শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

ডাক্তারবাবুর মেস ~ অর্ক ভাদুরী

110 College Street

১১০ নম্বর, কলেজ স্ট্রিট।

বি বি গাঙ্গুলি মোড়ের শহীদবেদী ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ছানাপট্টির প্রায় গা ঘেঁষে এই তিনতলা বাড়িটা। ১৯১১ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত এর তিনতলায় ছিল 'ডাক্তারবাবুর মেস'। ডাক্তারবাবু মানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে থাকতেন না বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে ক্লাস শেষ হলে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে তাঁর ঘোড়ায় টানা গাড়ি এসে দাঁড়াত এই মেসবাড়ির দরজায়। এখানে থাকতেন মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সেন, ক্ষিতীশচন্দ্র সেন-সহ জনা পনেরো তরুণ। সকলেই প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র বা ছাত্রস্থানীয়।


মেঘনাদ সাহা ১৯১১ সালে ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড হয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসে প্রথমে থাকতে শুরু করেন ইডেন হিন্দু হস্টেলে। কিন্তু 'ছোট জাত' হওয়ায় সেখানে তাঁকে নানাবিধ হেনস্থা সহ্য করতে হত। একসঙ্গে খেতে চাইতেন না বাকিরা, বারান্দার এক কোণে বসে খেতে হত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুদিন পরে তাই তিনি উঠে এলেন ১১০ নম্বর মেসবাড়িতে। এখানে আর কোনও সমস্যা রইল না, সকলেই হাতে হাতে কাজকর্ম করতেন- রান্না করা, বাজার করা, বাটনা বাটা- সবই নিজেদের দায়িত্বে।

প্রতিদিন বিকেলে প্রফুল্লচন্দ্র তো আসতেন বটেই, সঙ্গে আসতেন বঙ্গবাসী কলেজের প্রিন্সিপাল গিরিশচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথের সহকর্মী সত্যানন্দ বসু, জবাকুসুম তৈল প্রতিষ্ঠানের উপেন্দ্রনাথ সেন-সহ একঝাঁক দিকপাল। ছাত্রসম মেঘনাদ সাহাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা চলে যেতেন ময়দানে, লর্ড রবার্টের মূর্তির (১৯৬৯ সালে অপসারিত) নিচে। সেখানে প্রায় ঘন্টা দু'য়েক ধরে চলত নির্ভেজাল আড্ডা- যুদ্ধ থেকে রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে ফুটবল- সবকিছু নিয়েই  প্রাণখোলা তর্কবিতর্ক, হাসিঠাট্টা। গড়ের মাঠের এই আড্ডার খবর রাখতেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধিও। তিনিই নাকি এই আড্ডার নাম দিয়েছিলেন 'ময়দান ক্লাব'। বলা বাহুল্য, আড্ডার মধ্যমণি ছিলে স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্র।


জমজমাট এই মেস-বাড়িতে আর একজনও ছিলেন নিয়মিত অতিথি। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বাঘা যতীন। ততদিনে তিনি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছেন। এর ফাঁকেই মাঝেমধ্যে হাজির হতেন বন্ধু মেঘনাদ সাহার মেসে। সময় পেলে মেঘনাদের ভাই কানাইলালকে ইংরেজিও পড়াতেন।

একদিন খবর এল মেস থেকে বেরিয়ে যতীন্দ্রনাথ আহিরিটোলায় এক পুলিশ অফিসারকে গুলি করে পালিয়েছেন। ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে তুমুল উত্তেজনা! মেস থেকে বেরনোর সময় যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল জ্ঞানচন্দ্রের নাম লেখা একখানা বই। যদি কোনও কারণে পুলিশ বাঘা যতীনকে ধরতে পারে, তাহলে তো মহাবিপদ! মেসবাড়ির বাসিন্দারাও রক্ষা পাবেন না।


সেই যাত্রা অবশ্য যতীন্দ্রনাথের নাগাল পায়নি পুলিশ। তবে এই মেস-বাড়িতে আর কখনও আসা হয়নি তাঁর।এর কিছুদিন পরেই বুড়িবালামের তীরে নিজের রক্ত দিয়ে তিনি লিখবেন নতুন ইতিহাস। সেটা ১৯১৫ সালের অগস্ট মাস।

ওই বছরেই মেঘনাদ সাহা এম এস সি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হলেন, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তারপর আরও কিছুদিন ওই মেস-বাড়িতেই ছিলেন সকলে। তখনও মেঘনাদ সাহা চাকরি পাননি, একটা সাইকেলে করে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে চড়কিপাক খেয়ে তিনটি টিউশন করতেন। চাকরি পেলেন পরের বছর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতের অধ্যাপনা। মেসের বাকি আবাসিকরাও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সিট তো আর ফাঁকা থাকে না, নতুন আবাসিকেরা আসতে শুরু করলেন।

ডাক্তারবাবুর মেসের সোনার দিনগুলি শেষ হয়ে গেল।


লকডাউনে পুরনো কলকাতার খোঁজখবর নিচ্ছি ঘুরে ঘুরে। সুনীল মুন্সির বইতে এই বাড়িটার কথা প্রথম পেয়েছিলাম। তারপর ডোয়ার্কিনের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়েও দেখলাম ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের উল্লেখ। একদিন দুপুরবেলার পৌঁছে গেলাম বাড়িটায়। বাইরে রঙের প্রলেপ, ভিতরটা ঘুপচি, অন্ধকার। সিঁড়িতে বিকট গন্ধ। দো'তলায় পাইপ মার্চেন্টদের দোকান, তিনতলায় কয়েকটি পরিবারের বাস। ডাক্তারবাবুর মেসের কথা কেউ কেউ জানেন, অনেকে প্রফুল্লচন্দ্রের নামই শোনেননি৷ বৃষ্টি হচ্ছিল, খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে  চা-বিস্কুট খেয়ে বিদায় নেওয়া গেল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন