেউ বলে 'জীপসি'। ইউরোপে তখন আমেরিকা থেকে জ্যাজ সবে এসেছে। এই জীপসিদের হাত ধরে মিলছে একইসাথে তিনটে মহাদেশের সুর। রাজস্থানী লোকগীতির গন্ধওয়ালা Gypsy Jazz পাগল করে দিচ্ছে ইউরোপকে।
মস্কোতে এক শীতের সন্ধ্যায় লেনিন আর গোর্কি আড্ডা মারছেন। রেকর্ডে চলছে বীঠোভেনের Appasionata সোনাটা। লেনিনের চোখে জল। গোর্কি কে বললেন - 'জানো, বীঠোভেন যদি বাজানো বন্ধ না করতেন, তাহলে হয়তো আমি উঠে বিপ্লবটা শুরুই করতে পারতাম না।' হিটলার ওদিকে ঘোষনা করছেন - ' যে জার্মান ওয়াগনারকে অনুধাবন করতে পারে না, সে কোনদিন ন্যাশনাল সোশ্যালিজমকে বুঝতে পারবে না।' রিচার্ড ওয়াগনার। যার ' Ride of the Valkyries' এর নামের সাথে পরিচিত না থাকলেও বহু সিনেমার আবহসংগীত হিসেবে আপনার অতি চেনা সুর।
১৮৭১ সালে গোটা ইউরোপকে কাপিয়ে দিলো প্যারিস কমিউন। মাত্র তিনমাসের জন্যে প্যারিসের শাসনক্ষমতা চলে গেলো শ্রমজীবির মানুষের হাতে। তারপর সৈন্যদের হাতে ধ্বংস হলো কমিউন সরকার। কিন্তু আগামী কয়েক শতাব্দীর জন্যে লড়াইয়ের রসদ জুগিয়ে গেলো খেটে খাওয়া মানুষের চেতনায়। প্যারিস কমিউনের পরাজয়ের পর এই লড়াকু মানুষেরা ভাবলো, পৃথিবীর সব দেশের নিজস্ব anthem রয়েছে। আর আমরা যে দেশটার কথা ভাবি, কল্পনা করি, যার জন্যে লড়ি, যেই দেশের কোন সীমানা নেই, সমস্ত জাতি, সমস্ত ভাষাভাষির খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে যে দেশটা, যার অস্তিত্ব যত্ন করে রক্ষা করা রয়েছে আমাদের মগজ এবং হৃদয়ে, তার কি কোন নিজস্ব স্তবগান থাকবে না? গান লিখতে বসলেন প্যারিস কমিউনের সৈনিক Eugene Pottier. সুর দিলেন ছুতোর মিস্ত্রী Pierre De Geyter। তৈরি হলো 'The International' - আন্তর্জাতিক। অনুবাদ করা হলো পৃথিবীর সমস্ত ভাষায়। পৃথিবীর প্রতিটি কোনে আজও মানুষের লড়াইয়ের আবহসংগীত হিসেবে বেজে চলেছে - আন্তর্জাতিক!
আমেরিকায় একটি চার্চের সম্পূর্ন অচেনা গোস্পেল - যা ধর্ম নিয়ে লেখা - তা হঠাত গাওয়া হলো সাউথ ক্যারোলিনা খনিশ্রমিকদের স্ট্রাইকে। গানটার নাম 'We Shall Overcome'. আমেরিকাজুড়ে তখন একদিকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জোয়ার, অন্যদিকে কৃষাঙ্গদের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট কাপিয়ে দিচ্ছে একের পর এক শহরকে। আস্তে আস্তে সবার মুখে উচ্চরিত হলো এই গানটি। একে আরও জনপ্রিয় করে তুললো পিট সীগার এবং জোন বায়েজদের মতন শিল্পীরা, প্রতিটি জনসভা, মিটিং, পিকেট লাইনে তারা গাইতে লাগলো - আমরা করবো জয়। আস্তে আস্তে পুরো পৃথিবী শিখে ফেললো এই গানটি - 'আমরা করবো জয়'।
বিশ্ব সংগীত দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে। ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তীর গানের দুটো লাইন ধার করলাম আজকের জন্যে।
'গান হোক, আরও গান হোক,
গান হোক, সবাই সমান হোক,
আমাদের মন্দিরে আগামী সকালের আজান হোক।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন