শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০

ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা ~ অর্কপ্রভ ও শঙ্খনীল

বর্তমানে ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজমান অবস্থায় আইটি সেলের কর্মীদের একাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের চরম কুটনৈতিক ব্যর্থতাকে আড়াল করতে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বঙ্গ কমিউনিস্টদের চীনের সাথে জড়িয়ে এর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন।
আজকে এর কিছুটা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম।।
১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ৩১শে অক্টোবর The Statesman পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেন-
"Our stands is clear. I think India's border defence should be strengthened and my party will not hesitate to put in all its efforts for the defence of India's freedom, irrespective of the political character of the attacking country."
এরপর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে দলের পক্ষ থেকে ভারত – চীন যুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর দেওয়ার বক্তৃতার খণ্ডাংশ উদ্ধৃত করলাম। কিঞ্চির লম্বা হলেও পড়তে অনুরোধ করব। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি থাকুক –
-এইরকম প্ররোচনামূলক বক্তৃতা সত্ত্বেও আমরা এখনও বলতে চাই এই ব্যপারে ভারতবর্ষের কোথাও যেন কোনো দ্বিমত না থাকে। আমরা চাই দেশ রক্ষার ব্যপারে সমস্ত জাতিকে একতাবদ্ধ করতে। আমাদের এই পার্টি প্রস্তাব পাশ হবার পর আপনি জানেন, দিকে দিকে এই প্রস্তাব সমর্থিত হয়েছে, দিকে দিকে এই প্রস্তাব কার্যকরী করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে এও আপনি জানেন ...আপনি জানেন, 'সংগ্রাম যতই কষ্টসাধ্য দীর্ঘ হোক না-কেন চীন আক্রমণকারীদের পবিত্র ভারতভূমি হতে বিতাড়ন করার দৃঢ় সঙ্কল্প' একথা ঘোষণা দ্বারা সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে পার্লামেন্ট নেতৃত্ব দিয়েছেন।...দ্বিতীয় কথা, ...আমি এটা পরিষ্কার বলতে চাই আমাদের কথা, ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের কথা যে চীন থেকে বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে কথা প্রচার করছেন কদিন ধরে, তাতে তাঁরা বলছেন যে পণ্ডিত নেহেরু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর দিকে চলে গিয়েছেন, শুধু চলে যাননি তাঁদের তাঁবেদারি করছেন। শুধু তাই নয় তাঁরা বলছেন ভারতের জোট নিরপেক্ষতা নীতি অতীতের ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা একথা আগেও মানেননি, এখনও মানছেন না। অস্ত্র নেওয়া সত্ত্বেও একথা জোর করে পণ্ডিত নেহেরু ঘোষণা করেছেন যে, জোট নিরপেক্ষ নীতি বজায় আছে। আমরাও একথা মনে করি। ...চীনের এই প্রচার অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে আমরা মনে করি। ...যখন কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাঁরা ভারতবর্ষের জনগণকে চীনা আক্রমণ রুখবার জন্য যখন ঐক্যবদ্ধ করবার আবেদন জানিয়েছেন, তখন পশ্চিমবাংলায় দেখছি সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। এখানে অনৈক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, জনসাধারণকে বিভক্ত করা হচ্ছে, এখানে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস আক্রান্ত হচ্ছে।
কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল চন্দ্র রায়ঃ খুব ভালো করেছে, আরও হবে।
-এখানে কোথাও কোথাও অফিসের কাগজপত্র বের করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন কমিউনিস্টদের বাড়িতে গিয়ে ধমকানো হচ্ছে, অপমান ও আক্রমণ করবার চেষ্টা হচ্ছে। ...প্রতাপবাবু এখানে যে বক্তৃতা দিয়েছেন এটাতো কল টু মার্ডার কমিউনিস্ট। এর মানে হচ্ছে
– তোমরা আজ কমিউনিস্টদের খুন কর, তাদের বারিঘর আক্রমণ করো, তাদের অফিস জ্বালিয়ে দাও, তা হলে তোমরা দেশপ্রেমিক।
-পন্ডিত নেহেরু বলেছেন চীনারা ভেবেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সমর্থন করবেন কিন্তু সে সমর্থনও তাঁরা পায়নি। ...প্রকাশ্যে সভায় সভায় এই কথা বলা হচ্ছে দাঁড়িয়ে যে, কমিউনিস্টদের টেনে টেনে বাড়ি থেকে বের করো, তাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারো, চাবুক মারো, খুন করো। এইসব কথা বলা হচ্ছে যেন আইনের মধ্যে পড়ে।
নেপাল চন্দ্র রায়ঃ ওদের খাঁচায় পুরে থুথু দিয়ে মারা দরকার।
অধ্যক্ষর নেপাল চন্দ্র রায়কে সতর্কীকরণ।
-স্পিকার মহাশয়, আমি বলি নেপালবাবুদের চেঁচিয়ে লাভ কি ? ...দু-একটা কমিউনিস্টকে খুন করলে যদি দেশ রক্ষা হয় চীন আক্রমণ ঠেকানো যায় আমার দুঃখ নেই, - আমি এখানেই পেতে দিচ্ছি আমার বুক রিভলভারের সামনে। ...আমাদের বাড়ির চারদিকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।...দেশের যখন বিপদ এবং আমাদের জওয়ানরা যখন আত্মত্যাগ করছে তখন এইভাবে হানাহানি খুনোখুনি সৃষ্টি করবেন না, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিক করুন। আমি আপনাদের প্ররোচনার কোন জবাব দিতে চাই না। কোন কটূক্তি করতে চাই না। দেশপ্রেমের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা কাজ করতে চাই। দেশ রক্ষা আমাদের কর্তব্য এবং সমস্ত কমিউনিস্ট সেই কাজ করবে। আপনারা খুন করে যান, বে-আইনি কাজ করে যান, যে পথে চলতে চান চলুন, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করে যাব।
এর পাঁচ দিন পরে জ্যোতি বসু সহ বেশ কয়েকজন নেতাকে প্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরদিন আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'সারা দেশে দেশদ্রোহীদের ধরপাকড়।
ভোররাতে ঘুমন্ত অবস্থায় গ্ৰেফতার হলেন জ্যোতি বসু। টানা ১ বছর হাজতবাসের পর পেলেন ছাড়া।
দক্ষিণ কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পুড়ল। পাড়ায় পাড়ায় চৌ এন লাইয়ের পাশাপাশি বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের কুশপুতুল পোড়ানো হল। বিপুল চাহিদা দেখে কালীঘাটে একটা কুশপুতুল বিক্রির দোকান তৈরি হয়েছিল। সামান্য দামে সহজপাচ্য দেশপ্রেম।
এর ঠিক চার বছর পর ১৯৬৬ সাল। খাদ্য আন্দোলন। পরের বছর ১৯৬৭। যুক্তফ্রন্ট সরকার, নকশালবাড়ি।
আর তার ঠিক দশবছর পর ব্যাপক জনমতের সঙ্গে রাজ্যে বামেদের সরকার গঠন। মূখ্যমন্ত্রী সেই জ্যোতি বসু।। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে একাই পেলেন প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট ।।
তাই সত্য কখনো চাপা থাকা না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন