শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

সন্দেশখালির সাতকাহন ~ রাধাবল্লভ রায়


রায়মঙ্গল-কলাগাছি নদীর কূল ধরে সন্দেশখালির মণিপুর, আতাপুর, ধুচনিখালি, শীতলিয়া। এগুলি একটু পুরনো আবাদ। ওই ধরুন, গত শতকের প্রথম দিকে বা তার একটু আগে আবাদ হয়েছে। লট অঞ্চল। কলকাতার বাবুদের পয়সায় বন-জঙ্গল কাটা হয়েছিল। দারুণ জমি সব। ধান হতো দেখার মতো। বছর সাত-আট আগেও সবুজ ধানের ক্ষেতে মায়াবি ঢেউ খেলে যেত। কিন্তু এখন সে সব নেই প্রায়। সবুজ ধানক্ষেতের জায়গায় ঘোলা-বোবা জল। সেই জলের বুকে ঢেউ ওঠে ঠিকই। কিন্তু সেখানে আকাশের ছায়া পড়ে না, সবুজশাড়ি পরা গ্রাম পুকুরের জানালায় উঁকি মারে না। বোবা-বধির ফিসারি মাঠ। অদ্ভুত এক আঁধারের মধ্যে সে শুধু টাকা প্রসব করে। কোটি কোটি টাকা। সে টাকার কোনও মা-বাপ নেই। জারজ। কিন্তু জারজ হলে কী হবে রাজা-বাদশারা তার কদর বোঝেন। এককালে এখানকার গরিব চাষিদের ঘামরক্ত ভেজা খাজনার পয়সায় জমিদারবাবুদের নাচমহলের ঝাড়বাতি গৌরব ছড়াত। কল্লোলিনী কলকাতায় টাকা উড়ত। আর এখন সন্দেশখালি-গোসাবার পাড়ায় পাড়ায় নাচমহল। ডান্স হাঙ্গামার মত্ত আসরে টাকা ওড়ে। জারজ টাকা। পাড়ায় পাড়ায় রাজা-বাদশা। ঘরে ঘরে শাহাজাদা। বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে নাচনি আসে জুয়ামেলার জলসায়। সেখানে টাকা উড়িয়ে কোমর দোলান পঞ্চায়েত প্রধান, ডিলারবাবু, সমিতির নেতা থেকে ভেড়িমালিক সবাই। কম যান না পরিযায়ী শ্রমিকেরাও। আলোর ঝলকানির সঙ্গে ডিজে মিউজিক ডুম ডুম। তন্বী নৃত্যপটিয়সীর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জারজ বেহিসেবী টাকার চুম্বন, শীৎকার। তারপর অদ্ভুত অশ্লীল এক আঁধারের মধ্যে টাকাদের পাখনা হয়। তারা নতুন মহলবাড়ির চিলেকোঠায় উড়ে যায় সুখসন্ধানী কবুতরের মতো। আর জুয়ার নেশায় ফতুর হয় চাষির সন্তান। হারিয়ে যায় আবাদি মাটির নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। লোনাজল আর মাদকজল পাল্লা দিয়ে মুছে যায় সন্দেশখালির কয়েক প্রজন্ম ধরে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি।  এবারে সর্বার্থে সর্বহারা হয় কৃষক। নিভে যায় তাঁদের কঠিন সংগ্রামের কথা। যে সংগ্রাম এগিয়ে চলেছিল আলোর পথে। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির পথে।

      সন্দেশখালির ভুবন মণ্ডলের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমার বাড়ি সন্দেশখালি নয়। তবু ভুবন মণ্ডলকে আমি চিনি। সরকারপাড়ার ভুবন মণ্ডলের বয়স এখন সাতাত্তর। খুলনা জেলার পাইকগাছা থেকে এদেশে যখন এসেছিল তখন ওর বয়স ছিল সতেরো। হজরতবাল মসজিদের ঘটনা নিয়ে ওদেশে গোলমাল শুরু হতে ১৯৬৪ তে ওরা সপরিবারে হাসনাবাদে এসে ঠাই নিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে দণ্ডকারণ্য। কিন্তু ভুবন বাবা-মায়ের সঙ্গে যায়নি। শীতলিয়ার বাছাড় বাড়িতে গরু রাখালির কাজে ভর্তি হয় সে। বাছাড়েরা ধনী লোক। তিন-চারশো বিঘে জমি। ভুবন প্রথম বছর পেটেভাতে কাজ করত। তারপর এক সন্ধ্যায় নিতাই বাছাড়ের গিন্নিকে মা বলে ডাকায় ওর পদোন্নতি হয়। পেটেভাতের রাখাল থেকে মাহিন্দার। ছয়-সাত মণ ধানে সারা বছর খেটে দিত বাবুর বাড়ি। বেশি বেশি খাটত। বাবুরা সন্তুষ্ট হত তাতে। যা কিছু ইনকাম হত সব থাকত নিতাই বাছাড়ের গিন্নির কাছে। বছর চার-পাঁচ কেটে যায় এমনিভাবে। কিন্তু কথায় আছে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটল একটা। এক রাতে বাছাড় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। লুঠ হয়ে গেল টাকা-পয়সা সোনাদানা। রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যায় অত বড় বাছাড়বাড়ি। মুখ শুকিয়ে গেল ভুবনের। তিল তিল করে জমানো হাজার কয়েক টাকা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। জমি কিনবে, বিয়ে করবে। মা-বাবাকে দণ্ডকারণ্য থেকে বাংলায় আনবে। কিন্তু সে সব আর বোধহয় হল না। ভাগ্যলক্ষ্মী তার প্রতি কি এতটাই নির্দয় হবে! মাথার মধ্যে দলাপাকানো একটা চিন্তা টন টন করে ভুবনের। কিন্তু দুর্ভাগ্য একা পথ চলে না। সৌভাগ্যও তার পিছনে থাকে।

      এক সকালে অদ্ভুত এক আলো ভাদুরে ধান ক্ষেতে খেলা করছিল। ভুবন সেদিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। বাছাড়গিন্নি দোতলার জানালা থেকে দেখতে পায় তাকে। সেইদিন দুপুরে ভুবনের ভাগ্য ফেরে। একসঙ্গে অনেকটা আলো যেন তার দুর্গম যাত্রাপথটি সুগম করে দেয়। সন্দেশখালির সরকার পাড়ায় বাছাড়গিন্নির বাপের বাড়ি। কুসুম তার খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে। ভুবনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন তিনি। বিস্ময়ভরা চোখে সে ফিরে তাকাতে বাছাড় গিন্নি বলেছিলেন, " সাত নম্বরের কলোনিখাল পাড়ের চারবিঘে জমি তুই নে। সংসারধর্ম কর। তিনবিঘে জমি তোর টাকায়, আর এক বিঘে আমার আশীব্বাদ। যা।" ভুবন গিন্নিমাকে ঢপ করে একটা প্রণাম করতে বাছাড়গিন্নি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, "সবসময় আলোর পথে থাকবি। আঁধারে হাঁটবি না। তাহলি শান্তিতে থাকবি দেখিস। এইটি আমার পরামশ্য।"

      সে বছর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল। আর ভুবন শুরু করল নতুন জীবন। বাড়ি করল, বিয়ে করল, মা-বাবাকে মানা ক্যাম্প থেকে নিয়ে এল। তারপর অনেক কাল কেটে গেছে। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে ভুবনের। নিজে হাতে তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। জমির পরিমাণও বাড়িয়েছে কয়েক বিঘে। এখন সে বৃদ্ধ। খাটাখাটনি করতে পারে না আর। বড় ছেলের কাছে থাকে। কিন্তু মনে তার শান্তি নেই। তাহলে কি আলোর পথ থেকে সে বিচ্যুত হয়েছে? অথচ সারাজীবন বাছাড় গিন্নির দেখানো পথেই তো থাকতে চেয়েছে সে। নাতি-পুতিদেরও এগিয়ে দিতে চেয়েছে সেই পথে। তারা লেখাপড়া করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, জগতকে চিনুক। কিন্তু এইখানে ঘটে গেছে বিভ্রম। নতুন সময়ে ভুবনের ছেলেমেয়ে এবং নাতিপুতিরা কোন পথে চলেছে সে আর বুঝতে পারে না। ওরা জমি বোঝে না, টাকা বোঝে। শিক্ষা বোঝে না, স্ট্যাটাস বোঝে। শান্তি বোঝে না, ক্ষমতা বোঝে। সিভিক ভলেন্টিয়ার হয়েছে একজন। মোটরবাইকে গাঁক গাঁক করে ছোটে আর পাড়াসমেত চমকায়। পার্টির মিছিলে হাঁটে আর বোতল বোতল মদ খায়। পঞ্চায়েতবাবুদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। মান্যিগণ্যি করে লোকে। ভুবন এটাকে আলো বলবে না আঁধার বলবে বুঝে পায় না। অনুদানের টাকায় পাকা বাড়ি বানিয়েছে সেই নাতি। একটা নয়, দু-দু'খানা। কিন্তু বাড়ির মধ্যে লক্ষ্মীশ্রী নেই, শান্তি নেই। শান্তি নেই ভুবনের মনেও। জমিগুলো চলে গেছে সেখবাবুদের ফিসারিতে। লোনাজল তো বারণ মানে না কোনও। এক ঘেরিতে দু-চারজন রাজি হয়ে গেলে বাকি সকলের কপাল পোড়ে যে। ভুবনের সেই আলোর পথ, সাত বিঘে জমিও এখন লোনাজলের তলায়। কী করবে ভুবন?

      সাত বিঘে জমি থেকে লিজবাবদ বছরে আয় বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। দুই কিস্তিতে দুই ছেলে নগদানগদি বুঝে নেয়। ভুবন কিছুই বলতে পারে না। যে জমির সঙ্গে তার জীবন জড়িয়ে সেই জমি আর নেই ভাবতে গিয়ে কষ্ট হয় তার। কিন্তু নিরুপায় সে। সময়কে মেনে নিতেই হয়। চাষবাস উঠে যেতে ওর ছেলেরা এখন সংসার ছেড়ে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। বিল্ডিং-এর কাজ করে। মাসে মাসে টাকা আসে বৌমাদের একাউন্টে। আবার সরকারি অনুদান আছে। মাসে মাসে রেশনের চাল, আয়লার চালও। ঘরে ভাতের অভাব নেই। তবু কোনও এক অজানিত কারণে বুকটা ধড়ফড় করে তার। সামনে কোথাও আলো দেখতে পায় না সে। নাতিরা বলে, "এ বুড়ো জমি জমি করে মরলো যে! বুদ্ধি হবে কবে তোমার? শ্মশানে গেলি? ভাবতি পেরেছিলে কোনওদিন পাকা ঘরে শোবে?" ভুবন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

      ভুবনের বড়ছেলের ছোট মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে বিয়ে করেছে। শরীর হয়নি, তবু শাঁখা-চুড়িতে ঠমক দেয়। মেজ মেয়েটা ডান্স হাঙ্গামার দলের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তারপর বিহারের এক যৌনপল্লিতে তার খোঁজ মেলে। কিন্তু বাড়িতে ফেরানো যায়নি আর। ফিসফাস কানে এসেছে, মেয়েবাবদ এক লাখ টাকা পেয়েছে বড় ছেলে। সেই টাকায় ফ্রিজ আর রঙিন টিভি কিনেছে বড়বৌমা। ভুবন কিছু বলে না, শুধু দেখে। কেননা সে বুঝতে পারে না এগুলো আলো নাকি অন্ধকার। ছোট ছেলের ছেলেমেয়ে দুটো বই-খাতার বদলে রাতদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। হাসি-কান্না সব সেখানেই। খেলার মাঠ ছেড়ে ওরা মোবাইলে মজে থাকে। ছোট বৌমা কিছু বলতে দেয় না। এগুলি শেখা নাকি দরকার। এখানেও ভুবন নিরুপায়। আলো নাকি আঁধার সে ধোঁয়াশা ঘোচে না তার কিছুতেই। ছোট বৌমা গ্রামে হনুমান মন্দির বানানোর জন্য চাঁদা তোলে পাড়ায় পাড়ায়। কখনও মনে ভেবেছে ওটাই বোধহয় আলো। কিন্তু দু-চারদিন ছোট ছেলের বাড়িতে থাকার পর তার মোহভঙ্গ হয়েছে। এপাড়ার নতুন নেতা বিপ্লব হাজরার সঙ্গে ছোটবৌমা কলকাতায় যায় প্রতি সপ্তায়। ছেলের অনুপস্থিতিতে সে-ই এ বাড়ির মালিক। রাত কাটায় এবাড়িতে। গ্রামের লোকে পাঁচ কথা শোনায়। কিন্তু ভুবন বুঝে উঠতে পারে না আলো নাকি অন্ধকার। তাই কিছু বলা হয় না তার। ধানমাঠের লোনাজলের মতো অশান্তির ঢেউ রাতদিন ফেনা তোলে তার মুখের কাছে, বুকের কাছে। গ্যাস্ট্রিকের চুয়া ঢেকুরে পেট জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়। একটা লাঠি হাতে খালপাড়ে বসে শুকনো মাটির গায়ে দাগ কেটে যায় সে সকাল-বিকেল।

      ভুবনকে চেনা লাগতে পারে আপনাদের অনেকের। এত নিচে দৃষ্টি পড়ে না তো, তাই হয়ত মনে থাকে না। কিন্তু দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। গত কাল থেকে গ্রামে হরি নামের মহোৎসব চলছে। আটখানা মাইকের আওয়াজে হরিনাম হুঙ্কারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ফিসারি জলার বুকে। একবার হরি নামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে। হাজার হাজার মানুষ দু'বাহু তুলে নাচছে ওখানে। একে অপরকে জড়িয়ে জড়িয়ে কাঁদছে। ওই দলের মধ্যে ভুবন আছে নিশ্চয়ই। আলোর পথ খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা ওখানে অশ্রুধারায় গড়িয়ে পড়ছে জানি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন