মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

EIA2020, উত্তরাখন্ডের বিপর্যয় এবং... ~ সংগ্রাম চ্যাটার্জী

২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রের BJP সরকার— পরিবেশ সংক্রান্ত আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ভাবনাটাকেই নস্যাৎ করে দেওয়ার সরকারি বন্দোবস্ত করার জন্য ড্রাফ্ট্ EIA2020 পেশ করে!
এ'নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ সংকুচিত করার প্রতিবাদে বহু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আদালতের দারস্থ হন, যার পরিনতিতে ২০২০'র ১১ আগস্ট পর্যন্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় এবং বহু মানুষ (প্রায় ১৭ লক্ষ!) এই প্রশ্নে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেই মতামত দেন। 
যদিও তারপর গোটা প্রক্রিয়ার ফলাফল সামনে আসে নি, অন্ততঃ আমার কাছে! আর, এই সময়েই ঘটে গেল গতকালের উত্তরাখন্ডের ভয়াবহ ঘটনাটা! 

* EIA কী? 
পুরো কথাটা: Environment Impact Assessment, বাংলা করলে দাঁড়ায় পরিবেশের উপর প্রভাবের পরিমাপ।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোনও একটি ডেভেলপমেন্টাল প্রজেক্ট বা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রকৃতি আর পরিবেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেই সম্ভবনা আগেভাগেই জরিপ করে নেওয়া হয়৷ কারণ প্রকৃতি বা পরিবেশের ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী কোনও বিপদ ডেকে আনতে পারে৷ তাই, উন্নয়নকে টেকসই করার আগে দরকার উপযুক্তভাবে প্রকৃতি, পরিবেশের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ঠিকঠাক অ্যাসেসমেন্ট! সেইটে করা হলেই, কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবুজ সংকেত পাওয়া যায়৷ এই অ্যাসেসমেন্টে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের চরিত্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই একইভাবে প্রজেক্ট সাইটে বসবাসকারী লোকজন, জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাবও এই অ্যাসেসমেন্টে বিবেচনা করা হয়৷ যাতে করে প্রকৃতি-পরিবেশকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে কার্যত একপ্রকার টেকসই উন্নয়নকে বা স্থিতিশীল উন্নয়নকে নিশ্চিত করা যায়।

* সমস্যা কী কী?
খুব বেশি কথায় না গিয়ে আরেকবার এই পাঁচটা পয়েন্টে একটু নজর দিন:
১) Post - Facto clearance! 
অর্থাৎ পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কোনো প্রকল্পের কাজ চলতে পারে। ড্রাফ্ট অনুযায়ী এই ক্লিয়ারেন্স কাজ শুরুর পরেও পাওয়া যেতে পারে (যদিও এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট একটি জাজমেন্টে একে ভুল এবং এমন আইন করা উচিৎ নয় বলে জানিয়েছে)।

২) কোনও একটা প্রজেক্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষদের বক্তব্য নথিভুক্ত করে পাবলিক হিয়ারিংয়ের সময় ক্রমাগত কমিয়ে এনে (এর আগে এর সময় ছিল ৩০ দিন, এখন ২০ দিন) বিষয়টা যথাসম্ভব গোপনে পাশ করার চেষ্টা! 

৩) নতুন ড্রাফট অনুযায়ী, যদি কোনো প্রকল্প পরিবেশ আইনকে উলঙ্ঘন করে তবে সাধারণ মানুষের অধিকার নেই সেটা চিহ্নিত করার বা সেটি নিয়ে কোনো অভিযোগ জানানোর। যদি উলঙ্ঘন হয় তবে শুধুমাত্র উলঙ্ঘনকারী (প্রকল্পকারী) বা সরকার বলতে পারে সেটা। 
ভাবুন— খুনি খুন করে এসে নিজেই বলবে— খুন করে ফেলেছি স্যর! 😀

৪)  কোনও প্রজেক্টের সাথে জাতীয় নিরাপত্তার কোনও সম্পর্ক না থাকলেও সরকার যেকোন প্রজেক্টকেই স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্ট বলতে পারে, আমি আপনি সেক্ষেত্রে কিস্যু বলতে পারবোনা। 
আর, এ'তো জানা কথাই যে— মহামান্য(!) সরকার যে কোনও প্রজেক্টকেই স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্ট বলে দিতে পারে! 

৫) ড্রাফটে বর্ডার এরিয়ার সংজ্ঞা দিয়ে যা বলেছে তার মানে দাঁড়ায় সীমান্ত থেকে মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল! এবং এই অঞ্চলে কোনো এধরনের কাজে জনতার মতামত নেওয়া হবে না! মানে! 
মোদ্দা কথা পুরো গাড়োয়াল কুমায়ূণ হিমালয় থেকে শুরু করে একদম উত্তর পূর্ব হিমালয়ের ঘন জঙ্গল ওদের টার্গেট! এমনকি চাইলে সুন্দরবনও! যেখানে যতটুকু জঙ্গল বেঁচে ছিল নজর এখন সেইদিকে! 

আপাততঃ এইটুকুই থাকল।
এবার আপনি মিলিয়ে নিন গত কয়েক বছর ধরে কী কী চলছে গোটা দেশ জুড়ে!

আচ্ছা, সময়ের অভাবে না হয় গোটা দেশের কথা বাদই দিলাম। বাদ দিচ্ছি ছত্রিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিম জুড়ে যা চলছে— সেই সব। 
শুধু এই উত্তরাখন্ড রাজ্যে 
১) নামে ৩৩ টা হলেও আদপে শতাধিক হাইড্রলিক প্রজেক্টের কাজ চলছে বা শুরু হয়েছে!! এবং এতে কোন নদী বাদ আছে? কেউ না!
হিমালয়ের দুর্গম ভুখণ্ডে 'উন্নয়ন' এর নাম করে একটার পর একটা তাগড়া প্রজেক্ট আদপে ভারী হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা বাস্তুতন্ত্রটার ওপরেই!
এই যে ঋষিগঙ্গার উপরের যে প্রজেক্টটা জলের তোড়ে কার্যত ভেসে গেল, এটা নিয়ে পরিবেশবিদরা আপত্তি করেন নি? করে গেছেন! কিন্ত ঐ কাকস্য পরিবেদনা! কাজ চলেছে! শুধু চলেছে না, আরো দ্রুততার সাথে চলেছে! মরছে কারা? গরীব মানুষ। শ্রমিকরা। 

২) ২০১৬ সালে শুরু হল প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রজেক্ট— #চারধাম_প্রকল্প! মনে রাখা দরকার, এর আগেই ২০১৩ সালে ঘটে গেছে কেদারনাথে সেই ভয়াবহ ঘটনা! তার পরেও ঐ ২০১৬ থেকে শুরু হল যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রিনাথকে চওড়া সড়কপথে নতুন করে জোড়বার কাজ! শুরু হল পাহাড় ফাটিয়ে অবাধে রাস্তা চওড়া করার অপকাণ্ড! 
কোর্ট বলছে প্রস্থ কমাও! কে শোনে কার কথা! প্রায ৪৭ হাজারেরও বেশি গাছ কাটা হল! ধ্বংস হয়ে গেল ৭০০ হেক্টর বনাঞ্চল! 
শুধু ২০২০ সালেই এই প্রকল্পের রাস্তা জুড়ে ৬টা বড় বড় ধ্বস নেমেছে! মারা গেছেন বহু শ্রমিক! 
এর পরেও অনুমতি পেতে জোচ্চুরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার— এই প্রজেক্টটাকে দেখিয়েছে আলাদা আলাদা ৫৩টা প্রজেক্ট, যার প্রতিটিই ১০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বের! 
এই চারধামের ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে পাথর পড়েছে পাশের নদীখাতগুলোতে। ক্রমশই বুজে আসছে নদীখাতগুলো! ফলে... 

৩) উত্তরাখন্ডের প্রচলিত ট্রেক রুট গুলিতে যান। দেখবেন, যেগুলো চীন সীমান্তের কাছাকাছি তার সবকটাতেই (মিলাম গ্লেসিয়ার, কিংবা পঞ্চচুল্লী বেস ক্যাম্প) চলছে পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ! নরম হিমালয় মাঝেমধ্যেই এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঝটকা দিচ্ছে, আর তখনই নামছে ব্যাপক বিপর্যয়!
এমনকি এই নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির মত বৈচিত্র্যময় ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অরণ্যের লাগোয়া এলাকাগুলোতেও এই কাজ করে চলেছে অবাধে!! ধ্বংস হচ্ছে সব কিছু! সব...!!! 

৪) পাঁচ/সাত বছর আগে ছুঁয়ে আসা কোনও একটা গ্লেসিয়ারে আবার ট্রেক করে আসেন। চমকে যাবেন #পরিবর্তন দেখে! বুঝতে পারবেন কতটা পিছিয়ে গেছে হিমবাহটা! 
হ্যাঁ, ছোট হচ্ছে সবগুলো। সে আপনি গঙ্গোত্রী বলুন, আর বাগিনীই বলুন— সব। বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফল। 
এভারেস্টের উচ্চতা কয়েক মিলিমিটার বাড়তেই পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে হিমবাহগুলোর গড় উচ্চতা বছরে ফুট দেড়েক করে কমছে! মানেটা কি বুঝতে পারছি!?  
এই রেটে যদি বরফ গলে, তাহলে হিমালয়ের জমে থাকা বরফের উপর নির্ভর করে থাকা গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতের অজস্র নদী প্রথমে বন্যায় ভাসাবে, তারপর জলের অভাবে সারা বছর ধুঁকবে! আর গোটা দেশের কৃষি পড়ে যাবে এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে! 
এই রেটে যদি বরফ গলে, সমুদ্রের জলতল যদি বাড়ে তাহলে উপকূলবর্তী হাজারো গ্রাম আর কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকা সব শেষ!! 
আর এই দুইয়ের যোগফল?? বোঝাই যাচ্ছে। 

আবারও মনে করা— পরিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বটা আসলে বিশ্বজোড়া শ্রম ও পুঁজির বেসিক যে দ্বন্দ্ব, তারই একটা সামাজিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। 
তীব্র থেকে তীব্রতম মুনাফার লোভ গোটা পৃথিবীর সামনে নামিয়ে আনছে ঘোর বিপদ। যার প্রথম বলি হবেন এবং হচ্ছেনও সেই গরীব মানুষ, সাথে মধ্যবিত্তও। 
আজকের আমার দেশের সরকারের এই পদক্ষেপ (#EIA2020) গোটা দেশের জল-জঙ্গল-জমিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার একটা ধাপ। গতকালের ঘটনাটা আলাদা কিছু না, মুনাফার লোভে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার পুঁজিবাদী অপপ্রয়াসের একটা ফল মাত্র! ফলে পরিবেশ নিয়ে এই লড়াইটা দিনের শেষে মূল লড়াইয়েরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে, সেই লড়াইটা কীভাবে লড়ব সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন