সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০১৪

মদন - সিদ্ধার্থ দে

ইংরিজি “স্ল্যাং” শব্দটির সঠিক অনুবাদ কঠিন এবং তর্কসাপেক্ষ | অপভাষা বা কুবচন বলা যেতে পারে | ব্যবহৃত হতে হতে অনেক স্ল্যাং আবার গৃহীত ভাষ্যের অন্তর্গত হয়ে যায় | অভিধান ঘাঁটলে এই সব শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়েও প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করা কঠিন নয় | আজকের যুগ বিশেষীকরনের – অনেক পুস্তক বিক্রেতা আজকাল স্ল্যাংএর অভিধান-ও রাখছেন |

ইন্টারনেট বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে আজকাল বয়স কোন বাধা নয় | সেই একটি গানের কলি আছে না – “তুমি আমারও বন্ধু, বাপেরও বন্ধু” – সাইবার সম্পর্কগুলো সেই জাতীয় আর কি | চোখ আর মনের দরজা খোলা রাখলে চলতি ভাষার ওপর দিব্যি দখল এসে যায় | এই যেমন স্ত্রী কি একটা বিষয়ে নালিশ জানাচ্ছিল সেদিন – আমি সাবলীল ভাবে বললাম “একদম চাপ নিও না !”

শেখার কোন বয়স নাই | আমার মন এখনো যথেষ্ট অনুসন্ধিৎসু – কোন শব্দের মানে না জানলে বৈদ্যুতিক শব্দকোষ খুলে জানার চেষ্টা করি | সমস্যা হল- কিছু বহু প্রচলিত কথা অভিধানে নেই – থাকলেও সেগুলির সংজ্ঞা প্রচলিত অর্থের সঙ্গে একেবারেই বেমানান | গুগুলানুসন্ধান করেও খুব একটা বেশি আলোকপ্রাপ্তি হয়না |

আজ শুধু এমন একটি শব্দের কথাই লিখব | প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পরশপাথর খোঁজার মত কথাটির অর্থ বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছি |

বাঙালী পরিবারে আমাদের সময়ে আত্মীয় বন্ধুদের আড়ালে কোন বিশেষ নামে অভিহিত করা হত | হয়ত এখনো হয় | উদাহরণস্বরূপ – এক প্রবাসী আত্মীয় বৎসরান্তে দেশে এলে উন্মত্তের মত কলকাতা তথা অন্যান্য শহরে চষে বেড়াতেন | আমি তাঁর নাম দিয়েছিলাম “চরকিবাজি” | স্বভাব এবং নামকরণের এমন সঙ্গতির ফলে অচিরেই তা সাদরে গৃহীত হয়েছিল | ( গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তৎকালীন এক রাজনীতিবিদ শ্রী চন্দ্রভানু গুপ্তার নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তাঁকে CB Gupta বলে ডাকা হত ) কিঞ্চিৎ অন্যধরণের কণ্ঠস্বরের জন্য আর এক কিছুটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার নাম হয়েছিল হাঁড়িচাঁচা | পরিণত বয়সে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই – নামটি খুব একটা রুচিপূর্ণ ছিল না| বলা বাহুল্য, এগুলি ঠিক ডাকনাম বলতে যা বোঝায় তা ছিল না – কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে নামগুলি কখনই ব্যবহৃত হত না অনভিপ্রেত প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় |

উপরের দুই ক্ষেত্রেই নামের মানে এবং ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন ছিল না | কিন্তু সমস্যা হল যখন আমার দাদা এক ঘনিষ্ট আত্মীয়ের নাম দিলেন ” মদন ” | রবি ঠাকুরের এক গীতিনাট্য ( চিত্রাঙ্গদা ) শুনে ধারণা হয়েছে তিনি প্রেমের দেবতা – যখন তখন পছন্দমত মানুষকে প্রেমাভিলাস পূরণের বর দিয়ে থাকেন | আর একটু বড় হয়ে জেনেছি তাঁর আর এক নাম কামদেব | এই আত্মীয়ের সঙ্গে সেই দেবতার কোন যোগসূত্র অনেক ভেবেও খুঁজে পাইনি |

তাছাড়া অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম-ও মদন | যেমন ভারতের এক ক্রিকেটার মদনলাল যিনি একবার ইডেন উদ্যানে প্রায় তিরিশ গজ দৌড়ে এতো আস্তে বল নিক্ষেপ করেছিলেন যে ভিভ রিচার্ডস থতমত খেয়ে আগে ব্যাট চালিয়ে লোপ্পা ক্যাচ তুলে আউট হয়ে যান – আমার নিজের চোখে দেখা | আর একজন অভিনেতা মদন পুরী বোম্বাইয়ের বিখ্যাত খলনায়ক – পর্দায় যাঁর চোখেমুখে ক্রুরতা ঝরে পড়ত | তৃতীয় জন পশিম বঙ্গের এক মন্ত্রী মদন মিত্র, যিনি নিজের অনেক কীর্তির ছাপ অল্পদিনেই রেখে ফেলেছেন | সব শেষে বহু কালজয়ী গানের ( যেমন “নায়না বরসে রিম ঝিম”) স্রষ্টা মদন মোহন-ও আছেন |এঁদের কারোর সঙ্গেই আমাদের ভালোমানুষ, শান্ত স্বভাবের আত্মীয়ের বিশেষ মিল নেই| কলকাতায় মদন স্ট্রিট ( প্রচলিত উচ্চারণ যদিও ম্যাডান স্ট্রিট ) নামে একটা রাস্তাও আছে বৌবাজারের কাছে – অবশ্য সবাই জানে, বৌবাজারে যেমন বৌপ্রাপ্তি হয়না, ওই রাস্তাও দুনিয়ার মদনদের কেন্দ্র নয়|

তবে হ্যাঁ, তবে আমাদের মদনের কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট ছিল বটে – মনে হয় সেটা তাঁর সারল্য থেকে উদ্ভূত | যেমন, কোন নিমন্ত্রণে একটা সুস্পষ্ট নতুন পাতলুনের সঙ্গে একটা ইস্তিরি না করা তাপ্পিমারা বেমানান রঙের শার্ট পড়ে হাজির হলেন| বা কোন জমায়েতে এমন একটা মন্তব্য করে বসলেন যা উপস্থিত ব্যক্তিদের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত | একবার তো যৌবনচ্ছাস প্রসূত অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করা একটি খাতা বাড়ির অতি কৌতুহলী বড়দের বিনোদনের জন্য অসাবধানে ফেলে রেখেছিলেন| ( বলে রাখি, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্পর্কে আমার মনোভাবের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে – এক সদ্য যুবকের বিষয়ে কিছু আলোড়ন জাগানো “স্কুপ” নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা অত্যন্ত অন্যায় এবং অসমীচীন ছিল – তবে মনে রাখতে হবে ঘটনাকাল প্রায় ৫০ বছর পূর্বের ) |একবার একটি ছোটখাটো অন্যায় ঢাকার জন্য এমন সব দুর্বল অজুহাত দিয়েছিলেন যা সবার দীর্ঘদিনের হাসির খোরাক হয়েছিল | নামটা এতই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে যে সেদিন নাকি আমার ভ্রাতুস্পুত্রবধু টেলিফোনে তাঁকে প্রায় মদন আঙ্কেল বলে ডেকে ফেলেছিল | ( আসলে আঙ্কেল বলেনি – ইংরিজিতে আঙ্কেল অর্থে মামা, কাকা, জ্যেঠা , পিসে, মেসো অনেক কিছুই বোঝায় – সম্পর্কটি গোপন রাখতে শব্দটি ব্যবহার করলাম)

আজ সেই নামের সুবর্ণজয়ন্তী প্রাপ্তির বেশ কয়েক বছর পরেও আমি সেই এক-ই তিমিরে | মদনের আসল সংজ্ঞা আজও আমার কাছে ধোঁয়াটে | এই মদন নামক ব্যক্তি নয়ন সুমুখে নেই, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের নানা পরিস্থিতিতে আমাদের মাঝখানে ঘন ঘন আবির্ভূত হন ভিন্ন ভিন্ন রূপে | তিনি এলে চিনতে পারি, তবে যথাযত ভাবে বর্ণনা করতে পারিনা |

এই লেখা শেষ করব ফেসবুক বন্ধুগোষ্ঠীতে মদনের সঙ্গে পরিচিত আমার আত্মীয়দের একটা অনুরোধ জানিয়ে | দয়া করে এমন কোন মন্তব্য করবেন না যাতে মদনের পরিচিতি প্রকাশ পায় | তিনি ফেসবুকে সক্রিয় নন এই তথ্যের ভিত্তিতেই এই লেখার সিদ্বান্ত নিয়েছি | তাঁকে নিয়ে এই ধরনের ইয়ার্কি চলছে জানতে পারলে খুবই দু:খ পাবেন | জানিয়ে রাখি, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর কাছে নানাভাবে ঋণী | তাঁকে কোনভাবে অপদস্ত করার অভিপ্রায় আমার নেই – এ লেখা নিছকই এক লঘু স্মৃতিচারণ |

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন