বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

ভীনেশের লড়াই ~ বিহঙ্গ দত্ত

এই মুহূর্তটার জন্য গোটা অলিম্পিক ধরে অপেক্ষা করে এসেছি। কিন্তু কাল রাতে সৌমিক যখন ড্র জানালো তখন বুঝলাম, এ হওয়ার না। বিশ্ব কুস্তিতে সুজাকি একটা নাইটমেয়ার। ৮২ টা লড়াই লড়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। একটিও হারেননি। আনসিডেড হয়ে অলিম্পিক মঞ্চে আসার কারণে ভীনেশের ড্র খারাপ হবে সবাই জানত। কিন্তু এক্কেবারে প্রথমেই বাঘের মুখে পড়বে জানা ছিল না। যখন পড়ল তখন রেপচোজের রাউণ্ডের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় দেখলাম না দুজনেই। 

কিন্তু কেন আনসিডেড থাকলেন ভারতীয় কুস্তির আখড়ার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা? তাঁর লড়াই ৫৩ কিলো ক্যাটাগরিতে। অন্তিমকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে সেই ক্যাটাগরিতে। পাঙ্গাল ভারতের কুস্তির নতুন তারকা। সবার নজর তাঁর দিকে। ভীনেশ যখন ডাইরেক্ট তাঁর নাম পাঠানোর আবেদন করে ফেডারেশনের কাছে সে কি কটূক্তি ভক্তকুলের! এ কারণেই তো আন্দোলন! এ কারণেই তো নমস্য রে*পি*স্ট ব্রিজভূষণজির বিরুদ্ধে কুৎসা! 

সাক্ষীর বয়স হয়ে গেছে। তাঁর দরজা যে এবার বন্ধ হবে সবাই জানত। জানত না যে বজরঙ-এর সঙ্গে এই নোংরামোটা হবে ডোপিং টেস্ট কিট নিয়ে। আরেকবার কোয়ালিফাই করার সুযোগ বরবাদ করে ভক্তকুল উল্লাসে ফেটে পড়ল। বজরঙ নেই। সাক্ষী নেই। ভীনেশ পুরো একা পড়ে গেল। ঠিক করল ওয়েট কমিয়ে খেলবে। 

রেস্টলিং-এ ওয়েট কমিয়ে খেলা ভয়ানক চাপের ব্যাপার। আজকেই দেখছিলাম যে ফুল মিল অব্দি করতে পারে না রেস্টলাররা। জল খাওয়া যায় না প্রপারলি। তাই নিয়ে ভীনেশ লড়ল মাত্র একমাসের নোটিশে এবং কোয়ালিফাই করল। ভক্তকুল বলল ফ্লুক! প্রথম রাউণ্ডেই ফুটে যাবে। 

তাই যখন সুজাকির নাম শুনলাম তখন দমে গেছিলাম। শুধু সরে যাওয়া না, চোট আঘাতের ভয় কাজ করছিল ভীষণভাবে। অনেকেই ১৬-র অলিম্পিকের ওই ভয়ংকর নি ডিসলোকেশনের দৃশ্য ভোলেননি। সেবার স্ট্রেচারে করে রিং ছাড়তে হয়েছিল ২১ বছরের ভীনেশকে। গতবছর সেই হাঁটুর চোটেই কেরিয়ার খতম হতে বসেছিল। অপারেশনের পর ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হত ভীনেশকে। 


দুপুর ৩ টে ১০। ভীনেশ লড়াই শুরু করল। ক্ষিপ্র চিতাবাঘের মতো ওঠানামা। সুজাকিকে ছুঁতে দিল না প্রথম হাফে। তবু একটাবার পায়ের নাগাল পেয়ে গেছিল সুজাকি। ১ সেকেণ্ডের ৫ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে নিজেকে মুক্ত করে ভীনেশ। সুজাকির চোখে ওই প্রথম বিস্ময় দেখেছিলাম। 

কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে ট্যাকটিকালি প্যাসিভ হওয়ার কারণে পরপর দুটো হাফেই একটা করে পয়েন্ট গিফট করল সুজাকিকে। ম্যাচের বাকি আর ১০ সেকেন্ড। বিমর্ষ হয়ে গেছি। তখন ঝলসে উঠল তরবারির মতো দুটো হাত! 

এই হাতদুটোকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। সাতজন মিলে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে ছুঁড়ে ফেলেছিল রাস্তার ধারে। ব্রিজভূষণ সহাস্য মন্তব্য করেছিল- কান্ধো কি জোর কম পড় গ্যায়ি ক্যা? 
 কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে এই হাতদুটো জড়ো করে ভীনেশ আর বজরঙ্গ বলেছিল সরযূর তীরে মেডেল ভাসিয়ে দেবে। 
সাক্ষী বলেছিল- আই কুইট! 

সেই হাত ঝলসে উঠল। সুজাকি তখন জয়ের জন্য প্রায় নিশ্চিত। একটু কি কোর্টের কোনায় সরে গেছিলেন? ক্রুদ্ধ ঈগলের মতো আঁকড়ে ধরে উল্টালেন ভীনেশ! সপাটে আছড়ে পড়ল সুজাকি কোর্টের বাইরে। রেফারির হাত উঠল দুটো আঙ্গুল উঁচু করে। 

প্রথম খানিকক্ষণ বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি আর সৌমিক দুজনেই হোয়াটস্যাপে বারবার একে অপরকে লিখে যাচ্ছি ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! 
অপ্রতিরোধ্য ৮২-র গতি থামল। স্ক্রিনজুড়ে বড়ো বড়ো করে লেখা হল ৮২-১। 

বেলা ৪টে ৩০। পরের লড়াই ইউক্রেনিয়ানের সঙ্গে। রেস্টলিং এক তুমুল নিষ্ঠুর খেলা। যে জিতছে সে দম ফেলার অবকাশ পায় না। আগেই লিখেছি ভীনেশকে ওয়েট কমাবার জন্য কী কী করতে হয়েছে। ওই অশক্ত অবস্থায় কোয়ার্টার খেলার জন্য নামল ভীনেশ। ইউক্রেনিয়ান ওকসানা এদিকে ১০-২ এ ম্যাচ হারিয়ে ফুটছে রীতিমতো। ধীরস্থির শুরু হল। খানিক পরেই বোঝা যাচ্ছিল এ লড়াই ভীনেশ শুধু জেতার জন্য লড়ছে না। লড়ছে এক আকাশ অপমান আর আসমুদ্র লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে। ব্রিজভূষণ বলেছিল ১৫ টাকার মেডেলজয়ী! ওই যে সাক্ষীকে চ্যাং দোলা করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ! বজরঙ-এর মুখে থুথু মেরেছিল ভক্তরা! সবাই দেখো, আমি লড়ছি। সাতজন মিলে টানতে টানতে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনও হাত থেকে জাতীয় পতাকা সরেনি। সে হাত এত সহজে হার মানবে না। 
 
পরপর সিঙ্গল লেগ অ্যাটাক! ৪-০ তে এগোলো ভীনেশ। ছাড়ার পাত্র নয় ওকসানা। ট্যাকটিকাল মুভে আছড়ে ফেলল ভীনেশকে কোর্টের বাইরে। মাঝে খেলা বন্ধ হল দুইবার। কিছুতেই শেষ টাইম সেট করতে পারছেন না জাজেরা। শেষ ৮ সেকেণ্ড! কোর্টে তখন ঝড় উঠেছে। একটা হিলহিলে সাপের মতো নিজেকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে ওকসানার হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন ভীনেশ! ফিনিশিং বেল বাজল গম্ভীর সুরে। 

মিডিয়া উত্তাল এখন। কেউ যা ভাবেনি তাই হতে চলেছে কি? ভল্ট ঘেঁটে সোশাল মিডিয়ায় উঠে আসছে দিল্লির রাজপথের ছবি, উঠে আসছে হাতজোড় করে কান্নার বিমর্ষ দৃশ্য! উঠে আসছে বিষাক্ত সাপেদের ছোবল মারার মুহূর্তগুলো! 

রাত ১০টা ১৫। সেমিফাইনাল। বিপক্ষ কিউবান আগের ম্যাচে পুরো সময় খরচাই করতে দেননি। ১০-০ স্কোর করে দিয়েছেন অনায়াসে। কিন্তু এ ধারে ভারে ভীনেশের মাপের রেস্টলার নয় তা বলছিল অ্যানালিস্টরা। এই বছরেই ভীনেশ একে হারিয়েছে ৩-১ এ। লড়াই শুরু। প্রথম হাফে চারবার লেগ অ্যাটাক বাঁচাল ভীনেশ। দ্বিতীয় হাফে যখন প্যাসিভ পয়েন্ট যাচ্ছে ভীনেশের এগেন্সটে তখন কমেন্টেটর খানিক অশান্ত। এত কেন স্লো খেলছে? উল্টোদিকে সাক্ষী তখন বড্ড ঠাণ্ডা গলায় বলল, একটা সুযোগের অপেক্ষা করছে ভীনেশ! পেলে ম্যাচ বের করে নেবে। সুযোগ এল প্যাসিভ পয়েন্টের একদম শেষ ১২ সেকেণ্ডের মাথায়! এবার ডাবল লেগ অ্যাটাক! জানপ্রাণ দিয়ে পাক মারছে গোটা শরীরটা! কোথায় ব্রিজভূষণের চ্যালারা? কোথায় গোদি মিডিয়া? কোথায় আইটি সেলের ট্রলবাজরা? ওই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মেডেলটাকে ১৫ টাকায় কেনা যায় বলেছিলি! সব দাঁত নখ নিয়ে আয়! দেখ, ভীনেশ লড়ছে! পরপর ৪ পয়েন্ট এল। ম্যাচ ওখানেই শেষ। 

কোনও কোনও ইতিহাস তৈরি হয় বড্ড নিশ্চুপে। যাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়েছিল আইটিসেল বাহিনী তাঁর কাঁধে আজ গোটা দেশের ভার। ওই কাঁধের জোর মাপতে গেছিল ব্রিজভূষণ! আসুন বাহুবলি! মেপে যান! 

সামনে ফাইনাল। ভীনেশ একা নয়। পেছনে ভূতের মতো উঠে আসছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের চাষীরা। উঠে আসছে তাঁর সংগ্রামসঙ্গী সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ, দিদি গীতা, বৃদ্ধ জ্যাঠা মহাবীর সিং ফোগট! উঠে আসছে মতি নন্দীর গল্পের চরিত্ররা! ট্রামের পাদানি থেকে অফিস কামাই করে নামল কমল গুহ। গ্যারেজের কাজ সেরে ছুটতে ছুটতে হাজির হল প্রসূন। শীতল, কালো জল ঠেলে উঁকি দিল কোনির মুখ, রুটির দোকানের মাল নামিয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াল শিবা! সিনা টান করে দাঁড়াল গোটা ভারতবর্ষের মেহনতি! 

ফাইনালের দিন এরা সবাই থাকবে। ভীনেশ ফোগট জানে ওই মারণপ্যাঁচের থেকেও কঠিন ছিল সেদিনের ঘাড়ধাক্কা, থুৎকার! সেদিন হাল ছাড়েনি যে বন্ধুরা, তারা ছেড়ে যাবে না ভীনেশকে। একাকী যাবে না অসময়ে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন