বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো ~ মৌমিতা তারণ

সময়টা তখন তৃতীয় শতক। আমার প্রিয় শহর রোম শাসিত হচ্ছে সম্রাট ক্লডিয়াসের খেয়ালখুশিতে। শহরবাসী মোটেই খুশি নয় তাদের স্বৈরাচারী সম্রাটের উপর। আর দশজনের মতো আমিও ক্লডিয়াসকে পছন্দ করতাম না। কেন করতাম না সেকথা আজ তোমাদের শোনাব। তার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই। 

আমি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। হ্যাঁ সেই ভ্যালেন্টাইন যার নামে গোটা একটি দিন বিশ্ব সংসার প্রেমদিবস পালন করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ---ভ্যালেন্টাইন'স ডে। চার্চের একজন পুরোহিত হিসেবে আমার সবথেকে প্রিয় কাজ ছিল দুটি প্রেমিক মানুষকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা। দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটানো। বলা ভাল মানুষকে প্রেমিক করে তোলাই আমার মূলমন্ত্র। আমৃত্যু আমি আমার এই মূলমন্ত্র আঁকড়ে থেকেছি। এর ফলে ওরা আমায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভ্যালেন্টাইনকে সরালেও পৃথিবীকে ওরা প্রেমহীন করতে পারেনি। আজও 'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে...।' এই রে ! রবি ঠাকুরের বলা কথা আমি তোমাদের শোনাচ্ছি। কোনও মানে হয় ! অবশ্য শোনাব নাই বা কেন ? রবি তো শুধু তোমাদের কবি নন। বিশ্ব তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বিশ্বকবি। এই রবির কল্পনাই তো একদিন লিখেছিল, 'প্রেমের জোয়ারে, ভাসাব দোহারে....।' আমি জানি সারা পৃথিবী এমনই প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চায়। আমার মৃত্যুদিনটি প্রেমের দিন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আরও একবার প্রমাণিত হল প্রেম চিরন্তন। তাকে নি:শেষ করার মতো শক্তি এখনও জন্মায় নি। তবে প্রেমের উপর আঘাত এসেছে বারে বারে। সম্রাট ক্লডিয়াস এমনই এক আঘাতকারী। 

নিজের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য ক্লডিয়াস সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ করলেন। তাঁর মনে হয়েছিল বিবাহিত পুরুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায় না। সম্রাটের এহেন নিষেধাজ্ঞা যুবসমাজের কাছে অমানবিক ঠেকে। ওই হঠকারী নির্দেশে আমিও হতবাক হয়ে পড়ি। পরস্পরের হাত ধরে প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চাওয়া মুখগুলো মনে করে আমি কষ্ট পাই । পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না ক্লডিয়াসের এই খামখেয়ালিপনা মেনে নিতে। বেশ বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। প্রতিবাদ করা দরকার। এবং তা এখনই। কিন্তু সম্রাটের ক্ষমতার সামনে চার্চের এক পুরোহিতের ক্ষমতা আর কতটুকু ? তাই হাতিয়ার করলাম সেই প্রেমকেই। প্রেম দিয়েই প্রেম বাঁচিয়ে রাখতে চাইলাম। আবার শুরু করলাম দুই প্রেমিককে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার মতো পবিত্র কাজ। তবে এবার খুব গোপনে, খুব সন্তর্পণে। ভাবতে পারো চার্চের ভেতর গোপন এক জায়গায় শুধুমাত্র একটি মোমের আলো। তার সামনে বর, কনে আর আমি। আমি ফিসফিস করে বিবাহমন্ত্র আওড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে দু'জোড়া ঠোঁট সেইমতো ফিসফিস করছে। আমি কেবল ওদের ঠোঁট নড়া আন্দাজ করতে পারছি। আমার দুই কান সজাগ। এই বুঝি শোনা যাবে সম্রাটের সেনাদলের বুটের আওয়াজ। সে এক উত্তেজনাময় পরিবেশ। ভয় আর ভালবাসার মিশেল যেন। তবে বেশিদিন পারা গেল না এভাবে। সত্যিই একদিন চার্চের মেঝে কেঁপে উঠল ক্লডিয়াস সেনার পদধ্বনিতে। সেদিনও ছিল এমন এক বিয়ের দিন। অবশ্য ভগবান সহায় ছিলেনন। ছেলেমেয়ে দুটো ঠিক সময়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সেনারা কেবল আমায় পেল এবং নিয়ে গেল আমায় জেলকুঠুরিতে। শাস্তি ঘোষণা করল ক্লডিয়াস --- মৃত্যুদণ্ড। কী ভাবছ ? আমি হেরে গেলাম ? উঁহু, একেবারেই না। প্রেমের পূজারী ভ্যালেন্টাইনরা কখনও হেরে যায় না।

সেই অন্ধকার জেলকুঠুরিতে আমার কাছে প্রেমের আলো বয়ে নিয়ে এল শহরের অজস্র তরুণ - তরুণীর পাঠানো ফুল, ভালবাসার চিরকূট এবং' সে '। আমাকে পাহারা দিত যে রক্ষীটি সম্ভবত সেও ছিল এক তুখোড় প্রেমিক। নয়তো আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য নিজের মেয়েকে সে অনুমতি দেবে কেন !! মেয়েটি প্রতিদিন আমার কাছে আসতো। বসতো আমার পাশটিতে। আমরা গল্প করতাম। ঘড়ির কাঁটায় খেয়াল রাখিনি কখনও। মনে হত, গল্প তো এখনও শুরুই হল না। এইমাত্র তো এল আমার প্রিয়া। হ্যাঁ ও ছিল আমার প্রিয়া। ওর হাসি, ওর কথা, ওর চাউনি আমার উদ্যম নষ্ট হতে দেয় নি। ক্লডিয়াসকে অস্বীকার করে যে আমি ভুল করি নি সেকথা বারে বারেই ও মনে করিয়ে দিত।

শেষ পর্যন্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৬৯ এ. ডি. দিনটির মুখোমুখি হলাম। আর কিছুক্ষণ পর ক্লডিয়াসের সেনা আসবে। পালন করবে তারা সম্রাটের নির্দেশ। কার্যকর হবে আমার মৃত্যুদণ্ড। প্রিয়ার সঙ্গে আজ আর দেখা হওয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু ওকে না জানিয়ে আমি যাই ই বা কি করে ! এদিক ওদিক খুঁজলাম। এক টুকরো কাগজও কোথাও নেই যার উপর আমি ওর জন্য কিছু লিখে যেতে পারি। অগত্যা ওর রেখে যাওয়া কালকের চিরকূটটা হাতে তুলে নিলাম। এই টুকরো কাগজে গতকাল ও আমার জন্য একমুঠো ভালবাসা লিখে এনেছিল। সেই ভালবাসার অপর পিঠে ওর জন্য আমার ভালবাসার প্রতিধ্বনি রাখলাম আমি। লিখলাম, "লাভ, ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন।"

আমাদের পরস্পরের ভালবাসা বিনিময়ের এই স্টাইল সেদিনের পর থেকে পৃথিবীর সব প্রেমিক প্রেমিকা রপ্ত করল। জানি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। কাগজ কলম হয়ত সেভাবে আর আঙুলের স্পর্শ পাবে না। কিন্তু মোবাইল কিপ্যাড বা স্ক্রিন টাচ করতে আঙুল কসুর করবে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমার মৃত্যুদিন হিসেবে কোনও প্রেমিক মনে রাখে নি। তাদের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি মানে ভ্যালেন্টাইন'স ডে। আর ভ্যালেন্টাইন মানেই প্রেম, প্রেম এবং প্রেম। পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকের কাছে এক্কেবারে হেরে ভূত সম্রাট ক্লডিয়াস। তবে আর চুপ কেন ? এস সবাই মিলে আমরা ক্লডিয়াসকে দুয়ো দিই --
" হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো "।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন