রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

স্বাধিনতা তুমি কার? ~ আবিন দত্তগুপ্ত

যুদ্ধ বিধস্ত প্যালেস্তাইনের রাস্তা। জান্তব শব্ধ তুলে গড়িয়ে চলেছে ইসরাইলি অত্যাধুনিক মানুষখেকো ট্যাঙ্ক। হঠাৎ রাস্তা ফুড়ে বেরিয়ে এলো এগারো বছরের এক কিশোর, বলা যায় বালক--- হাথে তার আধলা একটা ইঠ। চোখের পলক না ফেলতেই ছুড়ে মারলো ট্যাঙ্কের দিকে। না, ট্যাঙ্কটার অপর অস্বাভাবিক কিছু ঘটলো না, কিন্ত ঠিক দুইদিন বাদে ইসরাইলি ফায়ারিং স্কোয়াড গুলি করে খুন করলো ১১ বছরের নাম না জানা কিশোর টিকে। এই ঘটনাটি যখন আমরা দুরদর্শন মারফৎ জানলাম তখন এক অন্তরনীহিত দেশাত্মবোধ বলে উঠল “ দেশের মুক্তির জন্যেই প্রান দিল এই অজানা তরুন”, কিন্তু সত্যি কি তাই? একে আন্তর্জার্তিক বিশেষে মানুষ বলবে, “ দেশ নয়, সার্বিক মুক্তির জন্যেই এই আত্মহূতি” আমার প্রবন্ধ এই দ্বিতিয়ের সমর্থনে।

জাতিয়তাবাদিদের মতে নিজের ঘরের অথবা বৃহদর্থে দেশের এক খন্ড জমি বাঁচাতেই কিশোরের এই বলিদান। আমরা আন্তর্জাতিকরা বলি “ না, সার্বিক মুক্তির জন্যেই এই লড়াই , দুই মুঠো খাবার , ভাতের জন্যে, বহুদিন মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেবার জন্যেই, অস্তিত্ব বাঁচানর এই লড়াই। রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে চলা যুদ্ধযান “ইসরাইলি” না “হামাসের” তাতে সাধারণ দিন আনতে দিন খাওয়া মানুষের কি বা এসে যায়? মানুষ প্রতিরোধ করে তখনই, যখন সেই মারণযন্ত্র তাদের সার্বিক স্বাধিনতা ক্ষুন্ন করে, বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিতে চায়, আর তখন যুদ্ধযন্ত্রি জারি হোক না কেনো, স্বদেশীয় বা বিদেশী, তার ওপর কোন ও না কোনো বৃদ্ধ-যুবা-কিশোর বা শিশুর ছোড়া পাথর পড়তে বাধ্য।

জাতিয়তাবাদিরা বলতেই পারেন উপরোক্ত কথা গুলো তো শুধুই মনে হওয়া, রেটরিক ও বটে...... এর সপক্ষে প্রমান কি? প্রমান ইতিহাস। বাংলা দেশ থেকেই শুরু করা যাক। সিরাজদৌলার বাংলাকে আক্রমণ করলেন লর্ড ক্লাইভ-- ইংরেজ। যুদ্ধ হলো। পলাশীর যুদ্ধে নবাব পরাজিত হলেন। বাংলা কোম্পানীর হলো। লক্ষ্যনীয়, যুদ্ধ করলেন শুধুমাত্র মাইনে পাওয়া সৈনিকরা ও নবাবের বিশ্বস্ত অনুচর বৃন্দ। ইতিহাসের কোথাও এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশীদ্বারিত্বের খবর খুঁজে পাওয়া যায় না।

আসলে নবাব থেকে কোম্পানী- এই ক্ষমতা বদলের অর্থ, এক নিষ্পেশকের হাথ থেকে শাসনভার আর এক নিষ্পেষকের হাথে যাওয়া। সাধারণ মানুষ নবাবেও বঞ্চিত, কোম্পানীতেও। এবার আসি সম্পূর্ণ বিপরিত এক যুদ্ধচিত্রে। স্তালীনগ্রাদের যুদ্ধ। আগ্রাসনকারী প্রচন্ড শক্তিশালী হিটলারের নাৎসীবাহিনি। বৎসর খানেকের বেশী চলা সেই যুদ্ধ, লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ মারা গিয়েছিলো যুদ্ধে। কেমন ছিলো সেই যুদ্ধ? কেমন ভাবে জয়লাভ করেছিলো আপাত দূর্বল সমাজতান্ত্রীক সোভিয়েত? জয় এসেছিলো শুধুমাত্র সোভিয়েত জনগনের অদ্ভূত- অপূর্ব আত্মত্যাগে। প্রতি রাস্তায়, প্রতিটি ঘরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো সাধারণ মানুষ। কারখানায় ট্যাঙ্ক তৈরি হচ্ছে, শ্রমিকরাই সেই ট্যাঙ্কে চেপে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাচ্ছেন। লক্ষ্যাধিক সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ সেদিন শুধুমাত্র তাদের পিতৃভূমি কে রক্ষা করেনি, রক্ষা করেছিলো সমগ্র বিশ্বকে। সেদিন সোভিয়েতের মানুষ লড়াই করেছিলেন তাদের সার্বিক মুক্তির অধিকার কে বজায় রাখতে, লড়াই ছিলো অস্তিত্বের। আরো কিছুদিন আগের ঘটনা---- ১৯৩৫-৩৬ এর স্পেন। গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করল দক্ষিন-পন্থী-জাতিয়তাবাদী - মৌলবাদী এক জোট। মুলত বামপন্থী সেই সরকার ছিলো যুগ-যুগ ধরে বঞ্ছিত- খুদার্ত স্পেনের দরিদ্র মানুষের সরকার- পরে বাংলাতে যেমন অপারেশন বর্গা হয়েছিলো, কৃষকের কোমরের জোরে, বামফ্রণ্ট সরকারের হাথ ধরে, এমনি প্রথম বামপন্থী সরকার ও জোতদার - জমিদারের হাথ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে দিতে আরম্ভ করেছিলো জমিতে লাঙ্গল চষা চাষীদের মধ্যে। স্বাবাভিক ভাবেই এই বামপন্থী “অনাচার” সমাজের ওপরতলার কায়েমি-স্বার্থের মূল ভিত্তিতে আঘাত করেছিলো। সুতরাং বামপন্থীদের ক্ষমতাচূত করাও আবশ্যিক হয়ে পড়লো। আজকের ভারতবর্ষে বামপন্থী- দমনে বিদেশী হাথ যেমন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার, সেদিন স্পেনে সেই ভূমিকায় অবতীর্ন ফ্যাসিস্ত হিটলার- মুসলিনীরা। সেইবারই পৃথিবী প্রথম দেখেছিলো আন্তজার্তিক গনফৌজকে, নেতৃত্বে সোভিয়েত। আন্তর্জার্তিক সৈন্যবাহিনীর সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে জাতিয়তাবাদিদের (যাদের মূল স্লোগান ছিলো “God, Country and king”) বিরুদ্ধে লড়েছেন সাধারণ না খেতে পাওয়া মানুষ। তারা সেইদিন লড়াই করেছিলেন তাদের সার্বিক মুক্তির ফেরিওয়ালা বামপন্থী সরকারকে রক্ষা করার প্রাণের আকুতি নিয়ে । জাতিয়তাবাদীরা এদের কি বিশেষনে ভূষিত করবেন? বিশ্বাসঘাতক? ঠিক তাই। ফ্যাসিস্তরা অবশ্য তাই বলেছিলো। এরকম হাজারো উদাহারণ আছে ইতিহাসে। ইতিহাস শিক্ষক আমরা শেখার চেষ্টা করছি মাত্র।

স্বাধিনতা দিবস পালন। আপনার বাড়ির পাশে বস্তি টা, তার কোনো একটা ঘরে ঢুকে যান। দেখবেন উলংগ বাচ্ছা তিনটে ধূলো মেখে রাস্তায় বসে । হাথে জাতিয় পতাকা-- পেটে খাবার নেই- চোখে খুদাপীড়নের প্রতিচ্ছবি-- অশ্রু। ১৯৪৭ এর আগে দেশ পরাধীন, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী, ৪৭ এর পরে দেশ স্বাধিন, এবং সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল। এই দুই অর্ধেই ওই গাল ভাঙ্গা পোকা মাকড়ের মতন দেখতে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ খুদার্থ, আর দুই অর্ধেই তাদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়েছে ওপরের তলার মানুষ। স্বাধিনতার পূর্বে যাদের মাথায় জমিদারি পাগড়ি, স্বাধিনতার পরে পাগড়ির জায়গা নিয়েছে “সাম্রাজ্যবাদী দালাল” প্রতিক “গান্ধী টুপি” ধারী “সেবাদল” বৃন্দ। সীমান্ত যুদ্ধ এই সব উপরতলার বড়মানুষদের অর্থাৎ খমতার অধিকারী- অধিকারীনিদের একটা পলায়নের রাস্তা। দেশের নিরক্ষর, নীপিড়িত , বুভূক্ষু হাড় জিরজিরে জনতা যে সময়তে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে- তখনই যুদ্ধ, মহান দেশপ্রেমের দেশী মদে (পড়ুন চোলাইয়ে) অশীক্ষিত মানুষকে মাতাল করে দিয়ে, মুহূর্তের জন্যে তাদের দুক্ষ্য-দূর্দশা কে ভূলিয়ে দেবার প্রচেষ্টা মাত্র। স্বদেশী কথায় মানুষ মোহগ্রস্ত , নিস্তেজ হলো। মাথার ওপর তোলা মুষ্টি বদ্ধ হাথ শিথিল হলো, রাজার আসন টলতে গিয়েও , টললো না। ৬৭ এর যুদ্ধ, ৭১ এর যুদ্ধ, কার্গিল--- প্রতিটা যুদ্ধের “প্রেলিউড” সেই একই গপ্প। যুদ্ধ শেষ, দেশ বাসীর প্রাপ্তির খাতায় গোটা চারেক সিনেমা, গোটা দশেক দেশ্মাত্ববোধক গান এবং আরেকটু বেশী ঘন হয়ে যাওয়া গরিব মানুষের মৃত্যুমিছিল।

তাই আজ, জাতিয়তাবাদী স্বাধিনতার ৬২ বছর পর প্রশ্ন জাগে? স্বাধিনতা তুমি কার? স্বাধিনতা , তুমি কিসের জন্যে? এ কেমন স্বাধিনতা?

২টি মন্তব্য:

  1. definitely a thought provoking prose that gives a whole new dimension to the concept of nationalism.....but an intriguing question that it leaves behind on my mind is...can the sense of internationalism ever evolve without one understanding the true feeling of nationalism??

    উত্তরমুছুন
  2. Prochur banan bhul ... Ekti somoyochito lekhay ato bhul thakay ektu oswosthi holo. E bishoye prokashok er drishti akorshon korchi...

    Ebar lekhatar kothay asi , bishoybostu prasongik o bastobochito , tulonamulok alochonar upokoron bhalo ... Tobe probondhokar ke boli bishleshoner aalo ta arektu gobhir o joralo hole monograhita aro barto ... Tate judhher potobhumi sarbikbhabe probondhe dana katbe , sobmiliye ekti pathojogyo lekha...

    উত্তরমুছুন