শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

প্রতিবাদের গান, প্রতিরোধের জীবন ~ দেবাশিস মৈত্র

নীচের ছবিটা খুব পরিষ্কার নয়, তবু একবার দেখুন।
বল হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিপক্ষের কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়, তারা কেউ এই যুবককে আটকাতে পারেনি।
রাগবি খেলার ছবি, অ্যামেরিকানরা যাকে বলে ফুটবল। রাগবি খেলা আমি বুঝি না, এ-খেলায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনাদেরও নেই নিশ্চয়ই। তবু ছবিটা একবার দেখুন। নিছক খেলার ছবি নয়, এক নিপীড়িত জাতিসত্তার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ছবি।
ছবিটা তোলা হয়েছিল আজ থেকে একশো পাঁচ বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপেশাদার ফুটবল লিগের একটি ম্যাচে।পেশাদার ফুটবল লিগ সেদেশে তখনও চালু হয়নি, এই অপেশাদার টুর্নামেন্ট ঘিরেই তখন দর্শকদের ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। এই প্রতিযোগিতায় অ্যামেরিকার সেরা সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলি তো অংশ নিতই, পাশাপাশি খেলতে আসত বহু ক্লাব, সংগঠন, এমনকী সেনাদলের রাগবি টিমও।
ছবির এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ছিল রাটজার্স (Rutgers) কলেজ টিমের সদস্য। সে-ই ছিল দলের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়, বাকি সবাই শ্বেতাঙ্গ। সত্যি কথা বলতে কি, দু'বছর আগে সে যখন এই কলেজে ভর্তি হয়, তখন প্রথম বর্ষের ১৮৫ জন ছাত্রের মধ্যে সে-ই ছিল একমাত্র নিগ্রো। এখন সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; দলের বেশির ভাগ সদস্যই তার সহপাঠী, বাকিরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দলের একজনও তখনও কুড়ি বছরে পা দেয়নি।
উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের উচ্চতা ছ'ফুট তিন ইঞ্চি, ওজন প্রায় একশো কেজি, অসাধারণ পেশিবহুল শরীর এবং সেই শরীরে দানবের মতো শক্তি। তার জন্য অবশ্য এযুগের সেলিব্রিটিদের মতো এই যুবককে কোনদিন জিমে যেতে হয়নি।নিজের পড়ার খরচ চালানোর জন্য ছুটিছাটায় তাকে নানারকম কাজ করতে হত। বড়লোকদের রিসোর্টে বাসন মাজার কাজই তার বেশি পছন্দ ছিল বটে, কিন্তু সবসময় সে-কাজ জুটত না। অনেক সময় তাকে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ নিতে হয়েছে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁশের ভারা বেয়ে রাশি রাশি ইট তিনতলা-চারতলায় তুলতে হয়েছে। সেটাই ছিল তার ব্যয়াম। তাছাড়া গত দু'বছর ধরে ক্লাসের পড়া অথবা রাগবি দলের ট্রেনিং – কোনোটাতেই সে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়নি। ছোটবেলা থেকে সে জানত যে এই দেশের সে এক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নিছক শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ হয়ে উঠলে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সে পাত্তা পাবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীদের টপকে আরো অনেক দূর এগোতে না-পারলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর এই অনেক দূর এগোনোর সাধনার জোরেই সে কলেজের টিমে সুযোগ পেয়েছে, এবং গত দু'বছর ধরে দলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।
সে-বছর পরপর কয়েকটি লিগ ম্যাচ জিতে, এবং একটি ম্যাচ ড্র করে, রাটজার্স মুখোমুখি হয়েছিল এক ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দীর – রোড আইল্যান্ডের "নাভাল রিজার্ভ টিম।" পেশাদার সৈনিকদের এই রাগবি দলে রয়েছে, এক-আধজন নয়, এমন আঠারোজন খেলোয়াড় যারা বিভিন্ন সময়ে অল-অ্যামেরিকান রাগবি দলে নির্বাচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে থেকেই এগারোজন সেদিন মাঠে নামবে। খেলা শুরুর আগে ড্রেসিং রুমে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দেখে সৈনিকদের হাসি আর থামতেই চায় না! "এরা তো সব স্কুলের ছানাপোনা, এরা আমাদের পাঙ্গা নিতে এসেছে বুঝি?" সেকথা শুনে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে তার দু'একজন সহ-খেলোয়াড় চুপি চুপি বলেছিল, "একবার উঠে দাঁড়া তো! তোর স্বাস্থ্যটা ওরা একবার দেখুক!" কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল, যেন প্রতিপক্ষের ব্যঙ্গবিদ্রূপ তার কানেই ঢোকেনি। সে তো তখন জানে যে খেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিপক্ষের যাবতীয় আক্রমণ তারই উপর নেমে আসবে।অপরাধ? একটিই অপরাধ তার – চামড়ার রঙ কালো। রাগবির মতো নৃশংস খেলা পৃথিবীতে আর একটিও নেই, মুষ্টিযুদ্ধ এর কাছে শিশু। একশো বছর আগের সেই দিনগুলিতে রাগবির নিয়মকানুনও ছিল অনেক শিথিল। অদূর অতীতে রাগবির মাঠে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে গেছে। আর শ্বেতাঙ্গ প্রতিপক্ষের নির্দয় আক্রমণের শিকার তো আমাদের কাহিনির এই ছেলেটিকে বারেবারেই হতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হবে না। নীরবে বসে রইল সে, আর সময় হওয়ার পর চোয়াল শক্ত করে মাঠে নামল।
তার পরের ঘটনার সাক্ষী ছিল সেদিন মাঠে উপস্থিত পনেরো হাজার দর্শক। এগারো জন বাঘা বাঘা অল-অ্যামেরিকান টিমের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাজার মারধোর করেও উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে সেদিন কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারেনি। অবিশ্বাস্য ফল হল খেলার। একদল শ্বেতাঙ্গ সৈনিক "স্কুলের ছানাপোনা"-দের কাছে ১৪-০ গোলে ম্যাচ হেরে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়ল।
সেদিনের ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক পরবর্তী জীবনে তার খেলার মাঠ বদলে নিয়েছিল। রাগবি, বেসবল, বাস্কেটবল অথবা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের জগৎ ছেড়ে সে পা রেখেছিল সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত - সর্বত্রই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছিল সে, ঠিক সেদিনের রাগবি ম্যাচের মতোই। সংস্কৃতির জগতে সে হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পীদের একজন। বহু নাটক আর চলচ্চিত্রে সে অভিনয় করল, স্বদেশের এবং স্বজাতির গানের ডালি নিয়ে ঘুরে বেড়াল গোটা দুনিয়া। কিন্তু তারপর যখন সে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং দরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বসল, তখন তার মাতৃভূমির রাষ্ট্রনায়কদের টনক নড়ল -  যেভাবে হোক এই বেয়াদব ছেলেকে আটকাতে হবে!
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আটকানো গিয়েছিল তাকে। দেশদ্রোহী হিসাবে তাকে ঘোষণা করে তার গান গাওয়ার এবং অভিনয় করার সমস্ত রাস্তা একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল তার উপর। হ্যাঁ, এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের কণ্ঠস্বর চিরকালের মতো স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিল তারা। আর, অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি, যে-কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তার জীবনভোর লড়াই, শেষের দিনগুলিতে তাদেরও আর তার পাশে দেখা যায়নি।
আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি, নিজের প্রিয় শহর থেকে অনেক দূরে তাঁর দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কয়েক বছর কাটানোর পর শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন নিঃসঙ্গ পল রোবসন।
## দেবাশিস মৈত্র
তথ্যসূত্রঃ
1. Robeson, Paul. "Here I stand." Beacon Press, Boston. (1958)
2. Hamilton, Virginia. "Paul Robeson: the life and times of a free black man." Harper Collins. (1974)
3. Duberman, M. B. "Paul Robeson." Alfred A. Knopf. (1988).
4. Boyle, S. T. and A. Bunie. "Paul Robeson: the years of promise and achievement." University of Massachusetts Press. (2005)
5. Swindall, Lindsay R. "Paul Robeson: A life of activism and art." Rowman & Littlefield, reprinted 2015.
6. Horne, G. "Paul Robeson: the artist as revolutionary." Pluto Press. (2016)
সঙ্গের ছবিটি উপরের তালিকার চতুর্থ বইটি থেকে নেওয়া।
পল রোবসনের কণ্ঠে একটি নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের লিংক দিলাম। সঠিক জানি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় যে শেষ জীবনে দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে বাস করার সময় এই গানটি পল বারবার শুনতেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন