২০১২ সালের জুলাই মাসে সার্ন ঘোষণা করল প্রায় ৫০ বছর আগে যা ছিল অপ্রমাণিত তত্ত্ব, অথচ যা মিলিয়ে দিয়েছিল মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র কণিকাদের পারিবারিক কুণ্ডলী, তা এখন পরীক্ষালব্ধ বাস্তব। আবিষ্কার হয়েছে " হিগস বোসন " যার ডাকনাম " গড পার্টিকল"। বাংলা সংবাদ মাধ্যমে উল্কার গতিতে ছড়িয়ে গেল খবর " ঈশ্বর কণা আবিষ্কৃত"। সেই সূত্র ধরে, মনের মাধুরী মিশিয়ে চর্চা চলতে লাগল এ নাকি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। বিশ্বাসী মানুষ খবর কাগজ পড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন " যাক! তিনি আছেন। বিজ্ঞানকে পর্যন্ত তাঁকে স্বীকার করতেই হল।" রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশে অনুচ্চারিতই রয়ে গেল যে " ঈশ্বর কণা" নিছকই নাম, " হতচ্ছাড়া" ( Goddamn) কে সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করা বৈ কিছু নয়।
যার দৌলতে " ঈশ্বর কণা " কটাদিন বাঙালির মনোজগতে তুফান তুলল সেই পিটার হিগস মারা গেলেন গত পরশু। বাংলা সংবাদমাধ্যমে কোন খবর আছে " ঈশ্বরের" আবিষ্কারককে নিয়ে? থাকার কথাও নয়। এখন তো আর " সেনসেশন " তৈরি হবে না।
যাইহোক, পিটার হিগস এবং তাঁর আবিষ্কার নিয়ে সহজ ভাষায় লিখেছেন অরিজিৎ গুহ। নিচে দিলাম লেখাটা।
~ শুভ্রদীপ ঘোষ
******"************************************************
আত্মবিশ্বাস শব্দটার সাথে জড়িয়ে থাকে একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব। আত্মবিশ্বাস না থাকলে সুন্দর কোনো কিছুই গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। পল ডিরাক যখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে প্রথমবার বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ যুক্ত করলেন, তখন তাঁর ইকুয়েশনের সলিউশনে একটা অদ্ভুত ফলাফল এসেছিল। দ্বিঘাত সমীকরণে x এর যেমন পজিটিভ এবং নেগেটিভ দুখানা মাণ বেরোয়, অনেকটা সেরকমই। সমীকরণটায় ইলেকট্রনের দুখানা চার্জ বেরিয়েছিল। একটা নেগেটিভ এবং একখানা পজিটিভ। নেগেটিভ চার্জ নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। চিন্তার কারণ ঘটিয়েছিল পজিটিভ চার্জখানা নিয়ে। ইলেকট্রন কী করে পজিটিভ চার্জের হয়! অদ্ভুত ব্যাপার! ডিরাক নিজেও প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলেন। ভেবেছিলেন এটা পজিটিভ প্রোটনেরই হয়ত কোনো প্রকারভেদ হবে। আবার অংক কষা শুরু করেছিলেন। পরে স্থির প্রত্যয় হয়ে ঘোষণা করেন, আমার সমীকরণ পুরোপুরি ঠিক। একফোঁটা কোনো ভুল নেই।
কিছুকাল পরে কার্ল অ্যান্ডারসন ইলেকট্রনের অ্যান্টি পার্টিকল পজিটিভ চার্জের পজিট্রন আবিষ্কার করেন ক্লাউড চেম্বারে কসমিক রে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে। ডিরাক বললেন My equations are more powerful than me. আত্মবিশ্বাস। আমিই ঠিক। এই আত্মবিশ্বাসের ফলে পাওয়া গেছিল সুন্দর একটি তত্ত্ব। অ্যান্টি পার্টিকল এর তত্ত্ব।
১৯৯৮ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের তত্ত্বাবধানে নয় বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটার বা পার্টিকল কোলাইডার তৈরি করা হল মহাবিশ্বের কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যার নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। যেসব প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হচ্ছিল তার মধ্যে ছিল কণা পদার্থবিজ্ঞানের এখনো অব্দি সব থেকে সর্বজনগ্রাহ্য মত স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল এর মান্যতা নির্ধারণ এবং স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলের সম্প্রসারিত মতবাদ সুপারসিমেট্রির সন্ধান, স্ট্রিং থিওরিতে বর্ণিত অতিরিক্ত মাত্রার সন্ধান, ডার্ক ম্যাটার যা ধরে আছে মহাবিশ্বের ৭৮ শতাংশ ভর সেই ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান, গ্র্যাণ্ড ইউনিফাইড তত্ত্ব ইত্যাদি। তবে সব থেকে বড় যে প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে পদার্থের ভর সংক্রান্ত।
কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল আসলে পর্যায় সারণির মৌলের মত প্রাথমিক কণার একটা পর্যায় সারণি। এই পর্যায় সারণির প্রায় প্রতিটা কণাই নয়ের দশক নাগাদ পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটারে আবিষ্কৃত হয়ে যায়। বাকি ছিল একখানা কণার আবিষ্কার। সেই কণাটা আবিষ্কৃত হলেই এক বিরাট বড় মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ে যেত পদার্থবিদদের। প্রশ্নটা কী ছিল! একটু দেখে নেওয়া যাক।
ধরা যাক ইলেকট্রন। এটা একটা প্রাথমিক কণা এবং স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলে যে পর্যায় সারণি করা হয়েছে সেখানে এর স্থান রয়েছে লেপটন কণাদের শ্রেণীতে। বাকি লেপটন কণারা হচ্ছে মিউয়ন আর টাউ। এরা খুব হাল্কা কণা। এবার রিচার্ড ফেইনম্যান কোয়াণ্টাম তত্ত্বের মধ্যে ফিল্ড থিওরি বলে একটা তত্ত্ব এনেছিলেন যেখানে উনি দেখিয়েছিলেন প্রতিটি কণার সাথে যুক্ত থাকে একটা করে সেই কণার ফিল্ড। ফিল্ড মানে হচ্ছে যেখানে সেই কণাটার উপস্থিতি বোঝা যায়। 'পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাঙ খোড়া করে দেবে বলেছে পাড়ার দাদারা'- এই গানের মধ্যে দিয়ে অঞ্জন দত্ত পাড়ার দাদাদের ফিল্ড বুঝিয়ে দিয়েছেন। ওই পাড়াটাই হচ্ছে দাদাদের ফিল্ড। ওখানে দাদারা শক্তিশালী। সেরকমই কণাগুলোরও একেকটা ফিল্ড রয়েছে এবং এই ফিল্ডের ফ্লাকচুয়েশনই কণার অস্তিত্ত্ব প্রকাশ করে। এই ফিল্ডের মধ্যে কণাটা শক্তিশালী।
কণার অস্তিত্ত্ব তো প্রকাশ হল, কিন্তু কণা সাবালক হল কিনা কী করে বোঝা যাবে! অর্থাৎ কণাটা ভর পেল কিনা সেটা কোথা থেকে জানা যাবে! এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা পড়লেন দ্বিধায়। তাঁরা প্রস্তাব করলেন কণাগুলো জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে একটা চ্যাটচ্যাটে আঠালো ফিল্ড যা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, সেই ফিল্ডের মধ্যে দিয়ে যায়। এবার সেই আঠালো চ্যাটচ্যাটে ফিল্ডের সাথে অন্য কণার ফিল্ডের মিথষ্ক্রিয়া বা ইন্টার্যাকশন যখন হয় তখন কণাগুলো এমন ভাব করে যেন সুইমিং পুলের মধ্যে কণাগুলো সাঁতার কেটে জল ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাঁতার কাটার ফলেই কণাগুলো তার ভর পাচ্ছে। ওই সুইমিং পুলটা হচ্ছে সেই আঠালো চ্যাটচ্যাটে ফিল্ড। রাশিয়ান পদার্থবিদ লেভ ল্যাণ্ডাউ এর নিম্ন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতার একখানা তত্ত্ব থেকে এই চ্যাটচ্যাটে আঠালো ফিল্ডের তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা নিয়ে আসেন। এই যে কণাগুলোর এই ফিল্ডের সাথে মিথষ্ক্রিয়া বা সাঁতার কাটার এই পদ্ধতি, সেই সংক্রান্ত কয়েকখানা পেপার ১৯৬২-৬৪ এর মধ্যে পরপর কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রকাশ করেন। তাঁদের প্রত্যেকের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী এই মিথষ্ক্রিয়ার নাম রাখা হয় ABEGHHK'tH mechanism. যথাক্রমে Philip Anderson, Robert Brout, Francoise Englart, Gerald Guralnik, CR Hagen, Peter Higgs, Tom Kibble, Gerard tHooft এদের আদ্যাক্ষর অনুসারে। তবে এদের মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে পিটার হিগস তাঁর পেপারে এই ফিল্ড সংক্রান্ত যে একটি কণা রয়েছে তার উল্লেখ করেন। স্বাভাবিক। ফিল্ড থাকলে সেই ফিল্ডের একটা কণাও থাকবে। সেই জন্য পরবর্তীকালে এই মেকানিজম হিগস মেকানিজম আর হিগস ফিল্ড সংক্রান্ত কণাটাকে হিগস কণা বলে উল্লেখ করা হতে থাকে। স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলের বাকি বল বা ফোর্স পরিবাহী কণাগুলো যেগুলো বোসন কণা তার সাথে এই কণাটার একটা পার্থক্য হচ্ছে বাকি ফোর্স ক্যারিয়ার কণাগুলোর ফিল্ডের একটা অভিমুখ আছে, যেহেতু ফোর্স বা বলের অভিমুখ থাকে, তাই বাকি ফোর্স ক্যারিয়ার কণাগুলো হচ্ছে ভেক্টার বোসন বা গেজ বোসন আর এই কণাটার কোনো অভিমুখ নেই তাই একে বলা হয় স্কেলার বোসন। এবং এই কণাটাই সব কণাদের ভর যোগাচ্ছে। এলএইচসি তে যদি এই কণা আবিষ্কার করা যায় তাহলে পদার্থের ভর সংক্রান্ত একটা মৌলিক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে।
যখন এলএইচসি তৈরি হচ্ছে ততদিনে স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল নিয়ে গবেষণা করে বেশ কয়েকজন নোবেল পেয়ে গেছেন। তার কারণ আগেই উল্লেখ করেছি বাকি কণাগুলো পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটারে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। যারা যারা এইসব কণা সংক্রান্ত তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা এবং যারা কণাগুলোর আবিষ্কারে জড়িত ছিলেন, প্রত্যেকেই নোবেল পেয়ে গেছেন। সেই সময়ে পদার্থবিদদের মধ্যে একটা বিকল্প তত্ত্বও উঠে এসেছিল যা হচ্ছে হিগস মেকানিজম এবং হিগস বোসন ছাড়া পার্টিকল ফিজিক্স এর ইলেকট্রোউইক তত্ত্ব। এখানে বলা হয়েছিল কণাগুলোর কোয়ান্টাম ফিল্ডের যে গতিশক্তি সেখান থেকেই কণাগুলো নিজস্ব শক্তি থেকে ভর সৃষ্টি করে।এবং এই সংক্রান্ত ম্যাথামেটিক্সও বিকশিত হচ্ছিল ১৯৯০ থেকেই। সহজেই বোঝা যায় এই তত্ত্ব বিকশিত হলে স্ট্যাণ্ডার্ড মডেলকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হত এবং হিগস মেকানিজম বা হিগস ফিল্ডের আর কোনো অস্তিত্ত্বই থাকত না।
১৯৯৮ সালে এই বিকল্প তত্ত্ব নিয়েই সার্নে বক্তৃতা দিতে গেছিলেন বিকল্প তত্ত্বের উদ্ভাবক কানাডার পদার্থবিদ John W Moffat. সেই বক্তৃতার নাম ছিল Electroweak Model without a Higgs Particle. স্পষ্টতই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এত বড় একটা প্রোজেক্ট হচ্ছে, তার আগে এমন একখানা বক্তৃতা যে বক্তৃতা পুরো প্রজেক্টটা সম্পর্কেই অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
সেই বক্তৃতার ঠিক আগে আগেই এই এলএইচসি প্রজেক্ট লঞ্চ হল। একজন সাংবাদিক তৎকালীন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসার পিটার হিগস কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই যে একটা নয় বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট যেখানে আপনার নামে একখানা কণা আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, আপনি কি বিশ্বাস করেন এতে হিগস বোসন পাওয়া সম্ভব হবে? পিটার হিগস এর জবাব ছিল I am 96 percent certain that they will discover the particle.
Moffat এর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর সার্নের থিওরেটিকাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলের সেমিনার রুম স্তব্ধ হয়ে গেছিল। এসব কি তত্ত্ব শুনছে ফিজিক্স কমিউনিটি! এই তত্ত্বের ঠিক হওয়া মানে নয় বিলিয়ন ডলার জলে চলে যাবে। সরকারের থেকে ভবিষ্যতে আর কোনো ফাণ্ড পাওয়া সম্ভব হবে না। পার্টিকল ফিজিক্স এর গবেষণা থমকে যাবে! কিন্তু ফিজিক্স তো এভাবে চলে না! সেমিনার রুমের এক বিজ্ঞানীর প্রশ্নের জবাবে Moffat বলেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে যদি মিকেলসন মর্লি ইথার কে নস্যাৎ না করতেন তাহলে আইনস্টাইন এর রিলেটিভিটির জন্ম হত? সাইন্স আসলে কোনো কণা পেলাম কি পেলাম না তার ওপর নির্ভর করে থাকে না। এত বড় প্রোজেক্ট যদি ফেলও করে তাহলেও সাইন্স এগিয়ে যাবে।
অবশেষে ২০১৩ তে সার্নের এলএইচসিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল হিগস কণা। পূর্ণতা পেয়েছিল স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল। পিটার হিগস এর আত্মবিশ্বাস 'আমিই ঠিক' প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
গতকাল ৯ই এপ্রিল চলে গেলেন ২০১৩ র নোবেল প্রাইজ বিজয়ী পিটার হিগস। তিনি নিজে অবশ্য হিগস বোসন এর আবিষ্কারে পুরোপুরি নিজেকে কখনই কৃতিত্ব দেন নি। হিগস মেকানিজম এর পেপারের বাকি বিজ্ঞানীদের কথাও সব সময়ে বলে গেছেন। নিজেকে অন্তরালে রাখতেই পছন্দ করতেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই প্রফেসার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন