রবিবার, ১ মে, ২০১৬

শিল্প চাই কি চাই না ~ সুশোভন পাত্র

পশ্চিমবঙ্গে ২০১১'র বিধানসভা নির্বাচন চলছে। তখন একটা কলেজে অস্থায়ী পোস্টে শিক্ষকতা করি। ৬ দফায় নির্বাচন। তিনদফা ভোটগ্রহন হয়ে গেছে। ঠিক আজকের দিনে, মানে ১লা মে কলেজ খোলা। অবশ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হঠাৎ রক্ত পতাকা উত্তোলন করে, ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে শ্লোগান দিয়ে, শ্রমিক দরদী হওয়ার কোন যৌক্তিকতাও নেই। অগত্যা কলেজ গেলাম।
সেমিস্টারের শেষের দিক। ইন্টারনাল পরীক্ষার নাম্বার তোলা, ট্যাবুলেশন, স্যাম্পল কোশ্চেন পেপার রেডি  আর সাথে কিছু প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা। বছরভর, 'ফর্মাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড অটোমাটা' নামক অত্যন্ত ভজকট সাবজেক্ট থিয়োরিতে পড়ানোর দরুন এইচ.ও.ডি আমার উপর সদয় হয়েই প্র্যাক্টিক্যালের আপাত সহজ ক্লাস লোড ব্যাল্যান্স করেছিলেন। মাইক্রোবাইলোজি ডিপার্টমেন্টের ডেটা স্ট্রাকচারের ল্যাব। সিলেবাসও তুলনামূলক ভাবে ছোট এবং সহজ। 
তা সেদিন ওদের পরীক্ষা। ভাইবা নিতে গেলাম, সঙ্গে জাহির দা। ওদের আবদার, ভাইবাতে কোর্সের প্রশ্ন ছাড়াও ওদের পছন্দের একটা বিষয়ে, আমাদের পছন্দের একটা প্রশ্ন করতেই হবে। প্রত্যেক কে। ওদের পছন্দের বিষয় সাধারণত, ক্রিকেট, সিনেমা, কম্পিউটার গেমস কিম্বা ফুটবল। আউট অফ দি ব্লু এক ছাত্র বলল "স্যার, পছন্দের বিষয়ঃ রাজনীতি।" আমি আর জাহির দা একে অপরের দিকে তাকালাম। কথায় কথায় নির্বাচনের কথা উঠতেই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, "তোর কোন কনস্টিটুয়েন্সি রে?"
-"যাদবপুর, স্যার"। জাহির দা বলল, "তাহলে তো মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র। ভোট তো হয়ে গেছে"। ছেলেটা সদম্ভে, নিজের তর্জনী আমাদের দিকে তুলে, ভোটের কালি দেখিয়ে বলল, "এক্স মুখ্যমন্ত্রী। সেই ব্যবস্থাই করে এসেছি। উই হ্যাভ ভোটেড হিম আউট।" ১৩'ই মে আরও অনেকের সাথে আমার ছাত্রেরও স্বপ্নপূরণ করেছিলো। যাদবপুরে হেরেই গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। হয়ে গিয়েছিলেন 'এক্স'ও।
কলেজ ছেড়ে নতুন চাকরিতে জয়েন তার পরেপরেই। বেশ যোগাযোগ ছিল অনেকর সঙ্গেই, এই ছাত্রর সঙ্গেও। খবর পাই তারাও কর্মজীবন শুরু করেছে। আর আমারও বেড়েছে অন্য লায়াবিলিটিস। ফলে যোগাযোগটা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হলেও, এখন 'স্যার' থেকে 'দাদা' ডাকেই আমরা উভয়পক্ষ বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই সবকিছুর মধ্যেই, সময়ের নিয়মে কাল যাদবপুরে আবার একটা ভোট হয়ে গেলো। আগের বারের থেকে শীতলে, নীরবে আর ফ্ল্যাশ লাইটের আড়ালে। কাল সন্ধেবেলা মোবাইলে একটা অজ্ঞাত পরিচয় নাম্বারের ফোন তুলে চমকে গেলাম। সেই ছাত্রই ফোন করেছে। বেশ কিছুদিন পর। বলল "আগের বারের ভুলের ক্ষমা হবে কিনা জানিনা। কিন্তু এবার তার প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই করলাম। এটা জানাতেই ফোন করেছিলাম, দাদা।"
১১'র নির্বাচনী ফলাফলের পর বুদ্ধবাবু বেশ কিছুদিন চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে। প্রকাশ্য কর্মসূচী করতেনই না। তারপর দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে চণ্ডীপুরের এক জনসভায় বলেছিলেন "শিল্প ছাড়া রাজ্য এগোতে পারে না। আজ হোক বা কাল রাজ্যের মানুষ কে এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে যে, শিল্প চাই কি চাই না।" 
ঐ ছাত্র ১৩'তেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখনও বেকার। ভিনরাজ্যে চাকরি হয়, কিন্তু পছন্দের হয় না। না, ১৩'ই মে বুদ্ধবাবু জিতলেই বা বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলেই সে সহ বাংলা ১ কোটি বেকারের চাকরি হতই এমন 'মমতাময়ী' দাবী আমার নেই। হয়ত এই ১৯'শে মে তার 'ভুলের' 'প্রায়শ্চিত্ত' করবে হয়ত করবে না। নির্বাচনের অমোঘ নিয়মে হয়ত তার এবারও স্বপ্নপূরণ হবে হয়ত হবে না। কোনও দল হারবে। কেউ জিতবে। শুরু হবে পোস্টমর্টেম। কিন্তু এই পাঁচবছর সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে অভিজ্ঞতা দিয়ে ভাত আর বিরিয়ানির পার্থক্য করতে শিখিয়ে যাচ্ছে। টাটা-সালিম-সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-জমি অধিগ্রহণ এসব বিষয়ে আপনি বুদ্ধবাবু, তাঁর পার্টির বিরোধিতা করতেই পারেন। 'আমরা ২৩৬ ওঁরা ৩৬'র মিডিয়া রচিত গল্পে ঔদ্ধত্য'র মহাভারত আপনি লিখতেই পারেন, বুদ্ধবাবু একের পর এক 'ভুল স্বীকারে' পার্টির মধ্যেও বিরাগভাজন হওয়াতে, সেই আপনিই মশকরা করতে পারেন, 'দুর্বলতা' খুঁজতে পারেন, 'ড্যামেজ কন্ট্রোলের অপচেষ্টা' বলে উড়িয়ে দিয়ে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ কে 'চাবকানোর' ধমকি তে বীরত্ব আর শালীনতাও খুঁজে নিতে পারেন। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখুন, এখনও, এবারও, নির্বাচনে ঐ ছাত্রের মত আপনিও ঐ বুড়োটারই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। 'শিল্প চাই কি চাই না'? 'সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনীর' কারখানা থেকে ধোঁয়া উড়বে না গরু চরবে? চপ-তেলেভাজা শিল্প হবে না উইপ্রো আই.বি.এম ন্যানো বেরোবে? রাজ্যের হাজার শিক্ষিত যুবকরা চাকরি করবে না বেকারই থাকবে? আসলে এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতেই হবে। আজ কিম্বা কাল। বিকস, ২০১১ কিম্বা ২০১৬। দি কোশ্চেন রিমেনস সেম...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন