জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক বর্বর হত্যা কান্ড সংগঠিত করলো কারা? কারা নির্বিচারে পুরুষ নারী শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ওপর চালালো গুলি?
আপনি যদি উত্তর দেন গত শতাব্দীর প্রথম ভাগের ভারতবর্ষের তদানীন্তন শাসক দল, তাহলে আপনি ইতিহাসের ওপর সুবিচার করছেন না।
হলোকাস্ট কারা সংগঠিত করলো? কারা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদি মানুষকে পৈশাচিক বর্বরতায় হত্যা করলো? কারা ছিল গণহত্যার নায়ক?
আপনি যদি উত্তর দেন গত শতাব্দীর চারের দশকের জার্মানীর তদানীন্তন শাসক দল, তাহলে আপনি ইতিহাসের ওপর সুবিচার করছেন না।
বলিভিয়ার লা হিগুয়েরাতে ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে চে গেভারাকে হত্যা করলো কারা?
আপনি যদি উত্তর দেন গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে বলিভিয়ার তদানীন্তন শাসক দল, তাহলে আপনি ইতিহাসের ওপর সুবিচার করছেন না।
গুজরাটে ২০০২ সালে গণহত্যার নায়ক কারা?
আপনি যদি বলেন এই শতকের প্রথম দশকের গুজরাটে তদানীন্তন শাসক দল, তাহলে আপনি ইতিহাসের ওপর সুবিচার করছেন না।
ইতিহাস নির্মম কিন্তু ইতিহাস সত্য। অপরাধীর খুনে বাহিনীর নাম আপনি না নিলেও ইতিহাস পাল্টে যাবে না।
আমি আপনি জানি, ছোট শিশুরাও জানে জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা সংগঠিত করেছিল ব্রিটিশ লুটেরা শাসকরা।
ছোট শিশুরাও জানে হলোকাস্ট আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সংগঠিত করেছিল হিটলার আর তার নাৎজি পার্টি।
ছোট শিশুরাও জানে লা হিগুয়েরাতে চে গেভারাকে বুলেটে ঝাঁঝরা করেছিল সিআইএ'র ট্রেনিং প্রাপ্ত বলিভিয়ান আর্মি। কিউবান আমেরিকান সিআইএ এজেন্ট ফেলিক্স রডরিগেজ বলিভিয়ান আর্মির বেশে দাঁড়িয়ে থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ভাবুন দেখি একবার কি অনাসৃষ্টিই না হবে যদি শিশুপাঠ্য ইতিহাস বইতেও হত্যাকারিদের নাম, পরিচয় আড়াল করা হয়। ভাবুন দেখি হিটলার আর নাৎজি পার্টি, ভারতে লুটেরা ব্রিটিশ শাসকদের নাম না লিখে যদি ইতিহাস বইতে জানানো হয় তদানীন্তন শাসক দল বলে!
ভাবুন দেখি একবার, গুজরাট গনহত্যার অপরাধী মোদী শাহ মায়া কোডনানি বাবু বজরঙ্গী আর সংঘ পরিবারের নানান শাখার খুনিদের নাম না নিয়ে যদি বলি তদানীন্তন শাসক দল, কেমন হবে!
মার্কসবাদী ইতিহাসবেত্তা, চিন্তক এরিক হবসবমের ভাষায়, ' হিস্ট্রি ওয়াজ টু বি অ্যাবাউট আস্কিং দ্য বিগ হোয়াই কোয়েশ্চেনস'।
ইতিহাসের কাজ হল নির্মেদ ও নির্মোহ ভাবে সময়ের কাছে প্রশ্ন রেখে যাওয়া।
'কেন হল' তার উত্তর খোঁজা ইতিহাসের দায়।
কেন চে গেভারাকে হত্যা করা হল? কেন ব্রিটিশরা জালিওয়ানওয়ালাবাগে গুলি চালালো? কেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হল? নির্মেদ ও নির্মোহ ইতিহাস এই 'কেন' প্রশ্নগুলিকে জিইয়ে রাখে, ভাবতে বলে।
আজ ২জুলাই। ১৯৭১ সালের ২জুলাই কালনা স্টেশন চত্বরে পর পর ৩৫ বার ছুরি, বর্শা দিয়ে মেরে খুন করা হয় কমরেড মহাদেব ব্যানার্জিকে। কারফিউ ভেঙে পুলিশ, মিলিটারির বন্দুক মেশিনগানকে পরোয়া না করে শোক মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।
কারা হত্যা করলো কমরেড মহাদেব ব্যানার্জিকে? কি বলবো আমি আপনি? গত শতাব্দীর সাতের দশকে পশ্চিমবঙ্গে তদানীন্তন শাসক দল?
এতটুকু বললে ইতিহাসের ওপর সুবিচার করা হয় না। কালনায় শহীদ কমরেড মহাদেব ব্যানার্জিকে পর পর ৩৫ বার ছুরি মেরে খতম করেছিল কংগ্রেস, কংগ্রেসের খুনেবাহিনী।
পশ্চিমবঙ্গের সাতের দশকের আধা ফ্যাসিবাদী আক্রমন, খুন হামলার ইতিহাস বড় নির্মম। সাথীদের খুনে রাঙা ইতিহাস। কালনায়-আহ্লাদীপুরে-কাশিপুরে-বরানগরে-হিন্দমোটরে গোটা রাজ্য জুড়েই খুনের ইতিহাস।
সামলে চলতে হবে আমাদের, পাড়ায় পাড়ায়, কলোনীর মোড়ে, বস্তির সামনে রাখা শহীদ বেদীতে যাতে পা না পড়ে যায়।
সাতের দশকে গণহত্যা সংগঠিত করা কংগ্রেস আর তার খুনেবাহিনীর নাম মুখে আনতে আমরা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলে হবসবমের তোলা সেই প্রশ্ন হারিয়ে যাবে। 'কেন', ' হিস্ট্রি ওয়াজ টু বি অ্যাবাউট আস্কিং দ্য বিগ হোয়াই কোয়েশ্চেনস'।
কেন কমরেড মহাদেব ব্যানার্জিদের খুন হতে হয়েছিল? কেন রাজ্য জুড়ে সিপিআই(এম) কর্মীদের হত্যা করেছিল কংগ্রেস আর নকশালদের খুনোবাহিনী?
শ্রেনিশত্রুর প্রতিহিংসার বীভৎসা এখনো ছুঁয়ে আছে পাড়ায় পাড়ায় শহীদ বেদীর ফলকে।
২জুলাই, ১৯৭১। কালনায় কমরেড মহাদেব ব্যানার্জি খুন হয়েছিলেন, লাল নিশান রেখে গেছেন আমাদের জন্য। শহীদের রক্তে রাঙা নিশান হাতে আমরা যদি শহীদের ঘাতকদের নাম মুখে নিতে লজ্জা পাই, তাহলে আমি আপনি, আমরা কেউই ইতিহাসের ওপর সুবিচার করবো না।
ইতিহাস বিকৃতির জন্য আমার আপনার দিকে আঙুল তুলতে পারে যে শিশু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি, তারা যখন একদিন কমিউনিস্ট পার্টির নিশান তুলে নেবে হাতে আমাদের তখন বলবে আমরা যাদের উত্তরাধিকার বহন করছি, সেই শহীদদের কারা খুন করলো তোমরা সেটাও স্পষ্ট করে বলতে পারোনি।
আগামীর সেই সব ক্লান্তিহীন লাল পতাকা হাতে ছুটে চলা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের চোখে চোখ রাখতে আমাদের যেন ভাবতে না নয়!
ইতিহাসের কাছে সফেদ থাকার দায় আমাদের তাই সব্বারই।
১৯৭১ সালের ২জুলাই কালনায় কংগ্রেস ও তার খুনে বাহিনীর হাতে শহীদ কমরেড মহাদেব ব্যানার্জি লাল সেলাম।
ছবি: মহাদেব ব্যানার্জী ও ডঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী, কালনা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন