শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০

সাম্প্রদায়িক বাংলা ~ সুশোভন পাত্র

- জ্যোতি বাবু গণেশ তো দুধ খাচ্ছে? এবার কি বলবেন? 
রাইটার্সের সিঁড়িতে জ্যোতি বসু কে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এক সাংবাদিক। দিনটা ২১শে সেপ্টেম্বর। সালটা  ১৯৯৫। সকাল থেকে গোটা ভারত মেতেছে হুজুগে, গুজবে। BBC-তেও দেখাচ্ছে মূর্তির সামনে এক চামচ দুধ ঢাললেই 'গণেশ দুধ খাচ্ছে'। বুজরুকির উদ্যোক্তা RSS এবং VHP। দিল্লিতে গণেশ কে দুধ খাওয়ালেন বাবরি ধ্বংসের মাতব্বর, হিন্দুত্ব রাজনীতির 'পোস্টার বয়' লালকৃষ্ণ আদবানি। 'দৈব্য শক্তি জাগ্রত হয়েছে' –১৯৯৬-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়ল বিজেপি। 
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই জ্যোতি বাবু সেই সাংবাদিক কে উত্তর দিয়েছিলেন 
- গণেশ দুধ খাচ্ছে? খাক তাহলে! 
উত্তরটা তাচ্ছিল্যের, বিদ্রূপের। উত্তরটা গভীরও। গভীর কারণ, একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, একজন প্রশাসক হিসেবে এই আদ্যোপান্ত অবৈজ্ঞানিক, বুজরুকি তে মন্তব্য করাটাই যে বাতুলতা সেটা বিলক্ষণ জানতেন জ্যোতি বাবু। 'গণেশ দুধ খাচ্ছে? খাক তাহলে!' কেস, ওপেন অ্যান্ড শাট। মিডিয়ার কিম্বা ধর্মের রাজনীতির কারবারিদের আর দাঁত ফোটানোর জায়গা নেই।
বর্তমানে, রাজ্যে যারা বামপন্থীদের ন্যারেটিভে তৃণমূল-বিজেপির 'প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার' থিওরি তে বিশ্বাস করতে চান না, তারা জ্যোতি বাবুর এই উত্তরটাকে আপাতত ডিনারে সাইড ডিশ হিসেবে তুলে রেখে মেন কোর্সের মেনুটা শুনুন। 
২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের পর, এই জ্যোতি বাবুরই রাজ্যের সাম্প্রতিকতম মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাটের সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, "যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খাওয়াও উচিৎ।" মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য ডিকোড করলে দাঁড়ায়, মুসলিমরা (মানে গরু) যেহেতু ভোট (মানে দুধ) দেয় তাই 'মুসলিম তোষণ' উনি করবেনই। বকলেম সার্টিফিকেট দিলেন বিজেপির প্রোপাগাণ্ডাকেই। আর ঔদ্ধত্যের সাথেই বুঝিয়ে দিলেন 'বেশ করছি'।    
আচ্ছা, এই মন্তব্যে প্রান্তিক মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক কোন উপকারটা হল? রাজ্যের প্রশাসনের প্রধান হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন তীরটা উনি মারলেন? বরং এই মন্তব্য বা এই ঢং-র রাজনীতিই যে আখেরে রাজ্যে বিজেপিকে পুষ্ট করছে এটা বুঝতে কি সত্যিই আপনাদের আলফা-বিটা-গামা-ডেলটার জটিল অন্তরকলন বা সমাকলনের অঙ্ক কষতে হচ্ছে? না অ্যাটমিক ফিজিক্স গাঁতিয়ে সাব-অল্টার্ন ডিসকোর্স নামাতে হচ্ছে? 
হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কল্যাণে আজকাল মুড়ি-মিছরির একদর। না হলে, র‍্যাডক্লিফের আঁচড়ে ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলার বাউন্সি পিচেও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় বামপন্থীদের রাহুল দ্রাভিড়োচিত ডিফেন্সটা নিশ্চয় মনে থাকতো। শিখ দাঙ্গার স্মৃতিচারণায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক গুরপ্রীত সিং বলেছিলেন "আমি নিজে দেখেছি লালঝাণ্ডা হাতে সিপিআই(এম) ক্যাডাররা কলকাতার শিখ অধ্যুষিত এলাকা পাহারা দিচ্ছে। প্রবাসী শিখদের গায়ে আঁচড় লাগতে দেননি জ্যোতি বসু।" 
কাট টু ১৯৯২-র বাবরি ধ্বংসের রাত্রি কিম্বা ২০০২ গুজরাট দাঙ্গার দিন। জ্যোতি বাবু বলেছিলেন "পুলিশ কে শুট অ্যাট সাইটের অর্ডার দিয়েছি"। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্তব্য ছিল, "দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙ্গে দেবো।" একদম ঠাণ্ডা পানীয় স্প্রাইটের বিজ্ঞাপনের ক্যাচ-লাইনের মত। 'সিধি বাত, নো বকওয়াস'। আর সেই রাজ্যের সাম্প্রতিকতম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, "আমরা চারদিন বিসর্জন দেবো, ওরা একদিন মহরম করবে।" কারা 'আমরা'? কারা 'ওরা'? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাহলে 'হিন্দু' মানে 'আমরা', আর মুসলিমরা মানে 'ওরা'? মাশা-আল্লহা ধর্মনিরপেক্ষতা! 
"বিজেপি কে ফ্রন্টে এনে লড়ব", "বিজেপি আমাদের স্বাভাবিক মিত্র", "RSS প্রকৃত দেশপ্রেমিক" কিম্বা গুজরাট দাঙ্গার পর হুইপ জারি করে দলের সাংসদদের বাজপেয়ী সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দান থেকে বিরত রাখা –ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনে পেরেক পোতার বহু কাজ, RSS-র 'সাক্ষাৎ দুর্গা' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিপুণ হস্তে করেছেন। কিন্তু অগত্যাই আপনিই যদি সে সব পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে না চাওয়ার অজুহাতে 'সাত খুন মাফ' করে দেন, তাহলে না হয় ২০১৪-র পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই চোখ রাখুন।   
বিগত ৪বছরে বাংলাতে ৩টে উল্লেখযোগ্য সাম্প্রদায়িক 'দাঙ্গার' ঘটনা ঘটেছে। ধূলাগড়ে 'নবী দিবস', আর হাজিনগর এবং আসানসোলে 'রামনবমীর' মিছিল কে কেন্দ্র করে। ধূলাগড়ে নবী দিবসের মিছিল, RSS পরিচালিত অন্নপূর্ণা ব্যায়ামাগারে সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উস্কানি কে দিয়েছিলেন জানেন? তৃণমূল বিধায়ক, গুলশন মল্লিক। হাজিনগর এবং আসানসোলে রামনবমী মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ছড়ানোর প্রেক্ষিতে পুলিশি বয়ানে কি বলা হয়েছিল জানেন? "তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরাও, অনেকে মাথায় ফেট্টি বেঁধে, জয় শ্রী রাম ধ্বনি তুলে উত্তেজনা ছড়িয়ে ছিল।" RSS-র কর্মীদের সাথেই FIR-এ অভিযুক্ত ছিলেন তৃণমূল নেতা-কাউন্সিলরাও। 
আর ধূপগুড়ি? ১৯ বছরের দুই কিশোর কে গরু পাচারের ভুয়ো অভিযোগে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল যে ধূপগুড়ির বারহালিয়া গ্রামে, সেখানেও মানুষ খ্যাপানোর দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন মোট ৫ জন। ৩জন RSS কর্মী আর পঞ্চায়েত সদস্য সহ ২জন তৃণমূল কর্মী। 
এরপরও যদি আপনার তৃণমূলকে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষার সাক্ষাৎ অবতার মনে হয়, তাহলে বরং আপনিই বলুন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য কি? বলুন যে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের ভোটাভুটি তে সংসদে তৃণমূলের সাংসদদের অনুপস্থিতির কারণ কি? বলুন যে, রামমন্দির সংক্রান্ত রায়দানের দিন কিম্বা প্যান্ডেমিকের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি লাটে তুলে ধর্মনিরপেক্ষে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিপূজায় সদর্প উপস্থিতি তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিরণ্ময় নীরবতার রহস্যটাই বা কি?
জানি, এসব প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে নেই। থাকার কথাও না, কারণ, মিডিয়া বা লিবারেল পণ্ডিতরা যতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেজ বিল্ডিং-এ নামুন না কেন, 'ফ্যাসিস্ট' বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁকে ক্রুসেডর হিসেব প্রোজেক্ট করতে আদা জল খেয়ে পরিশ্রম করুক না কেন; বাস্তব এটাই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই RSS-র শাখার সংখ্যা পাঁচ গুন বেড়েছে, যাদবপুরে 'গরু পূজার' ছ্যাবলামি শুরু হয়েছে, রামনবমীর পাল্টা হনুমানজয়ন্তীর সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে, সিদিকুল্লা-তোহা সিদ্দিকী'দের মাথায় তুলে রাখা হয়েছে, মোহন ভাগবত'দের কলকাতায় সভা করে বিষ ছড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে! আসলে গোটা রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে মুজরা দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 
তাই যারা ভাবছেন তৃণমূল, সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা বাংলার রাজনীতির বাস্তবতার বহু ক্রোশ দূরে আছেন। সে থাকতেই পারেন। দূরে থাকুন, ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। পারলে আকাশের ঠিকানায় তত্ত্ব কথার দুটো চিঠি লিখুন। শুধু জেনে রাখুন চোখ বন্ধ করলে যেমন প্রলয় আটকায় না, তেমন নগর পুড়লে দেবালয়ও বাঁচে না। তৃণমূল-বিজেপির এই বাইনারি তে যেদিন আপনার গায়েও আগুন লাগবে, সেদিন দেখা হবে রাস্তায়। দেখা হবে মিছিলে। 
নিশ্চিত থাকুন, আপনার গায়ের আগুন কে সেদিন প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গে বদলে দেবো আমরাই। আপনার গায়ের আগুন কে সেদিন প্রতিরোধের মশালে বদলে দেবো আমরাই। এই বামপন্থীরাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন