আদিকবি বাল্মীকি বেশ সুখেই ছিলেন স্বর্গলোকে। সেই কবে মর্তলোকে ক্রৌঞ্চীর বিরহব্যথা তাঁর শোকোদ্বেল কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল সর্বপ্রথম কবিতার রূপে। তারপর তো জীবনভর সাধনায় লিখলেন প্রথম অনুপম মহাকাব্য রামায়ন – সে কথা কি তিনি ভুলতে পারেন? কবিতা না লেখার অতৃপ্তি তাই প্রায়শ তার স্বর্গসুখে মরচে ধরায়। সুদীর্ঘকাল স্বর্গসুখে থেকেও তাঁর সেই অতৃপ্তি গেল কই? অগত্যা একদিন ভূর্জপত্র আর লেখনী নিয়ে বসে পড়লেন কবিতা লিখতে। কিন্তু এ তো স্বর্গলোক – এখানে দুঃখ নেই, এখানে শোক নেই। তাই লেখনী কামড়ে ধরে বুঝলেন, এখানে কবিতা অসম্ভব। যন্ত্রনায় ছটফট করে উঠলো তাঁর মন, মর্তের কথা ভেবে মর্তের মায়ায় নিজেকে ফেললেন জড়িয়ে, তারপর হঠাৎ দেখলেন – মর্তের টানে মর্তেরই পানে ছুটে চলেছেন তিনি।
কলকাতার প্রশস্ত রাজপথে আপন মনে পথ চলছিল পথচারীবৃন্দ। ছুটছিল অবিশ্রান্ত গাড়ির স্রোত। কিন্তু অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল তা। সবাই সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল, রাজপথের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কে এক সৌম্যদর্শন জটাজুটধারী। মুনিবর নিজেও চমকিত।
ধীরপায়ে তিনি পথের একপাশে এসে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রিলেন শ্রেনিবদ্ধ অশ্বহীন শকটের দিকে। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি ছিটকে গিয়ে পড়ল পথের অপর পারের আলোকজ্জ্বল গ্রন্থালয়ে। সাজানী রয়েছে সেখানে অজস্র সুদৃশ্য গ্রন্থ। সহসা তাঁর মনে প্রশ্ন উঁকি দিল, আজও কি পাঠক পড়ে তাঁর সেই অমর কাব্য রামায়ন? অদম্য কৌতুহলে তিনি সূক্ষদেহে ঢুকে পড়লেন সটান সেই গ্রন্থাগারে। খুঁজতে লাগলেন হন্যে হয়ে অমর সেই কাব্য। পেয়েও গেলেন অচিরেই। আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠলো মন।
এমন সময় এলেন সেখানে এক তরুন কবি। গ্রন্থাগারিক নিজেও কিঞ্চিত কাব্যরসিক। দুজনে শুরু হল কিছু কথা কাব্যবিষয়ে। কবি বললেন, এ তো অতি সত্যি কথা – রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছে কেউ নেই আজ। পাঠকের কাছে তাই রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন অন্য সব বিস্বাদ ঠেকে। সমস্ত কবিও আজ আচ্ছন্ন রবীন্দ্র প্রভাবে। এ প্রভাব এতই ব্যাপক, তা কাটিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। অথচ পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও পুরনো। তাঁরা চান নতুন কিছু, নতুন স্বাদের। কিন্তু কবিকুল অসহায়। সামনে রুদ্ধ পথ। তাই আজ চাই নতুন কোনও ব্যাস বাল্মীকি কালিদাস।
সহসা নিজের নাম উচ্চারিত হতে দেখে আনন্দে শিহরিত বাল্মীকির হৃদয়। তক্ষুনি ভর করলেন তিনি তরুন কবির ওপর। আর পুলকিত হলেন ভেবে, এখনও তাঁর প্রয়োজন আছে এই মরজগতে। তাঁকে নতুন করে নতুন ঢঙে লিখতে হবে কবিতা, এই ভক্ত কবিকেই আশ্রয় করে।
এদিকে তরুন কবি অতর্কিতে হয়ে পড়লেন অপ্রকিতস্থ। তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরোতে চাইল ছন্দবদ্ধ শ্লোক। অতিকষ্টে তিনি নিজেকে করলেন সংযমিত। মান রাখতে দ্রুত চলে গেলেন নিজের কক্ষে। খাতা কলম নিয়ে বসতেই, ঝড়ের বেগে তাঁর লেখা হয়ে গেল গুচ্ছের কবিতা। লেখা সাঙ্গ হলে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। দেখলেন যা কিছু লিখেছেন, সবই অভিনব। এ গদ্য ও নয়, এ পদ্য ও নয় – গদ্যের মতো মিলহীন, কিন্তু পদ্যের মত কোথাও যেন রয়েছে এক অন্তর্লীন ছন্দ। উপমাগুলো হয়ে গেছে সব উদ্ভট। সমাসগুলোর অর্থের নেই কোনও সংগতি। এক পঙতির সঙ্গে অন্য পঙতির নেই কোনও ভাবগত যোগাযোগ। রসের আভাস আছে, কিন্তু ভাবের প্রকাশ নেই – এ যেন এক বিচিত্র খিচুড়ি। সব মিলে যা লেখা হল, তা কি বিষয়ে তাই বোঝা দুস্কর। সবটাই যেন হেঁইয়ালি। আবৃত্তি করতে গিয়েও খেলেন হোঁচট। হতোদ্যম হয়ে কিয়ৎক্ষন বসে রইলেন চুপচাপ।
কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে হলো, এ বস্তু নতুন। হোক না এ হেঁয়ালি, হোক না দুর্বোধ্য, মহাবিশ্বের কতটুকু বুঝি, তা বলে কি তা নিরর্থক? তাছাড়া আছে এর অন্তর্লীন এক ছন্দ। আরো আছে এর কবিতার মতো আকার। তার ওপর পাঠক ও আছেন কিছু হুজুক প্রিয়। এ বস্তু হাতে পেলে তাঁরা নেচে উঠবেন দুহাত তুলে। প্রচারের গুনে সামান্য পাথর পায় পুজো, আর কাব্যের দেহ পেয়ে এ হবে উপেক্ষিত ! অতএব, বিলম্ব নয়, অচিরেই চাই এর প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সবেমাত্র যে বস্তু জন্ম নিল তার নামটি হবে কি?
পুরনোর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এ, সুতরাং এর নাম হোক, আধুনিক কবিতা। প্রথম কবিতার জন্মদাতা বাল্মীকি, জানে সর্বজনে। কিন্তু জানে না – প্রথম আধুনিক কবিতার জন্মদাতা বাল্মীকির ভূত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন