রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২

ভারতের গর্ভপাত আইন ~ স্বাতী রায়

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গতকাল এক কলমের খোঁচায় সেখানকার মেয়েদের সংবিধানগত গর্ভপাতের অধিকারটিকে খারিজ করে দিয়েছেন। তারপরই বেশ একটু ভারতের প্রগতিশীলতা নিয়ে আনন্দ দেখা গেছে। হওয়ারই কথা। বলে কিনা সেই ১৯৭১ সাল থেকে এদেশে গর্ভপাত আর অপরাধ নয়। ০-১২ সপ্তাহের মধ্যে ( দুই ডাক্তারের অনুমতিক্রমে ২০ সপ্তাহ অবধি )। (সাম্প্রতিক বদলে অবশ্য উভয় সময়সীমা বেড়েছে।)   সেই '৭১ সালের আইনে অবশ্য বিবাহিত মেয়েদেরই শুধু আরও সন্তান আনতে না চেয়ে ব্যবহৃত কন্ট্রাসেপশন ফেলিয়রের সম্ভাবনা বলা ছিল। ধর্ষণজাত ভ্রূণের গর্ভপাত করতে হলে অবশ্য বিবাহিত-অবিবাহিত বাধা নেই। এই সবে ২০২১ সালে সেই বিবাহিত-অবিবাহিতের ফ্যাঁকড়া সরিয়ে বলা হল মহিলা ও তার পার্টনার, আর জোড়া হল সন্তান না চেয়ে ব্যবহার করা কন্ট্রাসেপশন মেথডের কথা । এইটুকুই ভারতের আধুনিকতার অর্জন।   

 কিন্তু সত্যিই সেই আইনের কতটা ছাপ পড়েছে সমাজের উপর? পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের অভিজ্ঞতা কি বলে? মেয়েদের কথা বাদ দিন, এমনিতেই ওদের বারোহাত কাপড়ে কাছা জোটে না, তাদের আবার মতামত! তার থেকে ডেটা দেখুন। ডেটা পাওয়া গেছে  http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indias.html থেকে।  এখানে এই যে ১৯৯৩-৯৪ সালে রিপোর্টেড এবরশনের সংখ্যা ৬৪ হাজারের বেশি হল, এমন তো নয় যে সেবার কোন গ্রহ নক্ষত্রের যোগে সংখ্যাটা ওই মাত্রায় পৌঁছাল। বরং প্রশ্ন উঠুক, অন্যান্য বছর এত কম কেন? সত্যিই কি আবর্শনের দরকার পড়েনি ? নাকি দরকার পড়েছে, আর দরকার মেটাতে মেয়েরা বাধ্য হয়েছেন হাতুড়ের কাছে যেতে, বাড়িতে বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করতে? 



কমিউনিটি মেডিসিনের চার অধ্যাপক ২০১৫-১৬ সালে নক্সালবাড়ি ব্লকে ৪২০ জন ১৫-৪৯ বছরের মহিলার মধ্যে সার্ভে করে জানিয়েছিলেন যে যদিও গড়ে প্রতি মহিলার ১.৩ টি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এর মধ্যে ৪৮.৩%ই আপনাআপনি হয় না, অর্থাৎ কিনা সেগুলো ইনডিউসড এবরশন, ওষুধ দিয়ে বা সার্জিক্যালি করা হয়। আর তার ৫৮% হয় বাড়িতে, হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ইত্যাদি। অনুমান করছি সেগুলো নিশ্চয় আর কোনভাবে রিপোর্টেড হয়না। ১৭৮টা এবর্শনে ৫০ টা  হিসেবের বাইরে থেকে গেল। আরও ৭১ টা হয় বেসরকারি জায়গায় – তারই বা কটা রিপোর্টেড হয় তা কে জানে! এই অবস্থায় প্রথম ছবির ওই পেন্ডুলামের মতন একবার চাগিয়ে উপরে ওঠা আবার ঝপ করে নেমে যাওয়া দেখলে কেমন সন্দেহজনক লাগে না? ( সূত্রঃ https://www.ijph.in/article.asp?issn=0019-557X;year=2019;volume=63;issue=4;spage=298;epage=304;aulast=Dasgupta )

আরও অবাক হতে হয়, দ্বিতীয় ছবিটা দেখলে। ডেটা সোর্স ঃ http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indiad-westbengal.html  এটা ২০১০-১১ সালের ডেটা। কলকাতায় যেখানে প্রায় ১৫০০০ এবর্শন, সেখানে বীরভূমে মাত্র ৮২ টা, বাঁকুড়ায় মাত্র ৩২৭ টা। কী জানি হয়ত সেখানকার মানুষের জীবন খুবই সংযমী, কোনও উল্টোপাল্টা পা পড়ে না সেখানকার মানুষের, তবে আমি পাপী তাপী মানুষ আমার কেমন মনে হয় যে আসল কারণটা হয়ত অন্যত্র। রিপোর্ট যতদূরে দেখতে পায়, তার বাইরে হয়ত থেকে যায় অনেকটাই। সেই বাইরে যেটা থেকে যাচ্ছে,  তার কতটা সেফ এবর্শন? দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ … 

বিবাহিত মেয়েদেরই হাতের আওতায় এল না সেফ এবর্শন, অবিবাহিত হলে তো কথাই নেই! কত যে কথা শুনতে হয়! একটি এমটিপি করতে আসা মেয়েকে নার্স বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় এক বেসরকারি হাসপাতালের (পশ্চিমবঙ্গের বাইরের) ডাক্তার নার্সকে ডেকে কাউন্সেল করেছিলেন, বলেছিলেন এই সব কথা তো তোমার জানার দরকার নেই। ও একটা সার্ভিস নিতে এসেছে আমাদের কাছে, আমরা দেব এইটাই ওর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বাকিটা ওকে বুঝে নিতে দাও। এই ডাক্তার মহিলাকে অসীম শ্রদ্ধা জানাই। এর পাশে রাখি সেই সব কলকাত্তাই ডাক্তারদের যারা শুধু সিঁদূর দেখতে না পাওয়ার জন্য একটি মেয়েকে কুমারী ধরে নিয়ে মোরাল পিসিমা হয়ে এমটিপি করা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চেষ্টা করেছিলেন।  

এমনিতেই ভারতের এবর্শন সংক্রান্ত আইন নিয়ে একটা বড় বক্তব্য যে গর্ভ রাখা না রাখা গর্ভবতী জনের ইচ্ছার অধীন না, ডাক্তারের মতামতের দ্বারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। তারউপর পিএনডিটি এক্টের জন্য এখন ডাক্তাররা চাপে থাকেন কি? গর্ভপাত করাতে হেজিটেট করেন? তাহলে কিন্তু আনসেফ এবর্শন বাড়বে বই কমবে না। আরও একটা কথা এই প্রাইড মাসে না তুললে অন্যায় হবে, এই আইন কিন্তু আগাগোড়া মেয়েদের কথাই বলে গেছে শুধু। অন্যদের কি হবে?
     
তবে এসব তো পরের কথা, এমনকি আইনে যেটুকু আছে, সেটুকুও যে কতটা হয় এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। আইন থাকলেই হয় না, আইনকে সবার হাতের আওতায় পৌঁছে দিতে হয়। সেজন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাগে, মানুষ লাগে, সদিচ্ছা লাগে। নাহলে হয়ত প্রগতিশীলতার খাতায় অফিসিয়াল টিকটা মারা যায়, কিন্তু আখেরে কাজের কাজ কিছু হয় না। সংবিধানসম্মত অধিকারের আওতায় থাকা ভারত আর আওতার বাইরে থাকা আমেরিকার তফাৎটা তখন ঝাপসা হয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন