মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩

সুবোধ রায় ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ার কিশোর সুবোধ বরাবরই সূর্য সেনের ভক্ত ছিল। নিজে ভাল ছাত্র। ব্যারিস্টার বাবা স্বপ্ন দেখতেন, ছেলেকে অক্সফোর্ডে পড়াবেন। কিন্তু সুবোধ জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে। মাত্র চোদ্দো বছরের আদরের মাসতুতো ভাইটিকে কল্পনা দত্ত মাস্টারদার কাছে হাজির করিয়েছিলেন। কিশোরটি মুহূর্তের মধ্যে উৎসর্গীকৃত বিপ্লবী সেনানীতে রূপান্তরিত।

জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সবার আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এই সুবোধই। অকথ্য অত্যাচার করেছিল পুলিশ। ছোট্টখাট্টো চেহারার সুবোধ কে ক্রমাগত কিল চড়, লাথি, ঘুঁষি। ইন্টারোগেশন রুমের এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে ধাক্কা, যেন ফুটবল বানিয়ে খেলা। কিন্তু সঙ্গীদের হদিস সুবোধের মুখ থেকে বার করা যায়নি। আন্দামানের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল ওঁকে।

কারাভ্যন্তরেই যৌবনের উন্মেষ, সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া। জেল কুঠুরির চার দেওয়ালের মধ্যে চর্চা হচ্ছে হাতে লেখা, লুকিয়ে আনা ঝাপসা হয়ে যাওয়া লেনিনের "রাষ্ট্র ও বিপ্লব", কমিউনিস্ট ইশতেহার এসব মার্ক্সবাদী সাহিত্যের। তর্ক, বিতর্ক, আলোচনায় সুবোধ রায়ের নিজের ভাষায় "জীবন শিখিয়ে দিচ্ছে সেদিন থেকেই, জীবনের কাছে শিখছি, এভাবেই কম্যুনিস্ট হিসেবে বেড়ে ওঠা।"

ছাব্বিশ বছর বয়সে মুক্তিলাভের পর মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে প্রবেশ। প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করেননি, ফলে চাকরিও করা হয়নি। পার্টির কাজেই সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ হল অকৃতদার সুবোধের। আলিমুদ্দিনে পার্টি অফিসেই একটা ঘরে থাকতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতা নিতেন না, অসুস্থ হওয়ার পরে চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যও নেননি।

অশোক মিত্রের ভাষায় "অনবচ্ছিন্ন সাড়ে ছয় দশক ধরে সুবোধ রায় পার্টির সব সময়ের সাধারণ কর্মী-ই থেকে গিয়েছিলেন। আদর্শনিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রিত জীবন, কোনও দিন স্বার্থচিন্তা করেননি, সংসারে গুছিয়ে বসার কথা ভাবেননি, সর্বক্ষণের দলীয় কর্মী, দলীয় দফতরই দশকের পর দশক জুড়ে তাঁর আশ্রম তথা জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বরাবরের মন্ত্র: সম্ভোগ নয় সংবরণ। কর্মী থেকে নেতৃত্বে পৌঁছবার বাসনাবিহীন। সাধ্যের প্রত্যন্তে গিয়ে দলীয় সংগঠনের কাজে কর্তব্য সম্পাদনে প্রতিনিয়ত তাঁর অধ্যবসায়। 

শেষ বছরগুলি পর্যন্ত নিজের জামাকাপড় নিজে কেচেছেন, রোদে মেলেছেন, ইস্ত্রি করেছেন। যে ঘরে থাকতেন, নিজেই ঝাড়তেন, পুঁছতেন, জীবন নির্বাহের অতি সামান্য যে ক'টি উপকরণ, আশ্চর্য নিপুণতায় গুছিয়ে রাখতেন। নিজের জন্য ন্যূনতম রান্না সাধারণত নিজেই করতেন, অন্যথা মাঝেমধ্যে দলীয় কমিউনে আহার্যের সামান্য চাহিদা মেটানো। 

কৃচ্ছ্রসাধনায় দৃঢপ্রতিজ্ঞ, অন্তরঙ্গতর অনুরাগীরা কখনও-সখনও একটু-আধটু উপহারসাগ্রী তাঁকে পৌঁছে দিতেন, বিব্রত সুবোধ রায় বিপন্নতার সঙ্গে তা গ্রহণ করতেন, দু'দিন বাদে অনুরাগীদের মধ্যেই ফের বিলিয়ে দিতেন।

মানুষটি বরাবর আত্মপ্রচারের বাইরে থেকেছেন। যাঁদের পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে ডেকে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের রোমাঞ্চকর বিভিন্ন কাহিনি শোনাতে ভালবাসতেন। সর্বস্তরের সকলের সঙ্গে নয়, ঈষৎ নিচুতলার দলীয় কমরেডদের সঙ্গেই তাঁর নিবিড়তর সখ্য, যাঁরা দলের গাড়ি চালান, যাঁরা ঘরে ঘরে কাগজপত্র বা চা-মুড়ি পৌঁছে দেন, যাঁরা অপেক্ষাকৃত উঁচু মহলের নেতাদের নির্দেশাদি পালন করেন, ইত্যাকার কমরেডদের নানা সমস্যা মেটাতে সুবোধ রায় অহরহ ব্যস্ত।

পাশাপাশি দলীয় দফতরে অনেক খুঁটিনাটি সাংগঠনিক দায়িত্বও তাঁকে সামলাতে হয়েছে। জেলা দফতরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, বিনিময়-প্রতি-বিনিময়, কিংবা কেন্দ্রীয় দফতর বা অন্যন্য রাজ্য দফতরের সঙ্গে চিঠিপত্রের মধ্যবর্তিতায় সেতুবন্ধনের কাজ। দীর্ঘ দশকগুলি জুড়ে পার্টি অনেক ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, বিভিন্ন ঋতুতে মতাদর্শের অনেক টানাপোড়েন, অঢেল তর্ক-বিতর্ক, পঁয়ষট্টি বছর ধরে সুবোধ রায় অনেক ইতিহাস তৈরি হতে দেখেছেন। অনেক নেতার উত্থান দেখেছেন, তাঁদের প্রস্থানও পর্যবেক্ষণ করেছেন।

দলের ভাবাদর্শ ও কর্মসূচির অবৈকল্য রক্ষায় তাঁর ইস্পাতকঠিন মানসিক দার্ঢ্য। কিন্তু কর্মী থেকে নেতাতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবৃত্তি তাঁর কদাপি ছিল না। দলের শৃঙ্খলা থেকে কোনও দিন বিচ্যুত হননি, কিন্তু স্পষ্টবাদিতায় তাঁর জুড়ি নেই, ছোট-মাঝারি-বড় নেতাই হোন, কিবা নেতৃত্বে তখনও পৌঁছয়নি কিন্তু পৌঁছুতে আঁকুপাকু করছেন, কারও আদর্শগত বা আচরিক স্খলন তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে সরবে সমালোচনা করেছেন। তাঁকে তাঁকে তাই ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না অনেকেই। দলের মধ্যে ক, খ বা গ তরতর করে সোপান বেয়ে উন্নতি ও মর্যাদার বেলাভূমিতে পৌঁছে গেছেন। সুবোধ রায় একা পড়ে থেকেছেন। তাঁর হাঁটুর বয়সিরা দ্রুততার সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন, দলের মধ্যে কেষ্টবিষ্টু বলে বিবেচিত হয়েছেন, তাঁরা ফরমান জারি করেছেন, দলীয় অনুশাসন মেনে সুবোধ রায় সেই ফরমান মান্য করে নিজের কর্তব্য নিঃশব্দে পালন করে গেছেন।

এমনি করেই একটা গোটা জীবন অতিবাহন। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বীর যোদ্ধা, পার্টির অন্যতম প্রাচীন সদস্যদের এক জন। বহু বছর ধরে দলীয় ইতিহাস ধাপে-ধাপে সুশৃঙ্খল লিপিবদ্ধ করেছেন, কয়েক খণ্ডে যা প্রকাশিত হয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তা হলেও দলের এক জন নিতান্ত সাধারণ কর্মী, নতুন প্রজন্মের দলীয় সদস্যরা তাঁর পরিচয় জানেন না, তাঁদের কাছে নিতান্ত হেজিপেঁজি কে এক জন বৃদ্ধ পার্টি দফতরে ঘাড় গুঁজে কর্মরত। তাঁর কোনও দাবিদাওয়া নেই, তাই তাঁর আলাদা আদর সম্ভাষণও নেই।"


অনেক শৌর্যের, অনেক মৃত্যুবরণের অধ্যায় পেরিয়ে বিপ্লবের প্রদীপ্ত শিখা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এলো। নব্বই বছর বয়স অতিক্রান্ত, অবশেষে সুবোধ রায় জড়ার শিকার হলেন। রোগগ্রস্ত অবস্থায় কলকাতাস্থ একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হল। তাঁর জন্য পাঁচতারা হাসপাতালের ব্যবস্থা করার প্রশ্ন ওঠে না, নিজেও সেটা অবশ্যই ঘোর অপছন্দ করতেন। এসএসকেএম হাসপাতালের নিরাবরণ মৃত্যুশয্যায় শুয়েও বলেছিলেন, "চট্টগ্রাম বিদ্রোহ আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।"

সাল ১৯৩০, আজকের দিনে, ১৮ই এপ্রিল, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে রাত দশ টায় যুব বিদ্রোহের সেই জিরো আওয়ার, মাহেন্দ্রক্ষণ। "কম্যান্ডার" সূর্য সেন এর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির দামাল ছেলে মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার এর দখল নিতে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শুরু হবে। তারপরে জালালাবাদের পাহাড়ে কম্যান্ডার এর নেতৃত্বে অন্য সাথীদের সাথে ১৪ বছরের কিশোর সুবোধ গড়ে তুলবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সেই ব্যারিকেড।

আজ আবার ১৮ই এপ্রিল। কমরেড সুবোধ রায়কে স্মরণ করার দিন। তার বিপ্লবী তেজের উত্তরাধিকারকে নিজের রক্তে অনুভব করার দিন। আধা ফ্যাসিবাদী আর ফ্যাসিবাদী সমস্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রক্ত পতাকা হাতে নতুনভাবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলার শপথ গ্রহণের দিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন