কার্ল মার্ক্স্ ২০০ বছরে পড়লেন। বামপন্থীদের কাছে ব্যক্তির গুরুত্ব তার কর্মের ওপর নির্ভরশীল তাই মার্কসের জন্মের দ্বিশত বার্ষিকীতে তার কর্মের কথা বলা, আলোচনা করাই বামপন্থী প্র্যাকটিস।
১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হয় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। অর্থাৎ মাত্র ৩২ বছর বয়সে মার্ক্স্ এমন একটা চটি বই লিখে ফেলেন যা মানবসভ্যতার অভিমুখ বদলে দেয়। আমার বয়সও প্রায় একই, সেটা ভাবলে হাসি পায়। ম্যানিফেস্টো রচনা করার পেছনে কারণ কি সেটাও ম্যানিফেস্টোর শুরুতেই আছে। মার্ক্স্ বলছেন "গোটা ইউরোপ মহাদেশ ভূতের ভয় কাঁপছে, কমিউনিজমের ভূত। কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করলেই তাকে কমিউনিস্ট বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। আর উল্টোদিকে যাদেরকে কমিউনিস্ট বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে তারা প্রভূত সময় ও শব্দ খরচ করছে তাদের ওপর কমিউনিস্ট তকমাকে মিথ্যে প্রমান করতে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে গোটা ইউরোপের শাসক শ্রেণীর সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে কমিউনিজম অথচ বাস্তবে কমিউনিজম কি তাই নিয়ে কারুরই কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই, ছায়ার সাথে লড়ছে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের দায়িত্ব যে কমিউনিজম কি সেটা পরিষ্কার করে দৃপ্ত কণ্ঠে জানানো এবং যাঁরা সত্যি সত্যি কমিউনিজমের সাথে একমত তাঁদের নিজেদের কমিউনিস্ট বলে আত্ম ঘোষণা করা।"
ম্যানিফেস্টো নিয়ে দুটো কথা বলার আগে এটা বলা প্রয়োজন যে বেশিরভাগ মানুষ যা মনে করেন সেটা ঠিক নয়, ম্যানিফেস্টো শুধু মার্ক্স্ এবং এঙ্গেলস মিলে লেখেননি, বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ও মতামত গ্রহণ করে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রচনা করা হয়েছিল। যদিও অবশেষে যে রূপে সেটা প্রকাশিত হয় সেটা মার্ক্স্ আর এঙ্গেলসেরই রচনা। তা ছাড়া, বিষয়টা এরকম নয় যে মার্ক্স্ এবং এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখে ফেললেন এবং সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়ে গেলো আর দিকে দিকে বিপ্লব শুরু হয়ে গেলো। মাত্র ৩২ বছর বয়সে ম্যানিফেস্টো লিখে থাকলেও, মার্ক্স্ তাঁর বাকি জীবন অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ লিখে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মূল ভাবনাগুলোকে আরো ব্যাপ্ত করেছেন, জনপ্রিয় করেছেন। তা ছাড়া সারা জীবন রাজনৈতিক কার্যকলাপে সরাসরি যুক্ত থেকে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করেছেন। তবু এই একটি চটি বইয়ের গুরুত্ব ১৫০ বছর পরেও অমলিন। কেন?
এর খুব সহজ উত্তর হলো যে যে পরিস্থিতি আর যে উদ্দেশ্য নিয়ে ম্যানিফেস্টো লেখা হয়েছিল তা আজও সাংঘাতিক ভাবে বর্তমান। বহুবার বহু জায়গায় এই কথাটা শুনে থাকবেন তাই বেশি ব্যাখ্যা দেওয়া নিরর্থক। শুধু একটা পরিসংখ্যান দেব। ম্যানিফেস্টোতে মার্ক্স্ বলছেন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হলো মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ শেষ করতে বিপ্লব সংগঠিত করা। তা এহেন কমিউনিস্ট পার্টি কি ধরণের দাবি দাওয়া নিয়ে মানুষের কাছে বিপ্লবের প্রচারে যাবে? ম্যানিফেস্টো বলছে যে খুব সহজ একটা দাবি - সম্পত্তির ওপর ব্যক্তি মালিকানা বাতিল করতে হবে। এই একটা মূল দাবিকে সামনে রেখে এগোলেই হবে কারণ বুর্জুয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা টিঁকে আছে ব্যক্তি মালিকানার ওপর দাঁড়িয়ে, বুর্জুয়া রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য সম্পত্তির ওপর ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে রক্ষা করা। যেহেতু সর্বহারা শ্রেণীর ব্যক্তি মালিকানা বলে কিছু নেই তাই সর্বহারা শ্রেণী এই দাবির বিরোধিতা করবে না। চলে আসা যাক ১৬৫ বছর পেরিয়ে। ২০১৪ সালে ক্রেডিট সুইসের রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে ভারতের ধনী ১০% মানুষ ৭৪% সম্পত্তির মালিক এবং নিচের দিকে ৬০% মানুষ মাত্র ৭% সম্পত্তির মালিক। কিন্তু এই সম্পত্তি উৎপাদন এই ৬০% মানুষ ছাড়া অসম্ভব, শ্রম এবং পণ্যের বাজার এই দুটোই ৬০% মানুষ দিয়েই তৈরি। অর্থাৎ ৬০% মানুষের যেহেতু বিশেষ কিছু হারাবার নেই তাই সম্পত্তির ওপর ব্যক্তি মালিকানা তুলে দেওয়ার কথা বললে এদেরও হারাবার কিছুই থাকবে না। বোঝা গেলো কেন ২০১৭ তে দাঁড়িয়েও ম্যানিফেস্টো এতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ম্যানিফেস্টো পড়তে গিয়ে আরেকটা কথা বার বার মনে হয়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি দাঁড়িয়েও কতগুলো প্রচন্ড বৈপ্লবিক ধারণা এত দ্যার্থহীন ভাষায়, এতো সাহসিকতার সঙ্গে, এতো দৃপ্ত ভাবে ওখানে উচ্চারিত হয়েছিল বলেই বোধয় এতটা প্রভাব ফেলেছিলো মানুষের ওপর।
* সর্বহারার উৎপাদিত পণ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করেই বুর্জুয়ার বিপুল সম্পত্তি।
* সম্পত্তির ওপর ব্যক্তি মালিকানা তুলে দেওয়াই বিপ্লবের লক্ষ্য।
* সর্বহারার কোনো ধর্ম বা জাতি নেই, তাদের একটাই পরিচয় তারা সর্বহারা। ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়গুলো সর্বহারাকে বিভ্রান্ত করে শুধু। বুর্জুয়ারা সেটার সুযোগ নেয়।
* সর্বহারার কোনো দেশ নেই তাই দেশভক্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণও নেই। বিভিন্ন দেশের সর্বহারা শ্রেণী একে অপরের শত্রু নয়, তাদের সকলের শত্রু হলো বুর্জুয়া।
* সমাজের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা বুর্জুয়ার দালালি করে - ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক সকলেই। আইনসভা, আদালত, অথবা ধর্ম যাজকরাও তাই।
* পরিবারও একটা বুর্জুয়া ব্যবস্থা। সাম্যবাদ প্রতিষ্টিত হলে পরিবারেরও প্রয়োজন থাকবে না। সন্তানের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। পুরুষ এবং নারী সন্তানের লালন পালনের ভার থেকে মুক্ত হবে। ভালোবাসা ছাড়া তাদের সন্তানদের প্রতি কোনো দায় দায়িত্ব থাকবে না।
ভাবুন একবার। ১৫০ বছর আগে একটা রাজনৈতিক দল এগুলোকে তাদের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করছে দৃপ্তকণ্ঠে। কে তাদের দেশদ্রোহী বলবে, কে তাদের ওপর ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ তুলবে, কে তাদের ওপর পরিবার ব্যবস্থা শেষ করে দিয়ে উশৃংখলতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলবে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি।
এই সাহসিকতার হয়তো আজকের দিনে প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সার্বিক ভাবে রক্ষণশীলতার জয় জয়কার চলছে তখন একদম পরিষ্কার ভাবে মানুষের কাছে একদম বিকল্প একটা রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা তুলে ধরা দরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন