মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩

ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

কাঁথি হাসপাতালের নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে একটা কোর্সের পরীক্ষা ছিল। শেষবেলায় সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যখন ঘরে ফিরে আসছি তখন চোখে পড়েছিল একটি দৃশ্য। অতি সাধারণ। ওই কোর্সের এক ছাত্রীকে নিতে এসেছে তার স্বামী আর তার কিশোরী মেয়ে স্কুটার নিয়ে। 

ওই কোর্সের অনেক ছাত্রীই বিবাহিত, সন্তানের মা কারণ ওটা ছিল ইন সার্ভিস কোর্স। চাকরি করতে করতে ছুটি নিয়ে পড়া। সংসার সামলে, স্বামী, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করে ছাত্রী সুলভ টিপিক্যাল বয়েস পেরিয়ে এসেও অনেকেই যে অখন্ড মনযোগ সহকারে লেখাপড়াটা করলেন, থিওরি প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন তাদের চেয়ে অনেক ছোট সহপাঠিনীদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের কথাই আজ মনে পরে গেল কারণ আজ এক বিশেষ মহিলার জন্মদিন।

ঠিক কবে থেকে ওই মহিলা মানে কাদম্বিনী বসুর চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল সেটা জানতে পারিনি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি যে ১৮৮২ সালে উনি এফ এ পাশ করার পরেই ডাক্তারি পড়ার চেষ্টা করেন কিন্তু গ্র্যাজুয়েট না হওয়ার কারণে সুযোগ পাননি। এর পরে ১৮৮৩ সালে বি এ পাশ এর মধ্যে উনি প্রেম করে বিয়ে করেছেন নিজের থেকে ১৭ বছরের বড় বিপত্নীক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে। বিয়ের সময় দ্বারকানাথের দুই সন্তান, কন্যা বিধুমুখী আর পুত্র মানসিক প্রতিবন্ধী সতীশচন্দ্র। চিকিৎসক হওয়ার সেই অদম্য ইচ্ছে কিন্তু কমে নি। 

বি এ পাশ করার পরে আবার আবেদন করেন। 
মেডিক্যাল কাউন্সিল আপত্তি করে। বিদেশি শাসকের আমলাতন্ত্রের আপত্তির কারণ তবু কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কিন্তু এর সাথে দেশীয় লোকজনও হৈ চৈ শুরু করে। একটি মেয়ে ডাক্তারি পড়বে এমন অনাসৃষ্টি কান্ড তারা সহজে মেনে নেয় নি। মেডিক্যাল কলেজের একজন বাঙালি অধ্যাপকের তো ঘোর আপত্তি ছিল। 

বাজারী পত্রিকায় ২রা জুলাই, ১৮৮৩ সালে ওইসব আপত্তিকে তাদের বিবেচনায় "যুক্তিসঙ্গত" আখ্যা দিয়ে লেখা হল, "শ্রীমতি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (বসু?) বি. এ. কলিকাতার মেডিকেল কালেজে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। মেডিকেল কালেজের অনেক শিক্ষক কয়েকটি প্রধান কারণ দর্শাইয়া স্ত্রীলোকদিগের উক্ত কালেজে প্রবিষ্ট করিবার সম্বন্ধে আপত্তি করেন। তাঁহারা বলেন, উক্ত কালেজে ছাত্র দিগের রাত্রিতে যখন কালেজে থাকিতে হয়, তখন দুইজন করিয়া ছাত্র একঘরে থাকে। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীলোক কিরূপ করিয়া পুরুষের সহিত এক ঘরে থাকিবে। এবং যখন ছাত্রদিগকে পুরুষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বুঝাইয়া দিতে হয়, তখন পুরুষ শিক্ষক স্ত্রীলোকদিগকে কিরূপে উহা বুঝাইয়া দিবে। আরও অন্যান্য আপত্তির মধ্যে উক্ত কালেজের একজন ছাত্র বলেন যে নিয়ম আছে সমস্ত বক্তৃতাতে উপস্থিত না থাকিলে, পরীক্ষা তে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এবং যদি এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে কোন রমণীর গর্ভ হয়, তবে প্রসবকালীন তিনি কি করিয়া বক্তৃতায় উপস্থিত থাকিবেন ?"

এর বিপরীতে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখ আন্দোলন করেন। এসব জানার পরে ছোট লাট রিভার্স অগাস্টাস টমসনের হস্তক্ষেপে মেডিক্যাল কাউন্সিল তাদের আগের সিদ্ধান্ত পাল্টে কাদম্বিনীকে ভর্তির অনুমতি দেয়। বাধা বিপত্তি এড়িয়ে ভর্তি হয়েও বিপদ কাটেনি। কিছু পরীক্ষকের রোষে (সম্ভবত ওই বাঙালি চিকিৎসক অধ্যাপক ও ছিলেন তার মধ্যে) কাদম্বিনী মেটিরিয়া মেডিকা ও এনাটমিতে ফেল করেন। তাঁকে গ্রেস নম্বর দিয়ে পাশ করানো হয়। 

এই গ্রেস দেয়া নিয়েও পত্রিকা লেখে, "শ্রীমতী গঙ্গোপাধ্যায় মেটিরিয়া মেডিকা ও এনাটমিতে ফেল হন। এখন শুনিতেছি সিন্ডিকেটের দয়ায় তিনি এ পরীক্ষায় পাশ করেন" 

এই আপত্তিকর "দয়া" শব্দটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটা আমরা এক্ষুনি দেখবো। ১৮৮৮ সালে কাদম্বিনী গ্রাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ উপাধি পেয়ে কলেজ থেকে বের হন। এর পরে ১৮৯২ সালে স্বামী পুত্র কে বাড়িতে রেখে বিলেত যান আর ১৮৯৩ সালের মধ্যে এডিনবরা থেকে LRCPL এবং LRCS আর গ্লাসগো থেকে LFPS এই তিন খানি ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। 

কোনোভাবে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল কাদম্বিনী (গঙ্গোপাধ্যায়) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।।১৮৮৮ সালের  ২০শে ফেব্রুয়ারি তিনি তার এক বন্ধুকে লিখছেন:-

"তুমি মিসেস গাঙ্গুলি সম্পর্কে কিছু জানো, আমায় কিছু পরামর্শ দিতে পারবে ? এর মধ্যেই ওই মহিলা সেই পাশ করে ফেলেছেন যাকে বলে মেডিসিন আর সার্জারিতে ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট এর পরের মার্চে ফাইনাল এক্সামে বসছেন। এই ইয়াং লেডি, মিসেস গাঙ্গুলি নাকি বিবাহিত ! বিয়ের পরেই নাকি উনি ডাক্তার হবেন বলে মনস্থির করেন ! আর ওনার না কি একটি নয়, দুটি ছোট বাচ্ছা আছে ! ইনি বাচ্ছা হওয়ার পরে মাত্র তেরো দিন শুয়ে ছিলেন, একটাও লেকচার ক্লাশ না কি মিস করেন নি।"

মিস নাইটিংগেল নিজে একজন মেয়ে হয়ে বুঝতেন যে বিয়ের পরে, মা হয়ে যাওয়ার পরে, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া, মেয়েদের পক্ষে কত কষ্টকর। তাও আবার সেই সময়ের ভারতে, বাংলাদেশে। তাই তার ওই ছোট্ট চিঠিতে বিস্ময়বোধক চিহ্নের এতো ছড়াছড়ি। সেই বিস্ময় বোধ থেকে জন্ম নেওয়া মুগ্ধতা, সে থেকে জন্ম নেওয়া শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, উনি লেডি ডাফরিন কে সুপারিশ করছেন বাংলা তথা ভারত তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার এর একটা চাকরির জন্য, "ফর এনি পোস্টস এবাউট দ্যা ফিমেল ওয়ার্ড অফ ক্যালকাটা।

কাঁথি হাসপাতাল চত্বরের সেই পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দেখা দৃশ্যটা আজও মনে পরে। শিক্ষক নয়, একটু আগের পরীক্ষক নয়, আমি তখন নিছক দর্শক। আমাদের ওই ছাত্রীটি স্কুটারের কাছে গিয়ে মেয়ের গাল টিপে একটু আদর করে চেপে বসল স্বামীর পেছনে। কোমরটা একটু জড়িয়ে। দ্বারকানাথ আর কাদম্বিনীর যুগলমূর্তি এগিয়ে গেল গেটের দিকে। 

বিশ্বাস করুন, সেকালেও সহজ ছিল না, আজও সহজ নয়, খুব, খুব কঠিন কাজ। কাদম্বিনীদের প্রেরণা হয়ে ওঠার কাহিনীগুলো মনে রাখাটা তাই জরুরী আমাদের কাছে। কাদম্বিনীরা আমাদের আসে পাশেই আছে, চিনে নিতে হবে শুধু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন