সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

হান্স, গল্প ও সত্যি ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

আট বছরের ছোট ছেলে হান্স এর গল্প। পুরোনো গল্প। বিদেশি গল্প। হান্স এর বাড়ি ছিল হল্যান্ড এর হার্লেমে। নদী/সাগর বাঁধের ধারে ছোট্ট শহর। এক সন্ধ্যের সময়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘরে ফিরছিল হান্স নির্জন বাঁধের পাশ দিয়ে। জল পড়ার আওয়াজ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল যে বাঁধের দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট ফুটো হয়েছে। তাই দিয়ে জল পড়ছে। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হান্স ওই ফুটোতে নিজের আঙ্গুলটা ঢুকিয়ে দিল। ব্যাস, অমনি জল পড়া বন্ধ। এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল হান্স সারারাত। কারণ সরে গেলেই জলের তোড়ে ফুটোটা বড় হয়ে যাবে, বাঁধ ভেঙে পড়বে আর ভেসে যাবে গোটা শহর। 

এটা গল্প ছিল। সত্যি ঘটনা নয়। আজকে আবার এই পুরোনো গল্পটা শোনানোর কারণ আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক (এবং আজকাল মানব সৃষ্ট) দুর্যোগ বা বড় মাপের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার চর্চাও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের একটা অন্যতম বিষয়। দেখা গেছে যত দ্রুত ওই বিপর্যয় পীড়িত মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানো যায়, তত মঙ্গল। তাই রেপিড রেসপন্স টিম তৈরি হয়। 

এসব আধুনিক ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার আগেও বিপর্যয় ছিল, মানুষ তার মোকাবিলাও করেছে। হান্স তারই উদাহরণ। দেখা গেছে যে যেসব সমাজে বা গোষ্ঠীতে সামাজিক মেলামেশা বা বন্ধন বেশি তারা তত ভালভাবে ওই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে পেরেছে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে। এই অভ্যেস ভুলে গিয়ে আমরা সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক একটা পরিবার নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো বসবাস করতে শুরু করেছি। 

কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম আছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়দিঘির বহু মানুষ দেখেছেন। ঝরে বন্যায় আইলায় আম্পানে বিধ্বস্ত মানুষ গুলো দেখেছে এক প্রৌঢ়কে। ঈষৎ মোটাসোটা কালোকুলো চেহারা, ধুতিটা হাঁটুর ওপরে। লেগে গেছেন ত্রাণের কাজে। 

হ্যান্স এর গল্পে ফিরে আসি। এক যাজক সারা রাত অসুস্থ বন্ধুর সেবা করে নিজের বাড়ি ফেরার পথে ভোর বেলায় একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট হান্স কে আবিষ্কার করেন। ঠান্ডায়, ব্যাথায় ভয়ে যন্ত্রণাকাতর হান্সকে।তারপরে আরো অনেক লোক ডেকে নিয়ে আসেন ওই যাজক। হান্স ছাড়া পায়। বাঁধের মেরামতি হয়। হান্স হয়ে যায় জাতীয় হিরো।

আমার গল্পের হিরো সেই প্রৌঢ় কখনো হিরো কখোনো জিরো। চিত্রাভিনেত্রীর কাছে নির্বাচনে হার। তবুও মানুষটা ঘরে বসে থাকেন নি। যেকোনো বিপর্যয়ে সবার আগে ঘটনাস্থলে। রেপিড রেসপন্স টিম। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন, উনি নাকি ঝড়ের আগেই পৌঁছে যান। মানুষটাকে আবার দেখতে পাচ্ছি প্রচারের আলোয়।  রেমাল আছড়ে পড়ার এপিসেন্টারে।

উনি ভোটে জিতুন বা হারুন তাতে আমার কিস্যু এসে যায় না। শুধু জানি আমাদের হান্স বেঁচে আছেন। রায়দিঘির মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য দেওয়া বাঁধের ফাটলে সারারাত হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের নিজেদের হান্স। আমাদের প্রেরণা হয়ে, মিথ হয়ে, উপকথার নায়ক হয়ে বেঁচে থাকুন হান্স। সেলাম।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন