-কটা বাজে খেয়াল আছে? দুপুরের খাবারটা কি তোদের চায়ের দোকানের ঠেকেই দিয়ে আসবো?
মহাসপ্তমী'র পুণ্য তিথিতে, খাবারের থালা সাজিয়ে মা তখন জাগ্রত এবং সংহারী। অগত্যা ঝাঁটাপেটা এড়াতে, প্রবল বাগবিতণ্ডার ষোলআনা রাজনৈতিক আড্ডার আপাতত ইতি টানলাম। নব্য আর.এস.এস এবং আমার বাল্য বন্ধু'র গায়ে তখনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দিল্লীর মসনদ দখলের ঔদ্ধত্যের গন্ধ টাটকা। একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আর এক আকাশ রয়াব নিয়ে বন্ধু সেদিন বলেছিল
-ভাই, তোদের কে নিয়েই যা চিন্তা। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কে আমরা জাস্ট ফুঁকে উড়িয়ে দেব। সত্যি বলতে, উই ডোন্ট রিয়েলি কেয়ার অ্যাবাউট দেম।
আলতো হিমেল পরশে মোড়া নভেম্বরের দিল্লী। কেতাদুরস্ত অশোকা হোটেলে বসল 'ওয়ার্ল্ড হিন্দু কংগ্রেস।' তিনদিনের আলোচনার নির্যাস নিংড়ে, আগত প্রতিনিধি'দের হাতে 'থট পেপার' ধরিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল, 'হিন্দু সমাজে সবচেয়ে বড় পাঁচ শত্রু'র নাম' –'এম ফাইভ'। না! 'মুসলিম' কিম্বা 'মিশনারি' না! 'এম ফাইভ'র তালিকাতে প্রথম 'এম'; 'মার্ক্সিসিম' ¹। বুঝলাম, বাল্য বন্ধু'র দুশ্চিন্তা নেহাতই বিক্ষিপ্ত নয়। বরং আর.এস.এস'র আদর্শের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
২০১৪'র ওড়িশার বিধানসভা নির্বাচনে এই 'মার্ক্সসিস্ট'রা ভোট পেয়েছিল মেরেকেটে ৮০,২৭৪। শতকরা ০.৪%। আর বিধায়ক কুড়িয়ে বাড়িয়ে ঐ একটা ² । অথচ গত ডিসেম্বরে, ভুবনেশ্বরে, এমনই একটা ক্ষয়িষ্ণু ডেভিড'দের রাজ্য পার্টি অফিস আক্রমণ করল 'পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল', গোলিয়াথ বি.জে.পি ³ । বুঝলাম, বাল্য বন্ধু'র দুশ্চিন্তা নেহাতই কাকতালীয় নয়। বরং আর.এস.এস যাজকতন্ত্রের ধমনীতে অন্তর্নিহিত আশঙ্কা সূত্রে সংক্রামিত।
২০১১'র আগে, এই নব্য আর.এস.এস বন্ধুই জোর গলায় বলত, "এই রাজ্যে গরু-ছাগল-ভেড়া-কুকুর যেই ক্ষমতায় আসুক আপত্তি নেই; কমিউনিস্ট'দের তাড়াতে হবে।" কমিউনিস্ট'দের তাড়ানোর সেই মনোবাঞ্ছনা নিছকই উদ্দেশ্যহীন ছিল না। ছিল না, কারণ, গরু-ছাগল-ভেড়া-কুকুরের'ও অধম এই 'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, আর.এস.এস-জামত'দের জন্য এ রাজ্যের দরজা নিয়ম করে বন্ধ থাকতো। রথে চেপে 'লৌহপুরুষ'দের 'মন্দির ওহি বানায়াঙ্গে'র চ্যাংড়ামি এ রাজ্যের দুয়ারে এসে থমকে যেতো। ৮৪ কিম্বা ৯২, গোধরা কিম্বা গুজরাট; এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তখন "দাঙ্গাবাজ'দের মাথা ভেঙ্গে" দেবার হিম্মত রাখতো। লড়াইটা এ রাজ্যের 'হ্যাভ নটস' গুলো জাত নিয়ে নয় পেটের খিদে আর হাতের কাজ নিয়েই করতে জানতো।
'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, ধূলাগড়ে কোনদিন নবী'র জন্মদিনে মিছিল করতে হয়নি। তৃণমূলের গুলশান মল্লিকের মত, ধূলাগড়ে, 'কমিউনিস্ট'দের' কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কে ভোটের জন্য আইন-প্রশাসনের বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে সেই মিছিল 'হিন্দু পাড়া'র মধ্যে নিয়ে যেতে উস্কানি দিতে হয়নি। আর.এস.এসের মদত এবং আদর্শপুষ্ট 'অন্নপূর্ণা ক্লাবের' ঢিল ছোড়া দূরত্বে ইসলামের পতাকা টাঙ্গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বারুদ সাজাতে হয়নি ⁴ । এতে ৩৪ বছরে ইসলাম পালনে কোন বাধা হয়নি। কোরানের সূরার পবিত্রতার দুধে একফোঁটা চোণা পড়েনি। বেহেশতের রাস্তা কণ্টকাকীর্ণও হয়নি।
জীবদ্দশায় মৌলানা ইয়াসিন মণ্ডল, বারাসতে কোনদিন হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় উত্তেজনার লেশ অনুভব করেননি। ইয়াসিন মণ্ডল বাদুড়িয়ার মিলান মসজিদের ইমাম। সেই মিলান মসজিদ, যে মিলান মসজিদের উল্টো দিকের বাড়িটা ১৬ বছরের শৌভিকের। যে বয়সে শৌভিক'দের ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী পেরিয়ে, ক্যালকুলাসের অঙ্কে কিম্বা শেক্সপিয়ারের সনেটে বুঁদ হয়ে থাকার কথা, দু-একটা ইনফ্যাচুয়েশন কে প্রেমে বদলে দেবার কথা; আজকাল সেই বয়সে শৌভিক'রা মনে ঘৃণার বিষ পুষছে। নির্দ্বিধায় অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করে আনন্দ পাচ্ছে। বাড়ি বয়ে এক মৌলবাদের খাল কেটে অন্য মৌলবাদের কুমীর আনছে ⁵।
নেহেরুর ভ্রান্ত মাশুল সমীকরণ নীতির ⁶ বদন্যতায় পূর্ব প্রান্তের রাজ্যগুলোর শিল্প সম্ভাবনার শশ্মানেই সেদিন সেজে উঠেছিল পশ্চিমের রাজ্যগুলো। ব্যবসায়ী'দের বোম্বে হবু 'বাণিজ্যনগরী'। মালিকের মুনফা আর কারখানার উৎপাদনের ত্রৈরাশিকে প্রতিদিন লেখা হচ্ছে শ্রমিক বঞ্চনার ইতিহাস। শোষিত সেই মুটে-মজুর'দের অধিকার আদায়ের ফিনিক্স স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলো লাল ঝাণ্ডা। ১৯৬৭'র নির্বাচনে বোম্বে জুড়ে ভোট বাড়াল কমিউনিস্ট পার্টি। দক্ষিণ বোম্বে থেকে সাংসদ হলেন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রীপাদ অমৃত দাঙ্গে ⁷। ট্রেড ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে সেদিন প্রমাদ গুনেছিল মালিক-ব্যবসায়ী মহল। শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে কমিউনিস্ট'দের শায়েস্তা করতে, জরুরী অবস্থায় অন্ধকার দিনে আত্মপ্রকাশ করেছিল শিবসেনা। মালিক'দের টাকা আর কংগ্রেসের ইন্ধনে অল্প কিছুদিনেই নিছক একটা পত্রিকা সম্পাদক থেকে বাল ঠাকরের হয়ে উঠলেন বিষাক্ত রাজনীতির বেতাজ বাদশা ⁸। আর 'অজ্ঞাত পরিচয়' ব্যক্তির ১৬টা গুলি বুকে নিয়ে রক্তাক্ত হলেন শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃৎ 'কমিউনিস্ট' দত্ত সামন্ত ⁹ ।
আসলে 'কমিউনিস্ট'দের সাথে লড়াইয়ে মৌলবাদী'দের বরাবরই একটা মুখোশ লাগে। সেদিনে যে মুখোশের দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করেছিল শিবসেনা, আজকের বাংলায় সেই গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তাই 'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, যে রাজ্যে কোনদিন চার দেওয়ালের গণ্ডী পেরিয়ে ধর্ম রাস্তার রাজনীতিতে এভাবে বেআব্রু হয়নি, যে রবীন্দ্র-নজরুল-লালনের মাটিতে গুলশান মল্লিক কিম্বা শৌভিক'দের চাষ হয়নি, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজকাল মৌলবাদ চাষের জমি উর্বর করতে যত্ন করে লাঙ্গল দিচ্ছেন।
তবুও আমার গোলিয়াথ বন্ধু আজও 'কমিউনিস্ট' ডেভিড'দের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। করে কারণ, আজও গোটা বিশ্বজুড়েই মৌলবাদী'দের মুখ আর মুখোশ, দুইয়ের বিরুদ্ধেই 'কমিউনিস্ট'রাই বুক চিতিয়েই লড়াই করে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু'দের উপর অত্যাচার কিম্বা পাকিস্তানে বঞ্চিত শ্রমিকের অধিকার, আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের শিকার কিম্বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ব্যয়সংকোচ নীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের জোগাড় –আজও দেশে-বিদেশে লাল ঝাণ্ডাই প্রতিদিন পথে নামে। ইতিহাস সাক্ষী এই 'কমিউনিস্ট'দের' জন্যই দুনিয়া একদিন হিটলারের রক্ত চক্ষুর কাছে মাথা নোয়ায়নি, মুসোলিনির কাছে হারেনি। এই 'কমিউনিস্ট'দের জন্যই আজও জীবন বাজি রেখে আই.এস.আই.এস বিরুদ্ধে কুর্দ'দের লড়াই থামেনি। আর এই 'কমিউনিস্ট'দের' জন্যই বাংলার মাটি পাকিস্তান হয়নি, আর গুজরাটও হবেনা।
আমার গোলিয়াথ বন্ধু দুশ্চিন্তার করে কারণ, ইতিহাস সাক্ষী, আর.এস.এস'র কিম্বা জামাত -দুনিয়ার তামাম ডেভিড-গোলিয়াথের লড়াইয়ে, গোলিয়াথরা কোনদিন জেতেনি। গোলিয়াথরা কোনদিন জিতবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন