শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩

ভাবাবেগ ~ মাহফুজ আলম

ভাবাবেগ অতি বিষম বস্তু। 

কার ভাবাবেগ কিসে আহত হয়, তা বোঝা বড়ই দায়। ধরুন, আপনি সুকিয়া স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে গীতিকার জিবেগজা খাচ্ছেন, আমি ডাক্তারের হুমকিতে বাঁচি, গীতিকা কি ঘোষের ধারে কাছে হাঁটিনে, আপনাকে ওই পরম আস্বাদে জিবেগজাতে কামড় দিতে দেখে কি আমার ডায়েট লাঞ্ছিত ভাবাবেগ আহত হবে না?

অথবা এই রমজান মাসে যেসব নিষ্ঠুর লোক দিনরাত নির্লজ্জের মত জাকারিয়াতে গিয়ে ছবি দিয়ে যাচ্ছেন, তা দেখে কি আমার কোলেস্টরলে ভীত কোমল ভাবাবেগ ঘা খাচ্ছে না?

আলবাত ঘা খাচ্ছে। রীতিমত হৃদয়ে গভীর ঘা লাগছে। কিন্তু , তাতেও কিছু করতে পারছি কি? আপনাকে দানিশের রোল খেতে দেখেও কেড়ে নেবার বিধান আইপিসি তে কোথাও আছে বলে তো মনে হয় না। 

তবে, পলিটিসিয়ানদের এই বাধা-টাধা নেই। তাদের ভাবাবেগ যখন তখন আহত হয়। অম্নি পুলিশ টুলিশ কবিকে দেখে টুপি খোলা ভুলে আহত ভাবাবেগ কে পুলটিস লাগাতে উঠে পড়ে।( কবি কে দেখে আর টুপি খোলে না কারণ কবি এখন মন দিয়ে চেয়ার মুছছেন। কাকীয় প্রতিচ্ছবিতে আত্মদর্শনে বিশ্বাসী আরেকজন তার কম্পিটিটর ছিলেন, তবে এখন তিনি ভাষিক গন্ডগোলে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়েছেন )। 

এই ভাবাবেগ আহত হওয়ার ঠেলায় সম্প্রতি বিপাকে পড়েছেন শহর বহরমপুরের চন্দ্রশেখর সরকার। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে কোট করে একটি পোস্ট করেছিলেন সোসাল মিডিয়াতে। সেটিতে কোনো একটি অতি দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের ভাবাবেগ আহত হয়। অম্নি মানিনীয়ার পুলিশ 'ঝড়' পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য চন্দ্রশেখর সরকার কে আটক করে। শেষে কোর্টে জজ সায়েব কে কৃত্তিবাসী রামায়ণ খুলে দেখিয়ে জামিন পেয়েছেন তিনি।

শাসকদলের দামালরা থানায় হানা দিলে যে পুলিশ টেবিলের তলায় লুকোয়, বগটুই তে যখন জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে, তখন যে পুলিশ সময়ে পৌঁছানোর সময় পায় না, তাদের এই কর্ম তৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মত। 

তবে, পুলিশ নিয়ে বেশি কথা নয়। কারণ, শঙ্খ ঘোষ সেই কবেই লিখে গেছেন, "পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।"

অতি দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় সংগঠন তাদের কাজ করেছে। এটাই তাদের রাজনীতি। এটা নিয়ে শব্দ খরচ করার মানে হয় না। তাছাড়া সম্প্রতি শুনলাম একজন লক্ষণের শক্তিশেল থেকে কোট করেছেন বলেও তার পোস্টে নাকি কলকাতা পুলিশ কে ট্যাগ করা হয়েছে। মাইকেল এনারা পড়েছেন কিনা জানিনা।

কিন্তু, একই সাথে এটাও উল্লেখ্য যে আমরাও কিছু করছি না। আমরা বলতে বোঝাচ্ছি, আমরা, যারা নিজেদের শিক্ষিত সচেতন শ্রেণী মনে করি।  এর পরেও শহরে রবীন্দ্র সদনে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে প্রশয় দেওয়া নেতাদের সাথে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলব আমরা।

জাস্ট, যেকোনোভাবে এড়িয়ে যাবো চন্দ্রশেখর সরকারের ঘটনাটা। আমাদের সমষ্টিগত নীরবতা শক্তি যোগাবে দুতরফের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের। এরপরে চোখের সামনে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে কাউকে লাঞ্ছিত হতে দেখলেও স্রেফ চোখ বন্ধ রাস্তা পার হবো। 

জার্মানীতে ইহুদি নিধন যজ্ঞ একদিনে শুরু হয় নি। এমনকি যখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নারকীয় এক্সপেরিমেন্টে ইহুদী দের হত্যা করা হচ্ছে, তখনও বার্লিনে রমরমিয়ে চলতো থিয়েটার আর কালচারাল প্রোগ্রাম। আমাদের দিল্লীর কর্তা ব্যক্তিরা বিরোধী দেখলেই কথায় কথায় যে প্রতিবেশী দেশের ট্যুরিজম অ্যাম্বাসাডার এর ভূমিকা পালন করেন , সেই দেশের উগ্র ধর্ম রাজনীতির কুফল দেখে আমাদের কিছু শেখার ছিল। 

এই বহরমপুর রেজাউল করিমের শহর, আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম।

ভবিষ্যতে যা কিছু হতে যাচ্ছে, তার দায় কিন্তু আমাদের নিতে হবে। বালিতে মুখ গুঁজলে ঝড় বন্ধ হয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন