বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪

টিবির ওষুধ নাই ~ ডাঃ বিষাণ বসু

টিবি-ফিবি, মানে সাধুভাষায় যাকে যক্ষ্মা বলে, সেসব নিয়ে আজকাল আর কেউ কথা বলে না।
স্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তরা যখন কথা বলেন - বিশেষ করে এই শ্রেণীটির কথা বলছি, কেননা এঁদের একটা ভয়েস থাকে, অন্তত থাকাটা সম্ভবপর, থাকাটা নিদেনপক্ষে উচিত, যেটা ক্ষমতার উপরমহলের কর্ণগোচর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে - তো এঁরা যদি অসুখ-বিসুখ নিয়ে কথা বলেন, তা, ইদানীং, শুধুই হাইটেক চিকিৎসা নিয়ে। অর্থাৎ আলোচনা বলতে শুধুই অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি, ক্যানসারের নিত্যনতুন চিকিৎসা এসব নিয়ে। নিতান্তই যদি তা না হয়, তাহলে সুস্থ থাকতে হলে অ্যাভোকাডো নাকি অ্যাসপারাগাস কোনটা বেশি করে খাওয়া উচিত, এসব গুরুগম্ভীর আলোচনা। বলাই বাহুল্য, টিবি বলে যে একটা অসুখ রয়েছে, দেশের কয়েক লক্ষ নাগরিক যে সে অসুখে ভুগছেন এবং এঁদের মধ্যে বেশ কয়েক হাজার মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতে ভুগছেন, যাঁদের প্রচলিত কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছে না - সে নিয়ে জনগণ, মানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত সেভাবে বিচলিত নন।
কেননা, এঁদের চোখে টিবি গরীবের অসুখ। মানে, গরীবের অসুখ বলেই সচেতনভাবে এঁরা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান, এমন নয়। কিন্তু দেশের 'অগ্রগতি'-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো - দারিদ্র্য নিশ্চিহ্ন না হলেও আমাদের চোখের সামনে থেকে দরিদ্রদের হাপিস করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এবং সেই সঙ্গে দরিদ্রদের সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তার অভ্যেস - যৎকিঞ্চিত হলেও কিছুটা তো ছিল - তা-ও অন্তর্হিত।
টিবি বিষয়ে এমন ভাবনার দুরকম সমস্যা। প্রথমত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ কোনও সমস্যাকে গুরুত্বহীন মনে করলে সরকারের চাড় থাকে না সে সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার, কেননা, আগেই বলেছি, শ্রেণী হিসেবে এঁদের কিঞ্চিৎ গলার জোর থাকে (ঠিক একারণেই, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছেড়ে কর্পোরেট হাসপাতালমুখী হওয়ার সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিষয়ে সরকারের অবহেলাকে যোগ করে দেখা সম্ভব)। আর দ্বিতীয়ত, সংক্রামক ব্যধি আর্থসামাজিক বিভাজন মেনে চলে না। টিবি এক্সক্লুসিভলি গরীবের অসুখ, এমন নয়। তদুপরি, আজ যা গরীব-গুর্বোদের অসুখ, কাল তা আপনার সন্তান বা বৃদ্ধ মাতাপিতাকেও আক্রান্ত করতে পারে। করছেও। দেশের যক্ষ্মা-আক্রান্তদের মধ্যে মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তের সংখ্যা কিছু কম নয়। যক্ষ্মায় যদি রাশ টানা না যায়, তাহলে সংখ্যাটা ভবিষ্যতে বাড়বে।
আরও এক সমস্যা, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণা যে পথে চলছে, তাতে অসুখ সারিয়ে দেওয়ার ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কোম্পানির উৎসাহ কম - কেননা, অসুখ সেরে গেলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ, কোম্পানির লাভও কম। তার চাইতে সেসব ওষুধ আবিষ্কারে লাভ, যাতে আজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয় - হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ইত্যাদি - এমনকি ক্যানসারের যেসব নিত্যনতুন ওষুধ বাজারে আসছে, সেগুলিও অসুখ সারায় না, অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখে মাত্র। অতএব বলাই বাহুল্য, যক্ষ্মার মতো উপেক্ষিত অসুখের ভাগ্যে নতুন ওষুধ জোটেনি।
অর্থাৎ, যক্ষ্মার মতো দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল অসুখের ক্ষেত্রে পুরনো ওষুধগুলোই ভরসা। যদি জীবাণু সেসব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-ক্ষমতা গজিয়ে ফেলে, তাহলে অন্যান্য কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসার সুযোগ থাকে বটে, কিন্তু সে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, সারিয়ে তোলা খুবই কঠিন।
এমতাবস্থায়, প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ নির্ণয় করে চটজলদি ওষুধ খাইয়ে অসুখ সারিয়ে তোলা, বাকি সব অসুখের ক্ষেত্রে একথা একইভাবে সত্য হলেও যক্ষ্মার ক্ষেত্রে কথাটা আরও একটু বেশি করে সত্য।
কিন্তু মুশকিল হলো, যক্ষ্মার ওষুধটিই আপাতত অমিল।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, টিবি-র ওষুধ আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে এবং বাইরের দোকানে - দুজায়গায়ই ওষুধের জোগান অনিয়মিত।
কিন্তু এই খবরটুকু আপনি জানেন না, তাই না?
ভোটের তুমুল হইহল্লার বাজারে আমার দুটি ভাই Anirban Datta আর Smaran Mazumder এমন অপ্রিয় এবং পলিটিকালি ইনকারেক্ট বিষয় নিয়ে গান বেঁধেছে, আপনাদের জানানোর জন্য। তবুও আপনি জানবেন না?
"গণতন্ত্রে আর নাই রক্ষা
যাদের বুকের ভেতর যক্ষ্মা!
নখে কালির দাগ যাদের
ওষুধ মিলছে না যে তাদের..."
একটু মনে করিয়ে দিই, যক্ষ্মা অত্যন্ত জটিল গোত্রের সংক্রামক ব্যাধি। যার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। অন্তত মাসছয়েক ওষুধ খেতে হয়। অনিয়মিত ওষুধ খেলে জীবাণু সাধারণ ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে - তারপর আর ওষুধ খেলেও সহজে অসুখ সারতে চায় না। এবং সেই ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু যদি বাজারে বহুল হারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তাহলে যক্ষ্মা প্রকৃতপ্রস্তাবেই মহামারীর আকার নেবে। নগর পুড়িলে দেবালয়ই রক্ষা পায় না, তো আপনি কোন হরিদাস পাল!!
"গণতন্ত্রকে খায় ঘুষ
আর টিবি খায় ফুসফুস
প্রজার গর্বভরা বুকে
রক্ত ছলকে ওঠে মুখে..."
ভোটের বাজারে সান্ধ্য গলাবাজি থেকে হাতাহাতি, সবই তো দেখছেন। তবু...
"আসবে রাজা যাবে রাজা
নিয়ম বলে তা-ই।
শুধু জানল না কেউ
হাসপাতালে টিবি-র ওষুধ নাই।"
জানুন এবং জানান। গানটির লিঙ্ক রইল টিবির ওষুধ নাই। নিজে শুনুন এবং অপরকে শোনান।
পুনঃ- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিবি-কে কাবু করার জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ২০৩০ সাল। আমাদের দেশ অবশ্য ভাবনাচিন্তায় অনেক এগিয়ে। সরকার জানিয়েছেন, ২০২৫-এর মধ্যেই তাঁরা টিবি-কে ঘায়েল করে ফেলবেন। ওষুধ তো অমিল। তাহলে? যাক গে, সরকার যখন ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবেই করেছেন, তাই না?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন