করোমণ্ডল নামটা প্রথম শুনি ক্লাশ টু-তে পড়াকালীন। দিদি ভূগোলে পড়তো, ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের নাম কঙ্কন এবং মালাবার উপকূল, আর পূর্ব উপকূলের নাম করোমণ্ডল উপকূল। তার পরের বছর চাকরিসূত্রে বাবা মাদ্রাজে চলে আসেন, তখন জানতে পারি ওই নামে একটা এক্সপ্রেস ট্রেনও আছে! কে জানে কেন, পাঠ্য পুস্তকের লেখক সান্যাল-চ্যাটার্জী, বা কুণ্ডু-দাশ-কুণ্ডুর আদলে ভেবে নিয়েছিলাম, ট্রেনটির মালিক দু'জন, কর ও মণ্ডল।
ওই ট্রেনে প্রথম চড়বার সুযোগ আসে ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে। মনে আছে, সেই বছর দু'বার দুর্গাপুজো পড়েছিল, একবার সেপ্টেম্বরে, একবার অক্টোবরে। দুটো পুজো মিলিয়ে ছুটি ছিল বেশ বড়। আর তখনই আমরা ট্রেনে চেপে এসেছিলাম মাদ্রাজ। আমরা মানে মা, দিদি আর আমি। বাবা তো অগষ্ট থেকেই মাদ্রাজবাসী। সেও এক মজাদার অভিজ্ঞতা। তখন অনলাইন রিজার্ভেশন ছিল না, কয়লাঘাটের কাউন্টার থেকে আমাদের টিকিট কাটা হয়েছিল। বেশ হতাশ হয়েছিলাম। এ বাবা, এ তো আমাদের মামারবাড়ি জয়নগর-মজিলপুর যাওয়ার টিকিটের মতোই দেখতে! এত দূর যাব, তার জন্যেও একটু ভালো দেখতে টিকিট দিল না!
যাই হোক, দুঃখ ভুলে প্রস্তুতি শুরু হলো। বিকেল সাড়ে তিনটেয় ট্রেন ছাড়বে, সূতরাং আমাদের দু'টোর মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যেতে হবে! ট্রেনে খাবার কিনতে পাওয়া গেলেও, সেগুলো খুব স্বাস্থ্যসম্মত হয় না, তাই কেক, বিস্কুট, চানাচুর, রাত্তিরের লুচি, পরদিন সকালের পরোটা তার সঙ্গে শুকনো তরকারি, সব প্ল্যান হল। শোওয়ার জন্য একটা হোল্ড অলে তিনজনের পাতবার জন্য পাতলা এবং গায়ে দেওয়ার জন্য মোটা চাদর (হোক না মাদ্রাজ, কে না জানে ছুটন্ত ট্রেনে রাতে শীত করে!) নেওয়া হলো। ফোলানো বালিশ কেনা হল। দুটো বড় জলের বোতল, তার সঙ্গে চেন লাগানো জল খাওয়ার কাপ। চলন্ত ট্রেনে যদি হাত থেকে পড়ে হারিয়ে যায়!
যাত্রার দিন তো ভোরবেলা থেকে উঠে দক্ষযজ্ঞ চলেছে। দুই পিসি এসেছেন, একজন লুচি ভাজবেন একজন পরোটা। ঠাকুমা মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে উপদেশ দিতে লাগলেন, "লেডিস ক্যুপের টিকিট, দরজা বন্ধ করে শোবে। টিকিট চেকার ছাড়া আর কারোকে টিকিট দেখাবে না একদম! খুব বেগ না পেলে টয়লেটেও না গেলেই ভালো, কী সব নোংরা করে রাখে..." এক দাদা আমাদের সমস্ত টিকিটগুলোর নম্বর অন্য খাতায় লিখে দিল। যদি রাস্তায় টিকিট হারিয়ে যায়! তারপর ভাত খেয়ে লটবহর নিয়ে ট্যাক্সি চেপে চললাম হাওড়া স্টেশন। তিনজন যাত্রী, তাদের সি-অফ করতে আরও পাঁচ জন! আমি তখন পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা নিয়ে ব্যস্ত, দিদিও কী একটা বইতে মগ্ন। তারপর এলেন সেই মহারাণী। উফফফফ... লিস্ট মিলিয়ে, নিজেদের সিট/বার্থ পেয়ে বসে তবে শান্তি। স্যুটকেসগুলো চেন দিয়ে সিটের নীচে আটকে তালা মেরে, জলের বোতল ঝুলিয়ে, মিডল বার্থটা তোলা যায় কিনা নিশ্চিত হয়ে, পিসিরা নেমে দাঁড়ালেন। ট্রেন অবশেষে নড়লো... টা-টা করা হলো যতক্ষণ সম্ভব, তারপর আমাদের মাদ্রাজ যাত্রা পুরোদমে শুরু হলো।
তারপর খড়্গপুরে "ভাঁড়ে চা" আর "মেচেদার চপ", ভুবনেশ্বরে "পুরি" (শ্রী জগন্নাথ ধাম নয়) অন্ধকার নেমে এলে নিজেদের কৌটো খুলে লুচি-তরকারি, মাঝখানে কয়েকবার বাথরুম যাওয়ার নাম করে ভেস্টিবিউলড রাস্তাটায় ঘুরে আসা... এইসব করেই রাত নেমে এল। আমার জুটলো মিডল বার্থ, মা একটা তোয়ালে দিয়ে দুটো চেইন এর মাঝের ফাঁকাটা বেঁধে দিল, যাতে গলে পড়ে না যাই! পরদিন সকালে দেখি ওয়ালটেয়ার পেরিয়ে ট্রেন উল্টোদিকে ছুটছে! দিদি বুঝিয়ে দিল কীভাবে এটা হয়। বিশাখাপত্তনম... নামই শুনেছিলাম, সত্যি জায়গাটা আছে! ব্রেকফাস্টে পরোটা খাওয়া হলো, আর চা। বড় হয়ে গেছি, চা খাচ্ছি দিব্যি! দুপুরের লাঞ্চ অর্ডার দেওয়া হলো, স্টেশনের নামগুলো ভীষণ মজাদার! সামালকোট, টুনি, টাডেপল্লিগুডেম, রাজমুন্দ্রি... এইসব দেখতে দেখতে ভিজয়ওয়াডা তে লাঞ্চ এল। খোপকাটা থালা, ডাল ভাত তরকারি সব মিশে গেছে... তবু খেলাম, একটু টকটক সবই। নুনের ছোট্ট প্যাকেট ছিল তরকারির নীচে, সেটা শেষে আবিস্কৃত হলো। আর প্লাস্টিকের কাপে দই। একটুখানি জিভ ছোঁয়াতেই যেন শক লাগল জিভে। টক দই আগেও খেয়েছি, কিন্তু এটাকে টক বলে!! কী সাংঘাতিক! সোজা জানলা খুলে বাইরে। তখন থেকে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো, এই টক খেয়ে থাকতে হবে নাকি!
ট্রেন ছুটেছে, আমরাও একটু গড়িয়ে নিলাম। একটানা চলে, সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম মাদ্রাজ সেন্ট্রাল। বাবা স্টেশনে ছিল, খুব আনন্দ... কিন্তু ট্রেনটা ততক্ষণে খুব আপন, খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার।
সেই শুরু। তারপর বহুবার ঐ করোমণ্ডলেই যাতায়াত করেছি। কখনো আনরিসার্ভড এ, পরে এসি থ্রি টায়ারেও। ক্লাশ ফাইভ থেকে একা যাতায়াত করতাম। মনে আছে, একবার পুজোর ছুটিতে মাদ্রাজ যাব, তো বিজয়া দশমী আর ভাইফোঁটা দুটো রাত্তিরই ট্রেনে কেটেছিল। আশেপাশের দাদা, কাকারা মিলে স্টেশনে বড়া, কালাকাঁদ যা পাওয়া যায় সবাই কিনে একসঙ্গে সেলিব্রেট করেছিলাম। তখনও খাবারে ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে লুঠপাটের বদমায়েসী শুরু হয়নি, সহযাত্রীরা হামেশাই খাবার ভাগ করে খেতাম। কীভাবে যেন করোমণ্ডল এক্সপ্রেস আমাদের মাদ্রাজের বাঙ্গালীদের কাছে "কলকাতা" বা "বাড়ি"-র রূপক হয়ে উঠেছিল। মনে আছে, ছোটবেলায় মাদ্রাজের স্কুল থেকে ভ্যানে ফিরতাম যখন, পাশের লাইন দিয়ে করোমণ্ডল ও আসতো মাদ্রাজের দিকে। আমরা সেই ছুটন্ত গাড়ীকেই নিজেদের লোক ভেবে ভ্যান থেকেই টা-টা করতাম, খুব খুশী হতাম "আজ করোমণ্ডল দেখতে পেয়েছি!" বলে।
আরো কতো গল্প! একবার আমি আর মা মাদ্রাজ আসছি, রাজমুন্দ্রিতে স্টেশনে জল নিতে নেমেছি আর ট্রেন দিয়েছে ছেড়ে। দৌড়ে সামনের একটা বগিতে উঠে, ভিতর দিয়ে আর নিজেদের বগি চিনতে পারি না! ওদিকে মা-ও টেনশনে চেন টানে আর কি! লোকজন চেঁচামেচি করে ঠিকমতো পৌঁছে দিল আমায়। আর একবার আমাদের জানানো হলো আমাদের বগিতে কী যেন টেকনিকাল ফল্ট হয়েছে, তাই বিশাখাপত্তনম (আর ওয়ালটেয়ার নয়)এলে বগি বদলাতে হবে। সে বারও আমি আর মা যাচ্ছি। মালপত্র নিয়ে আবার অন্য বগিতে গিয়ে ওঠা...
তাও তো প্রতি বছর যে ঝড়বৃষ্টিতে লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে করোমণ্ডলের যাত্রীদের কিছুটা পথ বাসে করে নিয়ে গিয়ে আবার অন্য একটা ট্রেন ধরতে হতো, সে অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। শুনেছি পরিচিতদের মুখে। শুনেছি আরও মজাদার গল্প। একজন জল খেতে স্টেশনে নেমেছিল আর ট্রেন দিয়েছিল ছেড়ে। সে দৌড়ে গার্ডের কামরায় উঠে পড়েছিল। গার্ড তাকে খুব বকেছিল, ওইভাবে ছুটে ট্রেন ধরবার জন্য। বকুনি খেয়েও, সে আরামের সীট পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরের স্টেশনে গার্ড ঠেলেঠুলে তাকে নিজের সীটে পাঠান!
আর একবার, ভীষণ গরমের সময় দুপুরে স্টেশনের পানীয় জলের কলে স্নান করতে নেমেছিল এক কাকু। সবে মুখে সাবান দিয়েছে, আর ট্রেন দিয়েছে ছেড়ে! দৌড়ে ভেজা লুঙ্গি পরেই সাবান মুছতে মুছতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে এক সহযাত্রীর পা দিলেন মাড়িয়ে। সে বেচারা 'কাল! কাল!' বলে চেঁচিয়ে উঠতে কাকু আরো রেগে বললেন, "আমার আজকের স্নানের কী হবে! কাল করবো মানে!!" তারপর তাঁকে বোঝানো হয় যে তমিড় ভাষায় 'কাল' মানে 'পা', আর তিনি বেচারার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন!
ভিজয়ওয়াদা তে অনেকের জুতো চুরি হেয়ে গেছে, খাবারের মান অত্যন্ত বাজে হয়ে গেছে। একবার আমাদের খাবার দেয়ই নি, পরে রেল কোম্পানিকে অভিযোগ করতে টাকা ফেরত পেয়েছিলাম। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও করোমণ্ডল যেন আমার অতি প্রিয় আত্মীয়! এই বছর আষ্টেক আগেও, একবার জরুরী কাজে মা, বৌ আর ছোট্ট ছেলে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছি। টিকিট এসি থ্রি টায়ার, কিন্তু কনফার্মড হয় নি, ওয়েটিং লিস্ট। বি-টু তে রিস্ক নিয়ে উঠে পড়লাম, সীট শেয়ার করে দিনের বেলাতা কেটে গেল, কিন্তু রাতে! টিটিই কে বলেও একটাও বার্থ ফাঁকা পাওয়া গেল না, অগত্যা দুটো সীটের মাঝখানে মাটিতে খবরের কাগজ পেতে অন্ততঃ বাচ্চাটাকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করছি, 'ধুত্তেরি' বলে এক ভদ্রলোক নিজের বার্থটা ছেড়ে দিয়ে ছেলের সঙ্গে শুলেন। সেই বার্থে বৌ আর ছেলে শুলো। এদিকে মা কে বসে থাকতে দেখে আরও একজন নিজের বার্থ ছেড়ে বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করলেন। শেষরাতে আমাকেও একজন বার্থ ছেড়ে দিয়ে বললেন, "কী ভেবেছেন টা কি, সারারাত বসে কাটানো যায়! নিন শুয়ে পড়ুন!" এনাদের নামও জানিনা, যোগাযোগও নেই, কিন্তু সেইরাতে যে কী ভীষণ উপকার করেছিলেন এক অপরিচিত পরিবারকে, তা হয়তো ওনারা কোনোদিন জানলেনও না! এই আমার করোমণ্ডল!
এখন জীবনযাত্রা বদলে গেছে। সময় বাঁচাতে ফ্লাইটেই যাতায়াত করতে হয়। আকাশে চেনা নীল-সাদা প্লেন দেখলেই ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে "বাবা দ্যাখো, ইণ্ডিগোর ফ্লাইট, কলকাতা যাচ্ছে!" আমার মনে পড়ে যায় করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের কথা। এভাবেই উত্তেজিত হয়ে পড়তাম এক সময়।
কে জানে, একেই বোধহয় বড় হয়ে যাওয়া বলে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন