বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১

সংযুক্ত মোর্চা বনাম বিজেমূল ~ সুশোভন পাত্র

শাট আপ! ধর্ম নিরপেক্ষতার জ্ঞান কে দিচ্ছে? তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা? কিষানজীর কোয়ার্টার-হাফ-ফুল চামচারা? মার্কামারা বিজেপি? তাদের আদর্শগত বাপ সঙ্ঘ পরিবার? না চার আনার আইটি সেলের ভক্তরা? মুখে ঝামা ঘষে বলে দিন ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে বামপন্থীদের জ্ঞান দেওয়ার যোগ্যতা এদের কোনদিন ছিলনা। আজও নেই। পরেও থাকবে না। 
ধর্ম নিরপেক্ষতার জ্ঞান কে দিচ্ছে? সিমির দালাল আহমেদ হাসান ইমরানকে যারা রাজ্যসভার টিকিট দিয়েছিল? সিদ্দিকুল্লাকে মন্ত্রী বানিয়ে যারা ঠুমকা নেচেছিল? বরকতিকে যারা ব্রিগেডের মঞ্চে তুলে ভাঁজ দেওয়া সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল? না যারা, সরকারি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে 'জয় শ্রী রাম' শ্লোগান শুনে মুচকি হেসে রোয়াব নিয়েছিল? গেরুয়া পোশাকের ক্লাউন আদিত্যনাথ কে গতকাল মালদাতে দাঙ্গা লাগাতে চরতে ছেড়েছিল? প্রজ্ঞা ঠাকুরদের পুষে লোকসভা তে পা রাখতে শিখিয়েছিল? বামপন্থীদের ধর্ম নিরপেক্ষতা শেখাবে এরা? জাস্ট শাট আপ!     
ফেজ টুপির সিদ্দিকি বামপন্থীদের হাত ধরলে গায়ে ছ্যাঁকা লেগেছে? ISF-র সভাপতি শিমুল সোরেন। মুসলিম নন, আদিবাসী। ISF-র সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকেই তফসিলি জাতি ও অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ। তথাকথিত 'হিন্দু'। তবুও ফেজ টুপি দিয়েই দল চিনবেন, তাই তো? বেশ, চিনুন। রাজনাথ সিং মাথায় ফেজ টুপি পরলেও চিনুন, মোদী ভোটের আগের সলমান খানের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ালেও চিনুন, লকেট হাঁটু মুড়ে দোয়া চাইলেও চিনুন, আর মমতা হিজাব দিয়ে ইফতার পার্টি তে গেলেও চিনুন। আছে হিম্মত?   
আসলে বিজেমূলের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে ব্রিগেড। একদিকে 'যে গরু দুধ দেয় তার লাথ তো খেতেই হবে' বলে দিদি মুসলিম ভোট কুড়বেন, আর অন্য দিকে 'হিন্দু খতরে ম্যা' বলে বিজেপি হিন্দু ভোট কনসলিডেট করবে, রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে দাদা-দিদি মুজরা দেখবেন আর মিডিয়া আম্বানিদের পা-চাটার ব্লু প্রিন্ট রেডি করবে –প্ল্যান গুলো ভেস্তে যাচ্ছে? কি তাই তো?    
ভেবেছিলেন, ফেজ টুপি পরে আব্বাস সিদ্দিকি বক্তৃতা করলেই 'মোল্লাদের ব্রিগেড' বলে দাগিয়ে দেবেন! ভেবেছিলেন, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে দুধের দাঁত না ভাঙা সিদ্দিকি বক্তৃতার সময় একটা ফাউল করলেই লাল কার্ড দেখিয়ে দেবেন, ভেবেছিলেন আস্সালাম ওয়ালেকুম, ইনশাল্লাহ বা খোদা হাফেজ দিয়ে বক্তৃতা করবেন, ভেবেছিলেন মঞ্চের উপর থেকে না হোক নীচ থেকে কমপক্ষে আল্লা-হু-আকবর, নারায়ে তকবীর শুনবেন –প্ল্যান গুলো ভেস্তে গেছে? কি তাই তো? 
সিদ্দিকি থেকে দেবলীনা, সূর্য মিশ্র থেকে সেলিম হয়ে সীতারাম, ২৮শে-র ব্রিগেড জুড়ে রুজিরুটির কথা, চাকরির কথা, ধর্ম-জাত-বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িত শ্রেণীর কথা, বিকল্পের কথা –ঘাবড়ে গেছেন তো? বিজেমূল বিরোধী সমস্ত দলকে এক জায়গায় এনে সংযুক্ত মোর্চা গ্লুয়িং ফ্যাক্টর হিসেবে রকস্টার সিপিএম-র ভূমিকাকে দেখে চমকে চ হয়ে গেছেন তো? এতদিন তিল তিল করে গড়ে তোলা বাইনারি ন্যারেটিভটা ভেঙে যাচ্ছে দেখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তো? 
এসব একটু হবে! আগামী দু-মাস এরকম অনেক বাইনারি-টাইনারি, লেসার ইভিল-ফিভিলের ফান্ডা হুব্বা হয়ে যাবে। মানিয়ে নিতে অভ্যাস করুন। আব্বাস সিদ্দিকির পুরনো ভিডিও খুঁজে ক্যালোরি খরচা না করে, ২৪ বছরের তৃণমূলের ও তার সুপ্রিমোর ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে ছ্যাবলামির ইতিহাসটা দূরবীন দিয়ে দেখা অভ্যাস করুন। কামাল হাসানের ভূমিকায় সদমা সিনেমার শ্রীদেবীর মত 'লিবারেলদের' স্মৃতিশক্তির যত্ন নেওয়া অভ্যাস করুন।  
দেখবেন, দূরবীনে অতীতের প্রিজমে ধরা পড়বে, ৯২-র ৪ঠা ডিসেম্বর, অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা; সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে জনসভা ডাকল বামফ্রন্ট। আর সেদিনই সিধো-কানহু ডহরের সভায় মমতা বললেন, "সব সিপিএম'র ষড়যন্ত্র। বিজেপি অযোধ্যায় কিছুই করবে না।" মনে পড়বে, ৯৮-র লোকসভা ভোটে তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বিজেপি, আর ৯৯-এ এনডিএ-র শরিক মমতা হলেন রেলমন্ত্রী। ভেসে উঠবে, বিবিসি'র সাক্ষাৎকারে এক ভদ্রমহিলা নিঃসংকোচে বলছেন "বিজেপি তৃণমূলের ন্যাচারাল অ্যালি"। দাঙ্গা পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর মোদী কে অভিবাদন জানিয়ে পুষ্পস্তবক পাঠাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। কিম্বা দিল্লিতে 'পাঞ্চজন্য'র অনুষ্ঠানে সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে যিনি বলেছিলেন, ''আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনারা দেশকে ভালোবাসেন' -তার নামও মমতা ব্যানার্জি। গদগদ আরএসএস নেতারা যাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ''হামারি পেয়ারি দুর্গা" -তার নামও মমতা ব্যানার্জি।  
বামপন্থীরা সময়ের দায়িত্ব জানে। 'One Step Forward, Two Steps Back'-র গুরুত্ব বোঝে। সিপিএম'র হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে "কী করিতে হইবে" সে বিষয়ে প্রতিদিন হোয়াটস-অ্যাপে দু-মুঠো উপদেশ দেওয়া টেক্সাসের টেকনোক্র্যাট, ফেসবুকে পার্টি-লাইনের অন্তঃসার শূন্যতার গবেষক লন্ডনের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, পার্টির অভূতপূর্ব দিশাহীনতায় মাথায় হাত রাখা সাংবাদিক, 'সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি' নিরাময়ের ১০৮ প্রকার ওষুধ নিয়ে হাজির সবার থেকে একটু বেশি লেনিন জানা, একটু বেশি মার্ক্স বোঝা তাত্ত্বিক, সংশোধনবাদ কে 'প্রকৃত বিপ্লবের' শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া কফি হাউসের সিগারেটখোর বিপ্লবী  -এদের সামনে দাঁড়িয়েই ১০০ বছরের বেশি পথ চলছে সিপিএম। এবারও চলবে। 
অভাব-অভিযোগ-কুৎসা-অপপ্রচার-আলোচনা-সমালোচনার বিষমসত্ততা নিয়েই সিপিএম। সাংগঠনিক সাফল্য কিম্বা ব্যর্থতা, নির্বাচনী জয় কিম্বা পরাজয়, আদর্শ বোধের বিচ্ছুরণ কিম্বা বিচ্যুতি এই সব কিছুর বৈপরীত্য নিয়েই সিপিএম। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ চলায় রাজনৈতিক ও মতাদর্শ গত এই আক্রমণের আগুনে জ্বলে পুড়েই ইস্পাত কাঠিন্যে বলিয়ান আজ সিপিএম। রাশিয়ান দার্শনিক নিকোলাই চেরনিশেভেস্কি কে উদ্ধৃত করে লেনিন বলতেন "কমিউনিজমের পথটা সেন্ট পিটার্সবার্গের সবচেয়ে লম্বা এবং সুসজ্জিত নেভস্কি প্রস্পেক্টর রাস্তার মত সহজ সরল আর প্রশস্ত নয়। বরং কণ্টকাকীর্ণ"। ঐ কণ্টকাকীর্ণ পথেরই পথিক সিপিএম।
দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে সিপিএম মৌলানা হসরৎ মোহানী এবং অপরজন স্বামী কুমারানন্দ মিলিয়ে দিতে শিখেছে। "Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people"- বুঝতে শিখেছে। সিপিএম চিনছে, মৌলবাদীদের। চিনেছে সাম্প্রদায়িকদের। চিনেছে ধর্মপ্রাণ কিম্বা ধর্মভীরু সাধারণ মানুষদের। 
সিপিএম স্বপ্ন দেখে এমন একটা সমাজের যে সমাজে, টিকি কিম্বা দাড়ি, সবাই থাকবে মিলে মিশে, সবাই থাকবে নিজের মত।  নাস্তিক কিম্বা আস্তিক সবাই বাঁচবে রাজার মত। যে সমাজে ধর্ম পালনের অধিকার থাকবে। ধর্ম কে নিয়ে হাসাহাসি করার অধিকারও থাকবে। শিল্পী ঈশ্বর কে নিয়ে ব্যাঙ্গ চিত্র আঁকবে। ভগবানের শুঁড় কেন, চারটে হাত কেন, তিনটে মাথা কেন –যুক্তিবাদীরা প্রশ্নও করবে। দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙে দেওয়ার লোক প্রশাসন চালাবে। যে সমাজে ধর্মচারণ হবে ব্যক্তিগত। যে রাষ্ট্রের কাজ, সরকার পরিচালনা হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। 
৭৭-র বামফ্রন্ট সরকার হয়েছিল ৫ মিনিটের সিদ্ধান্তে। ৫২% আসন জনতা দল কে ছেড়ে দিয়ে সেবারও প্রকৃত জোট ধর্মই পালন করেছিল বামফ্রন্ট। রাজি হননি জয়প্রকাশ। পড়ন্ত বিকেলে ৫ মিনিটের সিদ্ধান্তে প্রমোদ দাশগুপ্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন ৫২% বেশি এক ইঞ্চি জমি ছাড়বেনা বামফ্রন্ট। ভেস্তে যায় জোট, ৭৭-র নির্বাচনে ১০০% আসনেই প্রার্থী দেয় বামফ্রন্ট। বাকি লড়াইটা হয়েছিল বুথে। বাকিটা লেখা আছে ইতিহাসে। 
রাজ্য রাজনীতি আরও একটা ঐতিহাসিক কঞ্জাংচারে দাঁড়িয়ে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। 'Concrete analysis of the concrete situation'- আরও একবার প্রকৃত জোট ধর্মই পালন করছে বামফ্রন্ট। সিদ্ধান্ত ভুল বা ঠিক হয় না। সিদ্ধান্তকে ভুল বা ঠিক প্রমাণ করতে হয়। তাই এবার ব্রিগেড যাবে বুথে। আগামী দু-মাস সংগ্রামের। আগামী দু মাস লড়াইয়ের। আগামী দু-মাস লেখা থাকবে ইতিহাসে।  
পাড়ার কুকুরটা খেপেছে। যাকে তাকে কামড়ে বেড়াচ্ছে। কুকুরের নাম বিজেমূল । মুগুরের নাম সংযুক্ত মোর্চা। পাগলা কুকুর কে মারবে যারা সব্বাই তারা এক দলে। এবার আপনি ঠিক করুন। কুকুরের সাথে থাকবেন, না মুগুরের। আমরা দাঁড়িয়ে আছি আপনার পাড়ার মোড়ে। পাগল কুকুর কে ঠাণ্ডা করার ডাণ্ডা নিয়ে। উন্নত বিকল্পের সরকার গড়ার ঝাণ্ডা নিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন