লোয়ার সার্কুলার রোডে কলকাতার সবচেয়ে ধনী পার্সি সদাগর রুস্তমজী কাওয়াসজী বানাজী এক বিরাট বাগান বানিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকার মত বাড়ি। গৃহ প্রবেশের দিন বল নাচ, বাই নাচ হয়েছিল। এসেছিলেন স্বয়ং বড়লাট লর্ড অকল্যান্ড। এই বাগানবাড়িতেই ১৮৫২ সালে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর বড় ছেলে মানেকজী রুস্তমজী এই বাড়ি থেকেই ব্যবসা চালাতেন। ১৮৭৪ সালে তাঁকে কলকাতার শেরিফ করা হল। তিনিও এই বাড়ি, এই বাগান ছেড়ে উঠে এলেন সাহেবপাড়ায়। সেই বাগানবাড়ি ভাড়া নিয়ে হিন্দুমেলার আয়োজন শুরু হল। ১৮৭৬ সালে পটলডাঙ্গার বসুমল্লিক পরিবারের দীননাথ এই বাগান কিনে নেন। কিন্তু আগের মালিকের নাম অনুসারে পার্সিবাগান নামটুকু রয়ে যায়। আর আশেপাশের এলাকা মানেকজির নামে মানিকতলা নামে ডাকা হত।
বসুমল্লিকরা এই বাগান ধরে রাখতে পারেন নি। তাঁর দুই ছেলে নগেন্দ্র আর যোগেন্দ্র মিলে এই বাগান যখন কালীকৃষ্ণ ঠাকুরকে বিক্রি করেন তখনই এর মৃতপ্রায় দশা। ১৮৯৮ সালেই ইন্দিরা দেবীর প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে লেখেন-
কাল ওঁরা একদল... একটা কি প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন – পার্সিবাগান - নামটা অনেকদিন থেকে শুনে আসছি, কিন্তু কখনো দেখিনি। শুনলুম খুব জাঁকালো মস্ত ব্যাপার, যদিও অযত্নে পড়ে আছে ঘরের অবধি নেই, সর্বত্র মার্বেল পাথর বসানো, কেতাদুরক্ত বাগান, ফোয়ারা, ফুলের গাছ ইত্যাদি যেমন বাদশাহী কাণ্ড হতে হয়।
ধীরে ধীরে এই বাগান নষ্ট হয়ে বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যায়। প্রায় দশ বারো বছর এর নাম কেউ শুনল না।
আচমকা ১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার দিন আদর্শের বিরোধে তারকনাথ পালিত মশাই কারিগরী শিক্ষার জন্য এক আলাদা সংস্থার প্রস্তাব দিলেন। ভোটাভুটি হল। তিনি তাঁর সমর্থকদের নিয়ে আলাদা বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল খুলবেন বলে ঠিক করলেন। করলেন তো বটে, কিন্তু খুলবেন কোথায়? সেই কাজেই ৩০০ টাকা মাসিক ভাড়া দিয়ে পার্সিবাগানের পড়ে থাকা বাগানবাড়ি ভাড়া করা হল। ১৯১২ সালের শেষের দিকে এটি পঞ্চবটি ভিলায় চলে গেলে আশুতোষ মুখুজ্জের সহায়তায় পার্সিবাগানের জমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়। সেখানে স্থাপন করা হয় সায়েন্স কলেজ।
আর সেই টেকনিক্যাল স্কুলের কি হল? ১৯২৪ সালে সেটি স্থানান্তরিত হল যাদবপুরে। এই যাদবপুর আবার সোনারপুরের জমিদার যাদবচন্দ্র সরকারের নামে।
কিন্তু যাদবপুরেই কেন? আসলে আধার প্রস্তুত ছিল আগেই। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এখানেই প্রতিষ্ঠা করেন Indian Association For The Cultivation Of Science , ১৯০৬ তে রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক , ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী ও অন্যান্যদের বদান্যতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হয় । যে যাই হোক, নতুন কলেজের নাম হল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলোজি। স্বাধীনতার পরে সেটাই আজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
সঙ্গে রইল সরকারী আদেশনামার প্রথম পাতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন