মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১

গ্রেগর যোহান মেন্ডেল - আধুনিক জিনশাস্ত্রের জনক ~ ডঃ বিষাণ বসু

বংশগতির মূলসূত্র লুকিয়ে আছে ডিএনএ-র গভীরে, এই বিষয়টি জানা গিয়েছে হালে - মানে, একশ বছরও পেরোয় নি। তার আগেও পারিবারিক সূত্রে মানুষ বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা বহিরঙ্গের ধর্ম কীভাবে পেয়ে থাকে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনার অভাব ছিল না। পশ্চিমদেশে পিথাগোরাস যেমন ভেবেছিলেন, বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের পুরোটাই মানুষ পেয়ে থাকে বাবা, তথা শুক্রাণুর কাছ থেকে - মায়ের ভূমিকা সেখানে বিশেষ কিছু নেই। হ্যাঁ, ইনি জ্যামিতির উপপাদ্যের সেই পিথাগোরাসই বটেন - সেসময়ে তো অত স্পেশালাইজেশনের কড়াকড়ি ছিল না, অঙ্কের হিসেব সামলানোর ফাঁকে বংশগতি নিয়েও দুচারটে কথা কইলে কেউই সেটাকে খারাপ চোখে দেখতেন না। পরবর্তীতে অবশ্য অ্যারিস্টটল বলেন, না, বংশগতি শুধুই বাবার ব্যাপার নয় - মানুষ যদি বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের আদ্ধেক পায় বাবার কাছ থেকে, বাকি আদ্ধেক, অবশ্যই, মায়ের অবদান। জেনেটিক্সের সার্বিক ইতিহাস বুঝতে গেলে - এমন সব ধ্যানধারণাকে সেই সাপেক্ষে প্রাগইতিহাস হিসেবে দেখা যেতে পারে - সেই প্রাগইতিহাস কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু, মেন্ডেল নিয়ে জানতে গেলে অত কথা বিশদে না বুঝলেও চলবে। আমরা সটান চলে আসতে পারি উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি - বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত ক্রিশ্চান সন্ন্যাসীদের এক মঠে। বিজ্ঞানের অনেক ধারার ক্ষেত্রেই সেই বিশেষ ধারার জনক কে, সে নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে - এককথায় কোনো একজনকে জনক বলে দাগিয়ে দেওয়া সম্ভব কিনা, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু, আধুনিক জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে তেমন বিতর্ক কিছু নেই - জীববিদ্যায় প্রথাগত কোনো ডিগ্রি ছাড়াই একজন লাজুক সন্ন্যাসী একার হাতে আধুনিক জেনেটিক্সের উদ্ভাবক - এবং, শুধু জনকই নন, আশ্রমের নিভৃতে বসে, কোনো বড়সড় উপকরণ বা উপাদান ছাড়াই, স্রেফ পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রয়োগে, একার হাতে জেনেটিক্সের মূল সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন - বংশগতি বিষয়ে যে সাধারণ সূত্রসমূহ আজও সমান মান্য।
১৮৫০ সাল নাগাদ সেই অস্ট্রিয়ান সন্ন্যাসী বাগান করতে করতে, কীভাবে শারীরিক বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংবাহিত হয়, সে নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেন। তাঁর নাম, গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। তিনি ক্রিশ্চান মঠে সন্ন্যাসী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর আসল ভালোবাসার জায়গাটা ছিল বাগান। স্থানীয় ইশকুলে পড়িয়ে সন্ন্যাসজীবনের খরচা চালানোর চেষ্টাও করেছিলেন একাধিকবার - সেদিকে বিশেষ সুবিধে হয়নি। শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতামান পার হওয়ার পরীক্ষায় ফেল করেন তিনি - এবং আশ্চর্য, দুবার অকৃতকার্য হন বায়োলজিতে। তাঁর মটরগাছ নিয়ে পরীক্ষার কথা অল্পবয়সে জীবনবিজ্ঞান বইয়ে সবাই নিশ্চয়ই পড়েছেন, কাজেই সে বিষয়ে বিশদে আলোচনা করছি না। মোদ্দা কথা এই, মেন্ডেল খুব গভীরে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিছু মটরগাছ লম্বা এবং কিছু বেঁটে, কয়েকটির বীজ সবুজ তো কয়েকটির হরিদ্রাভ। মটরগাছের চারিত্রিক কয়েকটি বৈশিষ্ট্যকে তিনি গোড়াতেই বেছে নেন -
১. বীজ সুন্দর গোল, নাকি কুঞ্চিত
২. বীজ হলুদ, নাকি সবুজ
৩. ফুল সাদা, নাকি বেগুনি
৪. ফুল গাছের ডগায়, নাকি কোনো শাখায় অবস্থিত
৫. মটরের খোলাটির রঙ সবুজ, নাকি হরিদ্রাভ
৬. খোলাটি মসৃণ, নাকি কোঁচকানো
৭. গাছটি লম্বা, নাকি বেঁটে
এই পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে গাছগুলোকে কয়েকটি বিভাগে সাজান। পরবর্তী মূল গবেষণার প্রস্তুতি হিসেবে, একই বৈশিষ্ট্যের গাছগুলির মধ্যে বারংবার প্রজনন ঘটিয়ে তিনি শুদ্ধ বৈশিষ্ট্যযুক্ত গাছ তৈরী করেন। এরপর একটি শুদ্ধ বৈশিষ্ট্যযুক্ত মটরগাছের সাথে অন্য বা বিপরীত শুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের গাছের প্রজনন ঘটান - যাকে বলা হয় ক্রসিং (crossing)। এই ক্রসিং-এর ফলে উৎপন্ন মটরগাছের বৈশিষ্ট্য মেন্ডেল খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখেন, পরবর্তী প্রজন্মের গাছগুলি পূর্ববর্তী দুই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের নয়, আগের প্রজন্মের দুটি বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যের যেকোনো একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত। অর্থাৎ, একটি লম্বা ও একটি বেঁটে মটরগাছের সঙ্করজাত মটরগাছটি উচ্চতায় পূর্ব প্রজন্মের লম্বা মটরগাছের মতোই লম্বা - লম্বা ও বেঁটে মটরগাছের মাঝামাঝি উচ্চতার নয়। আপাতত কথাটা খুবই সাধারণ শোনালেও, তৎকালীন বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে এই ফলাফল খুবই অপ্রত্যাশিত - কেননা, বংশগতির যে বীজ এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তীতে প্রবাহিত হয়, সেই সময়ের বিজ্ঞানভাবনা অনুসারে, তাকে ভাবা হত এমন কোনো উপাদান, যা কিনা সহজেই মিশে লঘু হয়ে যেতে পারে - অর্থাৎ তদানীন্তন বিজ্ঞানভাবনা অনুসারে, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উভয়পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ধর্ম মিলেমিশে একটা মাঝামাঝি গোছের ধর্ম অপত্যের মধ্যে পাওয়া যাওয়া উচিত। মেন্ডেল দেখলেন, ব্যাপারটা তেমন নয় - যেকোনো একটি ধর্মই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মে। যে ধর্মটি প্রকাশিত হয়, তাকে বলা হল ডমিন্যান্ট - যে ধর্ম ধামাচাপা পড়ে রইল, তাকে বলা হল রিসেসিভ।
শুধু এইটুকু আবিষ্কার করে থেমে থাকলেও মেন্ডেল বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন - কিন্তু, এরপরের ধাপে তিনি যে কাজ করলেন, তার অভিঘাত আশ্চর্য সুদূরপ্রসারী। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্কর মটরগাছগুলির মধ্যে আবার প্রজনন ঘটালেন, যেগুলো কিনা দৈর্ঘ্যে লম্বা (শুদ্ধ লম্বা নয়, সঙ্কর লম্বা)। দেখা গেল, তৎপরবর্তী প্রজন্মে পুরোনো বৈশিষ্ট্য কিয়দংশে ফিরে এসেছে। মেন্ডেল সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, বংশগতির মূল উপাদানের কিছু অংশ আসে অপত্যের পিতার দিক থেকে, এবং বাকি অর্ধেক আসে মায়ের দিক থেকে। কিছু ধর্ম ডমিন্যান্ট এবং কিছু রিসেসিভ। যেকোনো তরফ থেকে ডমিন্যান্ট উপাদান পেলেই ডমিন্যান্ট বৈশিষ্ট্য বহিরঙ্গে প্রকাশ পাবে - কিন্তু, বহিরঙ্গে রিসেসিভ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাওয়ার জন্য দুই পক্ষ থেকেই তদনুরূপ উপাদান পাওয়া জরুরী। রিসেসিভ ধর্ম প্রকাশিত না হলেও হাপিস হয়ে যায় না, পরের প্রজন্মে সংবাহিত হয় সেই জিন - আরেকটি রিসেসিভ জিন পেলেই আবার বহিরঙ্গে প্রকাশ পেতে পারে।
কোনো একটি সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে একটি প্রজাতির মধ্যে ভাগ করতে চাইলে, তাকে বলা হয় অ্যালিল। যেমন ধরুন, গাছের দৈর্ঘ্য এই সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করতে চাইলে, দুধরণের অ্যালিল - লম্বা ও বেঁটে। প্রতিটি মটরগাছে দুটি অ্যালিল থাকে - একটি আসে বাবার দিক থেকে, আরেকটি মায়ের দিক থেকে। দুদিক থেকেই বেঁটে অ্যালিল পেলে তবেই মটরগাছটি বেঁটে হবে, কেননা বেঁটে অ্যালিল রিসেসিভ - যেকোনো এক তরফ থেকে লম্বা অ্যালিল পেলেই মটরগাছ দৈর্ঘ্যে লম্বা হবে, কেননা লম্বা অ্যালিল ডমিন্যান্ট। মেন্ডেল অ্যালিল শব্দটি ব্যবহার করেননি - কিন্তু, এখানে সাধারণভাবে প্রচলিত শব্দটিই ব্যবহার করলাম, সমকালীন পরিভাষা ব্যবহার করলে অনেকক্ষেত্রে বিষয়টি ধরতে সুবিধে হয়।
অনেক বছর ধরে, পরের পর প্রজন্মের মটরগাছ ও তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী পর্যবেক্ষণ করে শেষমেশ মেন্ডেল উপনীত হলেন বংশগতি বিষয়ে কিছু সাধারণ সূত্রে, যাকে সচরাচর ল'জ অফ হেরিডিটি বা বংশগতির সূত্র বলা হয়ে থাকে। সূত্রগুলো কী, কেন, কীভাবে হয়, এসব নিয়ে আলোচনা এখুনি বাড়ালাম না।
মোদ্দা কথা, আমাদের শরীরে ঠিক কী কী অ্যালিল রয়েছে, তা সবক্ষেত্রে আমাদের বহিরঙ্গে প্রকাশিত হয় না। যেমন, সঙ্কর মটরগাছে যদি একটি বেঁটে অ্যালিল থাকে, তাহলেও তা বহিরঙ্গে শুদ্ধ লম্বা মটরগাছের মতোই লম্বা হবে - কিন্তু, দুটি সঙ্কর লম্বা মটরগাছের প্রজননে একটি বেঁটে মটরগাছ জন্মাতে পারে (দুই তরফ থেকেই একটি একটি করে বেঁটে অ্যালিল পেলে)। আমাদের শরীরের অ্যালিলের বিন্যাস, তথা জেনেটিক গঠন, তাকে বলা হয় জিনোটাইপ - আর বহিরঙ্গে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যাবলী, তাকে বলা হয়ে থাকে ফেনোটাইপ। আমাদের শরীরে ক্রোমোজোম থাকে জোড়ায় জোড়ায় - ক্রোমোজোম তৈরী হয় লম্বা ডিএনএ-র ফিতে দিয়ে - সেই ডিএনএ-র মধ্যে জিনের অবস্থান, যাকে বলে লোকাস, সেই লোকাসের উপর নির্ভর করে জিনের প্রকাশের প্রকারভেদ - নির্দিষ্ট লোকাস অনুসারে নির্ধারিত হয় অ্যালিল। যেহেতু ক্রোমোজোম থাকে জোড়ায় - অ্যালিলও থাকে তেমনই, জোড়ায় - ডিএনএ তন্তুতে অ্যালিলের অবস্থান হুবহু একই হলে, তাকে বলা হয় হোমোজাইগাস - না হলে, হেটেরোজাইগাস। কিন্তু, ব্যাপারটা উত্তরোত্তর জটিল হয়ে যাচ্ছে - আবারও বলি, এখুনি এত কথা না জানলেও চলবে।
মেন্ডেল জিনের ব্যাপারে জানতেন না - জেনোটাইপ বিষয়েও তাঁর জানার সুযোগ ছিল না। কিন্তু, স্রেফ দেখে এবং পরীক্ষা করেই তিনি যে কয়েকটি সূত্র দিয়েছিলেন, সেগুলো আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ডমিন্যান্স-এর তত্ত্ব - যেখানে বলা হয়, একটি জিন যদি ডমিন্যান্ট হয়, তাহলে তার বিপরীত জিনের উপস্থিতিতেও সেই জিনটি বহিরঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে (সূত্রটি মেন্ডেল এই ভাষায় বলেননি - এখানে একটু যুগোপযোগী এবং সরলীকৃত ভাষায় কথাটা বলা হলো)। যেমন, স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশের সূত্র - অর্থাৎ একটি জিনগত বৈশিষ্ট্যের প্রকাশের উপর অপর জিনের প্রকাশ নির্ভরশীল নয় - যেমন, মটরগাছ লম্বা হওয়ার জিন এবং মটরশুঁটির রঙ হলুদ হওয়ার জিন পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে প্রকাশিত হতে পারে। একদিক থেকে মেন্ডেল ছিলেন সৌভাগ্যবান, কেননা সবসময় অঙ্ক এত সরল থাকে না - সত্যি বলতে কি, অধিকাংশ সময়েই সরল থাকে না। ভাগ্যিশ তিনি মটরগাছ বেছেছিলেন গবেষণার জন্য!! অন্য গাছ বাছলে!! যেমন ধরুন, ক্যাপসিকামের রঙ কেমন হবে, তা একাধিক জিনের উপর নির্ভরশীল - একাধিক জিনের প্রকাশের উপরেই নির্ভর করে রঙ হয় সবুজ, লাল, হলুদ অথবা তাদের মিশ্রণ। মটরগাছের মতো সরল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পথ ধরে ক্যাপসিকামের বংশগতির হিসেব বোঝা মুশকিল। অনেকক্ষেত্রে একটি জিনের উপস্থিতি সমপর্যায়ের বিবিধ জিনকে দমিয়ে দিতে পারে (যার নাম এপিস্ট্যাসিস)। ঘোড়ার রঙ বিভিন্ন হতে পারে বিভিন্ন জিনের ক্রিয়ায় - গায়ের রঙ থেকে কেশরের রঙ, বিভিন্ন কম্বিনেশন সম্ভব। কিন্তু, একটি বিশেষ সাদা জিনের প্রভাব বাকি সব জিনের প্রকাশ দমিয়ে দিতে পারে - সে ঘোড়া একেবারে শ্বেতশুভ্র। অনেকসময় একাধিক জিন গায়ে গায়ে থাকে - পরবর্তী প্রজন্মে সংবাহিত হওয়ার সময় হয় একত্রে সংবাহিত হয়, নচেৎ একেবারেই নয়। সেক্ষেত্রে, প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জিন স্বাধীনভাবে সংবাহিত ও প্রকাশিত হবে, এমন নয়। এরকম আরো রকমভেদ সম্ভব - বিশদে যাচ্ছি না। কিন্তু, মূল কথাটা হলো, মটরগাছের পরিবর্তে অন্য গাছ বাছলে মেন্ডেলের পক্ষে অত সহজে বংশগতির মূল সূত্রগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না।
আবার একটিই জিন একাধিক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণ হতে পারে। অর্থাৎ একটি জিন একাধিক ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিতে পারে। (এক্ষেত্রে জিনটিকে বলা হয় প্লিওট্রপিক।) বংশানুক্রমে প্রাপ্ত বিবিধ জটিল অসুখের ক্ষেত্রেই দায়ী জিনটি এরকম প্লিওট্রপিক হয়ে থাকে - যেকারণে, সাধারণত, অসুখটি কেবলমাত্র একটি অসুবিধে বা একটি অঙ্গের সমস্যায় সীমাবদ্ধ থাকে না। মানুষের অনেক বংশগত অসুখের মূলেই জিনের গোলমাল - অনেকক্ষেত্রেই মাত্র একটি জিনেরই গোলমাল - কিন্তু, যেহেতু আমাদের শরীরের প্রায় সব কোষেই সব জিন থাকে, সেই একটিই গণ্ডগোলের জিন অনেকক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন উপসর্গের জন্ম দিতে পারে। হ্যাঁ, এই ব্যাপারটাও খুবই ইন্টারেস্টিং - শরীরের সব কোষেই সব জিনের উপস্থিতি। অর্থাৎ, ভেবে দেখুন একবার, খাবার হজম করার উৎসেচক তৈরীর জিন পেটের সাথে সাথে থাকে মস্তিষ্ক কিম্বা হাতে-পায়ের কোষেও!! কিন্তু, খাবার হজমের সেই উৎসেচক ওই পাকস্থলী বা অন্ত্রেই তৈরী হবে, অন্যত্র নয়, এমনকি জিন বা অন্য কাঁচামাল উপস্থিত থাকলেও নয় - ঠিক কেন একই জিন সর্বত্র উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সর্বত্র কাজ করে না - বা অনেকসময় একেক জায়গায় একেকরকম কাজ করে - সে বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা এখনও খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। জিনের উপরেও যে মানবজীবনের রহস্য, সেই বিজ্ঞান, অর্থাৎ এপিজেনেটিক্স (শব্দার্থ অনুসারে, জিনের উপরে, বা জিনের অধিক), আরো না এগোনো অব্দি জিন-এর টেকনোলজি ও তার কার্যকারিতা, অনেকদূর অব্দি এগোলেও, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। সব মিলিয়ে দেখলে, মটরগাছ এবং পরীক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য, দুটি বাছার ক্ষেত্রেই মেন্ডেলের ভাগ্য সদয় ছিল।
কিন্তু, কথায় কথায় অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। আমরা বরং ফিরে যাই ১৮৬৫ সালের শীতের দুপুরে - ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসের আট তারিখে, দুই ভাগে, মেন্ডেল পড়ে শোনালেন তাঁর গবেষণার কথা - ব্রুনো ন্যাচারাল সায়েন্স সোসাইটির সভায়। শ্রোতা জনাচল্লিশেক - কয়েকজন বটানিস্ট, বা জীববিদ্যায় উৎসুক, বাকি অনেকেই স্থানীয় কৃষক। মেন্ডেলের গবেষণা, জটিল করে সাজানো তথ্যের সমষ্টি বিরক্তির বেশী কিছু আগ্রহ সৃষ্টি করল না। সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হলো তাঁর গবেষণার কথা, কিন্তু সেও আর পড়ে দেখলেন কজন!! মেন্ডেল বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে নিজের হাতে পাঠালেন তাঁর গবেষণাপত্রটি - যদি তাঁরা একটু পড়ে দেখেন - কিন্তু, প্রথাগত অর্থে অশিক্ষিত এক সন্ন্যাসীর জীববিদ্যা বিষয়ক গবেষণা, যে গবেষণার ফলাফল সমকালীন বিজ্ঞানের তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, তাকে সিরিয়াসলি নেবেন কোন বিজ্ঞানী!! গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের আবিষ্কার অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল সেই সময়ের বিজ্ঞানমহলে।
মটরগাছ নিয়ে গবেষণা করতে থাকলেও, মেন্ডেল বুঝেছিলেন তাঁর গবেষণার তাৎপর্য কেবল মটরগাছে সীমাবদ্ধ থাকবে না। লিখেছিলেন, জীবজগতের বিবর্তনের ধারাকে বুঝতে চাইলে বংশগতির ধরণটি বোঝা জরুরী এবং তাঁর গবেষণা সেই উদেশেই। সেই সময়ের নামজাদা উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল ভন নাগেলি-কে নিজের গবেষণাপত্র পাঠিয়ে পড়ে দেখতে অনুনয় করে বলেছিলেন, আমি জানি, আমার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ফলাফল এখনকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাথে সহজে মেলানো যাবে না। তবুও, পড়ে মতামত জানান। নাহ, নাগেলি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। আস্তে আস্তে মঠে কাজকর্মের দায়িত্ব বাড়তে থাকলে মেন্ডেলও গবেষণা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। যুগান্তকারী গবেষণা প্রকাশের প্রায় দুই দশক পরে মারা যান তিনি। ১৮৮৫ সালে। এতখানিই অনাবিষ্কৃত ছিলেন তিনি ও তাঁর গবেষণা, যে, মৃত্যু-পরবর্তী শোকসংবাদে গবেষক মেন্ডেলের সামান্য উল্লেখটুকুও ছিল না। কোনো বিজ্ঞানপত্রিকা বা বিজ্ঞানীদের কোনো সংগঠন তাঁর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেননি। মঠ থেকে প্রকাশিত শোকবার্তায় শুধু বলা ছিল, নরম মনের মানুষটি বড্ডো ফুল ভালোবাসতেন।

মেন্ডেল পুনরাবিষ্কার
মেন্ডেলের গবেষণা অনাবিষ্কৃত থেকে যাওয়াটা যুগপৎ আশ্চর্যের এবং দুর্ভাগ্যজনক। আশ্চর্যের, কেননা ১৮৫৮ সালেই চার্লস ডারউইন প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁর বিবর্তনের তত্ত্ব - ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে জীববিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই, অন দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন। প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক কেমন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংবাহিত হয়, বিশেষত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কীভাবে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয়, সে বিষয়ে ধারণা না করা গেলে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে করতেই একটি প্রজাতি দীর্ঘসময় অতিক্রম করে কেমন করে আরেকটি প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়, সে তত্ত্ব দাঁড় করানো মুশকিল। নিজের তত্ত্বের এই অসম্পূর্ণতা বিষয়ে ডারউইন স্বয়ং ওয়াকিবহাল ছিলেন না, এমন নয় - কিন্তু, তত্ত্বের সে খামতি তিনি মেটাতে পারেননি। অথচ, মেন্ডেল-বর্ণিত বংশগতির সূত্রের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সমাধান - আরো আশ্চর্যের বিষয়, ডারউইনের লাইব্রেরিতেই ছিল জার্নালের সেই সংখ্যা, যার মধ্যে মেন্ডেলের গবেষণাপত্রটি - কিন্তু সেই জার্নালে মেন্ডেলের গবেষণাপত্রের আগের এবং পরের আর্টিকলগুলো পড়ে দেখলেও ডারউইন মেন্ডেলের লেখাটি পড়ে দেখেছিলেন, এমন প্রমাণ নেই।
বিবর্তন ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত বংশগতির ধারাকে ব্যাখ্যা করতে ডারউইন আনেন জেমিউলস-এর ধারণা। জেমিউলস, যা কিনা শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে উৎসারিত নির্যাসের মতো বস্তু এবং যে নির্যাস রূপান্তরিত হবে শুক্রে - অনুরূপ জেমিউলস থাকবে নারীর ক্ষেত্রেও - অপত্যের দেহে সংবাহিত হবে দুই জেমিউলস-এর মিলনের ফলে উৎপন্ন মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যাবলী। বংশগতি বিষয়ে ডারউইন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ্যে আনেন ১৮৬৭ সালে - মনে করিয়ে দিই, মেন্ডেল মটরগাছের 'পরে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান এর দুবছর আগেই এবং মেন্ডেল পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, অপত্যের ক্ষেত্রে মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্য সংবাহিত হয়, এমন নয়। বংশগতির ক্ষেত্রে, ডারউইনের তত্ত্ব মেনে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হওয়ার কোনো ব্যবস্থা যদি না-ই থাকে - এমন করে পরবর্তী প্রজন্ম পিতা-মাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাঝামাঝি ধর্ম পেতে থাকলে - কয়েকটি প্রজন্ম বাদে বংশগত বৈশিষ্ট্য, এবং অতএব জীবজগতের বৈচিত্র্যও, সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক - এবং দুনিয়াজুড়ে একই প্রজাতির ক্ষেত্রে সম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই সর্বময় হয়ে দাঁড়াবে, তাই না? অথচ তেমনটি তো হয় না। তাহলে?
বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলেন ডারউইনের অনুগামী ওলন্দাজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী, হুগো দি ভ্রিস-ও। তিনি বেছে নিলেন বিভিন্ন উদ্ভিদের কিছু কিছু আজব ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যকে - অর্থাৎ এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যা কিনা সেই প্রজাতির উদ্ভিদে খুব একটা পাওয়া যায় না। এবার সেই ব্যতিক্রমী গুণাবলী-সম্পন্ন উদ্ভিদের সাথে সাধারণ ও স্বাভাবিক আরেকটি গাছের প্রজনন ঘটালেন। দেখা গেল, ব্যতিক্রমী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো মোটেই মিলেমিশে লঘু আকারে পরের প্রজন্মে প্রকাশিত হচ্ছে না - হয় পুরোপুরি প্রকাশিত হচ্ছে, নচেৎ একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। ১৮৯৭ সালে ডি ভ্রিস বিশ্বকে জানালেন তাঁর তত্ত্ব - প্রজাতির একেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণ, কোষে থাকা একটি ক্ষুদ্র কণা - ডি ভ্রিস যার নাম দিলেন প্যানজিন। একেকটি বৈশিষ্ট্যের জন্যে দায়ী একেকটি প্যানজিন - অর্থাৎ একজোড়া প্যানজিন - কেননা, একটি বৈশিষ্ট্যের জন্যে প্রতি কোষে থাকে দুটি প্যানজিন, একটি আসে বাবার কাছ থেকে, আরেকটি মায়ের সুবাদে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বৈশিষ্ট্য মিলেমিশে যায় না - এবং প্রকাশ পাক বা না পাক, বংশগতির সুবাদে প্রবাহিত তথ্য হারিয়ে যায় না কখনোই। প্যানজিন নামকরণের অংশ বাদ দিলে এই তত্ত্ব একেবারেই মেন্ডেলের তত্ত্বের পুনরাবিষ্কার - এবং সত্যিসত্যিই ডি ভ্রিস, সেই সময় অব্দি, মেন্ডেল বিষয়ে কিছুই জানতেন না। জানতে জানতে গড়িয়ে যাবে আরো কয়েকটা বছর।
১৯০০ সালে ডি ভ্রিস-এর বন্ধু তাঁকে একখানা চিঠি পাঠালেন, সাথে সাড়ে তিন দশক প্রাচীন এক গবেষণাপত্র - চিঠিতে লেখা, তুমি তো গাছপালার প্রজনন বংশগতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছ, দ্যাখো, জনৈক মেন্ডেলের এই পেপারখানা যদি ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়। ইন্টারেস্টিং!!! একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডি ভ্রিস। তবে, তাঁর নিজেরই ভাষায়, বিনয় বা সৌজন্য খুবই ভালো গুণ, কিন্তু ওই গুণ না থাকলে জীবনে বেশী উন্নতি করা যায়। অতএব, ওই ১৯০০ সালেই ডি ভ্রিস-এর যে পেপারটি প্রকাশিত হলো, সেখানে জনৈক মেন্ডেলের প্রসঙ্গ অনুল্লেখিত রইল।
স্বাভাবিকভাবেই, গ্রেগর জোহান মেন্ডেল নাম হিসেবে অনাবিষ্কৃতই রয়ে যেতেন - কিন্তু ডি ভ্রিস-এর গবেষণা মেন্ডেলের পরীক্ষালব্ধ সূত্রগুলিকে পুনরায় আলোচনায় এনে ফেলল। একইসময়, প্রায় কাকতালীয়ভাবেই, মেন্ডেলের গবেষণা ইউরোপে আরো তিনজন বিজ্ঞানীর চোখে পড়ল। তাঁরাও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কীভাবে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে প্রবাহিত হয়, সে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন এবং পুরোনো গবেষণার খবর খুঁজতে খুঁজতে মেন্ডেলের পরীক্ষার হদিশ পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন, কার্ল করেন্স, ছিলেন বিখ্যাত সুইস উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল ভন নাগেলির ছাত্র। হ্যাঁ, সেই কার্ল ভন নাগেলি, যাঁকে কিনা মেন্ডেল নিজের গবেষণাপত্রটি পাঠিয়ে মতামত জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যিনি একেবারেই পাত্তা দেননি। স্বাভাবিকভাবেই, নাগেলি নিজের ছাত্রের কাছেও মেন্ডেলের কথা জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। করেন্স মটরগাছ ও ভুট্টাগাছের প্রজনন ও সঙ্কর বিষয়ে নিজের গবেষণার সুবাদে, প্রায় আচমকাই, জানতে পেরেছিলেন মেন্ডেলের পরীক্ষা ও সিদ্ধান্তের কথা। অতএব, কার্ল করেন্স যখন জানতে পারলেন ডি ভ্রিস-এর গবেষণার খবর - যে গবেষণা ও তার ফলাফল সাড়ে তিন দশক আগেকার মেন্ডেলের পরীক্ষার প্রায় অনুরূপ, অথচ রেফারেন্স হিসেবে মেন্ডেলের গবেষণাপত্রের উল্লেখটুকুও নেই - তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। রীতিমতো শ্লেষের সাথে বললেন, খুবই আশ্চর্য সমাপতন বলতে হবে, ডি ভ্রিস-এর গবেষণাপত্রে মেন্ডেলের বিষয় তো বটেই, তাঁর ভাষার ছায়াটি অব্দি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাঁর নামটি অনুপস্থিত!! ডি ভ্রিস অবশ্য বিজ্ঞানী হিসেবে অসৎ ছিলেন না - একথা মাথায় রাখতে হবে, তিনি রীতিমতো পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, তখনও অব্দি তিনি মেন্ডেলের নামটুকুও শোনেননি। গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের গবেষণাপত্র তাঁর হাতে আসে তার পরে। এবং এত বছরের শ্রমের শেষে নিজের মতো করে পাওয়া সিদ্ধান্তের কৃতিত্বের ভাগ বিগত যুগের এক অপরিচিত নিভৃতবাসী সন্ন্যাসীকে দিতে তাঁর মন চায়নি। কিন্তু, করেন্স-এর বাক্যবাণে তাঁরও বোধোদয় হলো - পরের সংস্করণে গবেষণাপত্রের রেফারেন্সে তিনি মেন্ডেলের নাম জুড়ে নিলেন।
মেন্ডেলের পথ ধরে মেন্ডেলের সিদ্ধান্তে পৌঁছালেও, ডি ভ্রিস তাঁর পরবর্তী গবেষণায় মেন্ডেলকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বংশগতির ধারা মেনে কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মে সংবাহিত হয়, সেই প্রশ্নের সাথে সাথে তিনি তুলেছিলেন আরো বুনিয়াদি একটি প্রশ্ন। যে বৈশিষ্ট্যটি পরের প্রজন্মে সংবাহিত হবে কি হবে না, সে নিয়ে আমরা এত ভাবছি - কিন্তু, সেই নতুন বা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য প্রজাতির মধ্যে এলো কী করে? একই প্রজাতির মধ্যে কোনো গাছ লম্বা আর কোনো গাছ বেঁটে, কোনো গাছের ফুল সাদা আর কোনোটির রঙ বেগুনি - এবং এই প্রতিটি ধর্মই পরবর্তী প্রজন্মে সংবহনযোগ্য - এই বিভিন্নতা এলো কোন পথে? আর সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই যে প্রজাতি আদিকাল থেকেই পেয়ে আসে, এমনও তো নয়। সময়ের সাথে সাথে নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়, যে বৈশিষ্ট্য ক্ষেত্রবিশেষে পরবর্তী প্রজন্মে সংবাহিতও হয়। ব্যতিক্রমী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দীর্ঘসময় যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে ডি ভ্রিস সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন - প্রাকৃতিক নিয়মেই এমন বৈশিষ্ট্য প্রজাতি অর্জন করতে পারছে। এমন বৈশিষ্ট্যের তিনি নাম দিলেন - মিউট্যান্ট - অর্থাৎ পরিবর্তিত। এই একটি পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়েই ডি ভ্রিস জিনতত্ত্ব এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদকে একই সূত্রে বেঁধে ফেললেন। সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার স্বার্থে, নিজের উত্তরাধিকার পরবর্তী প্রজন্মে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে বংশগতির যে মূল বাহক, তার মধ্যে পরিবর্তন আসে - পরবর্তী গবেষণা আমাদের জানাবে, এই বদল ঘটে প্রজাতির জিনগত গঠনে, অর্থাৎ জিনোটাইপে - তারই নাম মিউটেশন। না, বিবর্তনের নিয়ম বিশেষ কিছু জিন-কে আলাদা করে সুনজরে দেখে, এমন নয় - বিবর্তনের ধারা বাছে বিশেষ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা প্রজাতির বহিরঙ্গের বিশেষ কিছু ধর্ম - অর্থাৎ, ফেনোটাইপ। ফেনোটাইপের পেছনে পরিবেশ এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব প্রজাতির জিনগত গঠনের - অর্থাৎ জিনোটাইপের। অতএব, বিশেষ ফেনোটাইপ নির্বাচিত হওয়ার পথেই বিশেষ জিনের নির্বাচন ঘটে যায়। এমন করেই প্রজাতি নিজের জিনোটাইপে বদল এনে ফেলে - ঘটতে থাকে মিউটেশন। ডি ভ্রিস-এর সময়ে এত কথা জানার সুযোগ ছিল না। কিন্তু, বিবর্তনবাদের মূলে যে প্রজাতির ক্রমবিবর্তন এবং সেই ক্রমবিবর্তনের কারণ যে প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমিক বদল, যে বদল সংবাহিত হতে পারবে পরবর্তী প্রজন্মে - প্রকৃতির নিয়মেই ঘটতে থাকে মিউটেশন, আর ঠিক সেই মিউটেশনগুলিই নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মে সংবাহিত হবে, যেগুলো প্রজাতিটিকে আরো বেশী টিকে থাকার উপযুক্ত করে তুলতে পারবে। মিউটেশনের ধারণার সাহায্যে ডি ভ্রিস বিবর্তনবাদকে আরো দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন।
কিন্তু, আমরা তো মেন্ডেলের পরীক্ষানিরীক্ষার পুনরাবিষ্কারের কথা বলছিলাম। ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে একইসাথে তিনচারজন গবেষক নিজ নিজ পরীক্ষার মাধ্যমে মেন্ডেল-উপনীত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, এবং তাঁদের গবেষণা ও সিদ্ধান্তের পেছনে রেফারেন্স ঘাঁটতে গিয়ে একটি দুষ্প্রাপ্য জার্নালে মেন্ডেলকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তবু, মেন্ডেলের তত্ত্বের বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থানের পেছনে কোনো একজনের নাম করতে হলে, সে মানুষটি কার্ল করেন্স বা ডি ভ্রিস নন - তিনি ব্রিটিশ বায়োলজিস্ট উইলিয়াম বেটসন।
লন্ডনে রয়াল হর্টিকালচারাল সোসাইটিতে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার পথে ট্রেনে বসে তিনি পড়েন ডি ভ্রিস-এর পেপারটি (যে সংস্করণে মেন্ডেলের নাম রেফারেন্স হিসেবে ছিল)। সেদিনই বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই তত্ত্বের কথা বারবার উল্লেখ করেন। গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, বংশগতির এই নবলব্ধ সূত্রের তাৎপর্য যে কতোখানি, সেটা এখুনি আমরা উপলব্ধিই করে উঠতে পারছি না। এই বক্তৃতার মাসতিনেকের মাথায়, ১৯০০ সালের অগাস্ট মাসে, তিনি বন্ধু ফ্রান্সিস গ্যালটন-কে চিঠি লিখে মেন্ডেলের পেপারটি পড়ে দেখতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। বলেন, বংশগতি বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিন্তার মধ্যে পড়বে এই গবেষণা এবং এ প্রায় অবিশ্বাস্য, যে, এমন একখানা গবেষণার কথা এত বছর ধামাচাপা পড়ে ছিল!! প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখা যাক, এই ফ্রান্সিস গ্যালটন সম্পর্কে ছিলেন চার্লস ডারউইনের ভাই এবং এককথায় বহুমুখী জিনিয়াস। ইউজেনিক্স তথা বংশানুক্রমিক জাতিগত শ্রেষ্ঠতা, জিনগত উচ্চাবচ বিভাজনের তত্ত্বের (যে তত্ত্বের পথ ধরেই আসবে নাৎসি কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ইহুদি-নিধন ইত্যাদি) অন্যতম প্রচারক হিসেবে তিনি কুখ্যাত হয়ে গেলেও রাশিবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান ছিল তাঁর - এমনকি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখে অপরাধী ধরার কার্যকরী ভাবনাটিও গ্যালটনের। কিন্তু, গ্যালটনকে আপাতত সরিয়ে রেখে বেটসনে ফিরি।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি তো বটেই, সাগর পার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও উইলিয়াম বেটসন বক্তৃতা দিয়েছিলেন মেন্ডেলের তত্ত্ব ও বংশগতির ধারা নিয়ে। বিশ্বের দরবারে এক ভুলে যাওয়া অস্ট্রিয়ান সন্ন্যাসীর লুপ্ত মর্যাদা ফিরিয়ে দিলেন তিনি। বেটসন বুঝেছিলেন এই তত্ত্বের গুরুত্ব। কিন্তু, তত্ত্বটিকে জনপ্রিয় করতে হলে একখানা যুৎসই নাম তো জরুরী। ডি ভ্রিস-এর প্যানজিন ধরে নাম দেওয়াই যেত, প্যানজেনেটিক্স। কিন্তু, বেটসনের মনে ধরল না। অতএব, গ্রীক জেন্নো (genno), যার শব্দার্থ জন্ম দেওয়া, সেখান থেকে শব্দটি নিয়ে উইলিয়াম বেটসন জীববিদ্যার বংশগতি-চর্চার এই ধারার নাম দিলেন - জেনেটিক্স।
গ্রেগর যোহান মেন্ডেল। আধুনিক জিনশাস্ত্রের জনক। দুশো বছরে পা দিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন