রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬

কালো টাকা ~ সুশোভন পাত্র

আইজাক স্যার বলেছেন, 'বাইরের থেকে বল প্রয়োগ না করলে, স্থির বস্তু চিরকাল স্থির এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল গতিশীল থাকবে'। আর বাজারে না খাটিয়ে, ব্যবসা তে না লাগিয়ে ঘরে পুঁতে কিম্বা তোয়ালা মুড়ে লুকিয়ে রাখলে কালো টাকাও চিরকাল কালোই থাকবে। স্থিরই থাকবে। ধারে, ভারে তো বাড়বেই না, বরং মুদ্রাস্ফীতির কালগর্ভে আজকের ষোলআনা দু'দিন পরে বারো আনা হয়েও আপনার কপালে নাচতে পারে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে অর্থনীতির এই মৌলিক সত্যটা অনুধাবন করেই ঐ দাড়িওয়ালা বুড়োটা লিখেছিলেন, 'পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজি জমিয়ে নয় বরং বাজারে খাটিয়েই মুনফা লাভ হয়।' এই জন্যই দেশের কালো টাকার বেশির ভাগটা আজ সিনেমার চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যের রহস্য উন্মোচনের জন্য কোন ভিলেনের ঘরের নিচে লোকানো নেই। বরং আছে একেবারে আপনার চোখের সামনে। আছে রিয়েল এস্টেট বিজনেসের ইটে, আছে সিমেন্ট গাঁথা অট্টালিকা সেজে, আছে নিউক্লিয়ার ডিলের আস্থা ভোটে বিরোধী সাংসদ কিনে সরকার বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে, আছে বাংলার মানুষের নির্বাচিত পঞ্চায়েত ভেঙ্গে দেবার শাসক দলের ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে, আছে নেত্রীর আঁকা ছবি ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পার্টি তহবিলে পৌঁছে দেবার কৌশল হয়ে, আর আছে 'হাওলা'র মত কতশত চ্যানেলে ঘুরে বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা হয়ে।  

কালো টাকা মানে শুধু লুকানো টাকার জমে থাকা ভাণ্ডার নয়। কালো টাকা মানে যেকোনো কর ফাঁকি। কালো টাকা মানে যেকোনো অনুমোদিত সীমার বাইরে লেনদেন। ঐ যে মেজিয়ার কয়লা খাদানে ১০০টন কয়লা তুলে খাতায় কলমে ৮০টনের হিসেব দেখালেন -কালো টাকা। পুলিশ কে ঘুষ দিয়ে নদী থেকে দু গাড়ি বালি বেশী তুললেন -কালো টাকা। কালীঘাটের জাগ্রত দেবী কে সন্তুষ্ট রাখতে ভাইদের তোলা দিলেন -কালো টাকা। পার্টি ফান্ডের ১লক্ষর অনুদানে কুড়ি হাজারের রশিদ কাটলেন –ওটাও কালো টাকা। আসলে কালো টাকায় কোন কালো দাগ নেই, আইডেন্টিটি ফিকেশন মার্ক নেই। তাই আপনি হয়ত কালো টাকা দেখছেন প্রতিদিন, হাতেও নিচ্ছেন প্রতিদিন, কিন্তু চিনতে পারছেন না।

আনুমানিক ভাবে, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট এবং কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের ৮ তারিখের প্রেস বিবৃতি অনুসারে দেশের মোট কালো টাকা পরিমাণ দেশের জি.ডি.পি'র এক চতুর্থাংশের সমান। অর্থাৎ ২০১৫'র পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জি.ডি.পি যদি হয় ১২৬.৫ ট্রিলিয়ন, তাহলে ঐ সরল ত্রৈরাশিকেই কালো টাকা ৩৫ লক্ষ কোটি। এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৫-১৬'র বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী বাজারে নগদ ৫০০ টাকার নোট রয়েছে ১৬৫০ কোটি। আর ১০০০ টাকার নোট ৬৭০ কোটি। যার সম্মিলিত অর্থমূল্য ১৭ লক্ষ কোটির একটু বেশী। সেই টাকারও এক চতুর্থাংশ কালো টাকা ধরে সহজ হিসেবে কষলে, এই নোট বাতিল করার সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ ৪ লক্ষ ২৫ হাজার কোটির কালো টাকা উদ্ধার হতে পারে। আবার ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোটের মাধ্যমে বাজার থেকে তুলে নেওয়া অর্থের সম পরিমাণ অর্থ ২০০০ টাকার বা ৫০০ টাকার নতুন নোট ছেপে বদলে ফেলার খরচাও প্রায় ১২ হাজার কোটি। সুতরাং, সবের ধন নীলমণি হয়ে পড়ে রইলো আনুমানিক ৪ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি। যা দেশের মোট কালো টাকার মাত্র ১৩%। বাকি ৮৭% কিন্তু যেমন ছিল তেমনই রইলো। রইলো ২৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বৃহৎ কর্পোরেট'দের বকেয়া ১.১৪ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণে, রইলো রেভেনিউ ফোরগেনে'র নামে প্রতিবছর বিগ বিজনেস হাউসগুলোকে ছাড় দেওয়া কর্পোরেট ট্যাক্সে, রইলো আর্থিক কারচুপি করে লন্ডনে বসে থাকা বিজয় মালিয়া, ললিত মোদী'দের পকেটে, আর রইলো সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে।  

এই সত্যিটা প্রধানমন্ত্রীও বিলক্ষণ জানেন। আর জানেন বলেই, ২০১৩'তে গোয়ার বিলাসবহুল হোটেলে বিজেপি'র পার্লামেন্টারি বোর্ডের মিটিং-এ প্রধানমন্ত্রী পদের মনোনয়ন পেয়েই তিনি টুইট করেছিলেন "দেশের একটা বাচ্চা ছেলেও জানে কালো টাকা আছে সুইস ব্যাঙ্কে। আমাদের কি সেটা ফিরিয়ে আনা উচিত নয়?" প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ এটাও জানেন যে শুধু নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সেই সুইস ব্যাঙ্কের এক ছটাক টাকাও দেশে ফিরে আসবে না। দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষাপটে কালো টাকার রমরমাও ম্লান হবে না। আসলে নোট বাতিল তো ১৯৪৬'এ কিম্বা ১৯৭৮'র জানুয়ারি'তেও হয়েছিল। কিন্তু কালো টাকা'র এই বাড়বাড়ন্ত থামেনি। বরং অর্থনীতির বেহাল অবস্থার খেসারৎ চুকিয়ে পরের সাধারণ নির্বাচনে গো-হারা হয়েছিলো মুরাজি দেশাই'র জনতা সরকার।  

তবুও বেশ হয়েছে নোট গুলো সব বাতিল হয়েছে। আমাদের দু-একদিনের কষ্টে যদি দেশের প্রাসাদসম কালো টাকার কিঞ্চিতও ফিরে আসে, তাহলে না হয় তাই আচ্ছা। গোরু তে ৮০% মানুষের জিন খোঁজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিন যদি জাল নোটের ব্যাপারীদের খুঁজতে বসেন, তাহলে তাই আচ্ছা। 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'র চ্যাংড়ামি করা হিন্দু নেতা, আর তিন তালাকের সমর্থনে ভাষণবাজি করা মৌলবি গুলো যদি একদিন ব্যাঙ্কের লাইনে গা ঘেঁষে রিকুইসিট ফর্ম ভরেন, তো তাই আচ্ছা। অ্যালিস্টার কুকের টিমের বিরুদ্ধে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধে উদ্যত গোটা দেশবাসী একদিন যদি রাজনৈতিক দল গুলোর আয়ের উৎস জানতে চেয়ে বসে, তাহলে তাই আচ্ছা। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শত নামজপা ছেড়ে একদিন যদি নিতাই মেলায় অর্থনীতির তর্কের তুফান ওঠে, তো তাই আচ্ছা। কালো টাকার 'হ্যাভ আর হ্যাভ নটসে' দেশটা যদি একদিন আড়াআড়ি ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে তাই আচ্ছা। মানুষ যদি ভাবতে শেখে ধর্মের বিভেদ নয় তাঁদের এক সুতোয় বেঁধেছে তাঁদেরই পেটের খিদে, তাহলে তাই আচ্ছা। এই সংখ্যালঘু শাসকদের সঙ্গে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষ গুলোর একদিন...একদিন যদি 'ভীষণ রাগে যুদ্ধ বাঁধে', তাহলে না হয় তাই আচ্ছা। সেদিন নাজিবরা আর ২৮ দিন ধরে নিখোঁজ থাকবেনা সেনোরিটা, সেদিন হয়ত নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্যানিকে প্রত্যন্ত গ্রামের তীর্থরাজিরা আর মরবে না সেনোরিটা , সেদিন হয়ত "বড়ে বড়ে দেশো ম্যা অ্যাসি ছোটি ছোটি বাত" আর একটাও হবে না সেনোরিটা…

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন