শুক্রবার, ১০ মে, ২০১৯

শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোনো ওই ~ সুশোভন পাত্র

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন বাংলায় কমিউনিস্টদের খুঁজতে দূরবীন লাগবে। অমিত শাহর খোয়াবনামা কমিউনিস্ট মুক্ত দেশ গড়বেন। স্টুডিওর ইনফো-গ্রাফিক্সে অর্ণব গোস্বামীরা লিখে দিয়েছেন কমিউনিস্টরা শূন্য। পোষ্ট মর্ডানিস্ট তাত্ত্বিকরা গবেষণা করে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বে কমিউনিজম ব্যর্থ। ঐ দোকানের মার্ক্স ভালো, সেই দোকানের এঙ্গেলস, কিম্বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ -এসব এখন অতীত। এখন নাকি পুঁজিবাদের তিন তলা বাড়ি, সবটাই শাড়ি। 
অথচ তুরস্কের মধ্য-পূর্বে পাহাড় ঘেরা টুনজেলি প্রভিন্স নতুন করে সেজে উঠেছে লাল ঝাণ্ডায়। সম্প্রতি নির্বাচনে সাক্ষরতার হারে এবং জীবনযাত্রার সূচকে তুরস্কের শীর্ষ শহর ডারসিম বেছে নিয়েছে কমিউনিস্টদেরই। তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম। সেই তুরস্কে, যে তুরস্কের রাজনীতি তে ধর্মের আফিম আজ আকছার। সেই তুরস্কে, যে তুরস্কে বিগত ১৬ বছর ক্ষমতায় চরম দক্ষিণপন্থী তায়িপ এরদোগান। বদলে ফেলেছেন সংবিধান, বদলে ফেলেছেন নির্বাচনী ব্যবস্থা, নিষিদ্ধ কুর্দিসরা, সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্য খুন হয়েছেন সাংবাদিকরা, লগ্নি পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য দরজা। সেই তুরস্কেই বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মানুষ। ২৫ বছর পর এরদোগানের পার্টি হেরেছে ইস্তানবুলে। হেরেছে রাজধানী শহর আঙ্কারাতে। 
প্যারিসের রাজপথ আজ স্তব্ধ প্রতিবাদে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারে আর্থিক উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধেই ঝড় তুলে ইমানুয়েল ম্যাক্রনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন বামপন্থী প্রার্থী জ্যাঁ-লুক মেলেশোঁ। একলাফে ভোটের হার বেড়েছে ৮.৫%। মেলেশোঁ চেয়েছিলেন ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা, কর্পোরেটদের আয়কর বৃদ্ধি। চেয়েছিলেন সমরাস্ত্র শিল্প এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। 
আজ মোহন ভাগবতরা বলছেন 'কমিউনিস্টরা দেশের শত্রু, এঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার'। কমিউনিস্ট'দের উচিত শিক্ষা সেদিন গোয়েরিং'ও দিতে চেয়েছিলেন। হিটলারের জন্য মাইলের পর মাইল অস্বাস্থ্যকর জলাভূমি'টাকে বেড়া দিয়ে বেঁধে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানাবার মাস্টারস্ট্রোকটা যার মস্তিষ্ক প্রসূত ছিল, সেই হেরমান গোয়েরিং। আশি হাজার ক্লেদক্লিষ্ট বন্দীর সামনে বুখেনভাল্ড ক্যাম্পের উদ্বোধনী ভাষণে গোয়েরিং বলেছিলেন "উচিত শিক্ষা দিয়ে কমিউনিস্ট'দের সমাজের উপযুক্ত করেত এই সামান্য আয়োজন।" স্বপ্ন মুসোলিনিও দেখেছিলেন একার হাতেই কমিউনিস্টদের চিতা সাজানোর। সোভিয়েত পতনের উল্লাসে বিগলিত মার্গারেট থ্যাচারও সেদিন বলেছিলেন, 'There is no alternative to Capatalism'  
অথচ আজ ব্রিটেনেই থ্যাচারের কনজারভেটিভ পার্টির থেরিসা মে'র সরকার ঝুলছে সুতোর উপর। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের কুর্সি দখলের লড়াইয়ের ফালক্রামে এখন লেবার পার্টির সোশ্যালিস্ট নেতা জেরেমি করবিন। যে ব্রিটেনে বেসরকারিকরণ কে 'সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান' বলেছিলেন থ্যাচার; গ্যাস, ইলেকট্রিক এমনকি পানীয় জল সহ ৪৭ বিলিয়ন পাউন্ড রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি পুঁজিপতিদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন থ্যাচার; ট্রেড ইউনিয়ন কে অর্থনীতির জন্য 'ক্ষতিকারক' হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছিলেন থ্যাচার; সেই ব্রিটেনেই করবিনের হাত ধরে আজ রাজনীতির ন্যারেটিভে পুনর্জাতীয়করণের কথা। ট্রেড ইউনিয়নের প্রসারের কথা। ধনীদের উপর কর, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর কথা। কর্মসংস্থান, সামাজিক কর্মসূচীতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা। 
ভালো নেই পুঁজিবাদের আঁতুড় ঘর আমেরিকাও। ২০০৮-র রিসেশেনের পর তুমুল বেড়েছে বেকারত্ব, ৮১% নাগরিকের কমেছে আয়। উগ্র দক্ষিণপন্থী ট্রাম্পের রিপাবলিকান সরকারের মহিলা বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, অভিবাসী বিরোধিতা, যুদ্ধ জিগির ছুঁড়ে ফেলে তাই বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে আমেরিকার সাধারণ মানুষই। মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয়জয়কার ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট'দের। লাতিনের মহিলা হিসেবে প্রথমবার জিতেছেন ভেরোনিকা এসকোবার, সিলভিয়া গার্সিয়া। আদি জনগোষ্ঠীর ডেব হালান্ডরা। জিতেছেন প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান রাশিদা তালিব, কেনিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা ইলহান ওমররা। টেক্সাস-মিশিগানের অলিতে  গলিতে তাঁরা বলছেন 'আমেরিকা কর্পোরেট লুটের শিকার। শ্রমজীবী মানুষ আর তাঁদের পায়ের তলায় থাকবে না।' আর এই বিকল্প পথের নেতৃত্বে বার্নি স্যান্ডারস। কি বিকল্প চান স্যান্ডারস? সরকারি স্বাস্থ্যবীমা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি মকুব, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট-র অবসান, মহিলা-সংখ্যালঘুদের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, আর ধনীদের উপর চড়া হারে কর।
গর্ভাচেভ আর ইয়েলৎসিন দেখানো মুক্তবাজার অর্থনীতির রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে তখন ভাঙ্গছে সোভিয়েত। জনৈক মিখাইল'র সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নোবেল জয়ী "সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইমঃ দ্য লাস্ট অফ দ্য সোভিয়েতস" বইয়ে লিখেছেন বেলারুশিয়ান সাংবাদিকা স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচ -"সোভিয়েত ভাঙ্গার খুশিতে আমি মস্কোর হোয়াইট হাউসের সামনে মানব বন্ধনে হাত মিলিয়ে ছিলাম। কমিউনিজম আর যাতে কোনদিন ফিরে না আসে তার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। আমরা বলেছিলাম কমিউনিজম চিরকালের জন্য মৃত। তারপর কেটে গেছে ২৫টা বছর। আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কদিন আগে গিয়েছিলাম তার হোস্টেলে। দেখি ডেস্কের উপর পড়ে আছে মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল। আড়ি পেতে শুনলাম আমার ছেলে আলোচনা করছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নিয়ে। নিজের চোখ, আর কান'কেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল নিজের হাতে যে মার্ক্স কে কফিন বন্দী করে এসেছিলাম সেই মার্ক্সই কি আবার ফিরে এলো?" 
হ্যাঁ, এলো। আসলে স্তালিনের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে আপনি উঠতেই পারেন, সোভিয়েতের প্রশংসায় 'অ্যানিম্যাল ফার্মের' অর্গাজমে স্বর্গসুখ আপনি পেতেই পারেন, বলিভিয়ার নিবিড় অরণ্যে ঐ দাড়িওয়ালা গ্ল্যামারাস ডাক্তার ছেলেটার মৃত্যুর প্রতি নিরাসক্ত আপনি থাকতেই পারেন, তীব্র শৈত্য প্রবাহে রেড আর্মির লং-মার্চ কিংবা পাভেল করচাগিনের ইস্পাত কঠিন লড়াই কে ব্যঙ্গ আপনি করতেই পারেন, এমনকি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের দাড়ির থেকে রামদেবের দাড়িই আপনার বেশি পছন্দ হতেই পারে; কিন্তু গীতার 'শ্লোক' থেকে কোরানের 'সূরা' হয়ে বাইবেলের টেস্টামেন্ট -কোথাও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থনীতির বিশল্যকরণী খুঁজে আপনি পাবেন না। পুঁজিবাদী বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব কষতে আপনি পারবেন না। মুক্তবাজারের মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত'র 'উদ্বৃত্ত শ্রমের' পার্থক্য করতে আপনি পারবেন না। ধর্মের বুলি কপচে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতও জুটিয়ে আপনি দিতে পারবেন না। কারণ বাস্তব এটাই যে আপনার-আমার শ্রম আজ 'বাজারের পণ্য'। বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই প্রবল বৈষম্য। আর বাস্তব এটাও যে ধর্মশাস্ত্র বা অ্যাডাম স্মিথের 'দি ওয়েলথ অফ নেশনশ'র পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারে নয়; দাড়ি বুড়োর 'দাস ক্যাপিটাল'ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন