শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৪

মাল, চাট ও কলকাতা ~ মানস নাথ

কলকাতার বার বা মদের ঠেকগুলো নিয়ে নানা কারুকার্যময় গালগল্প, মিথ ঘুরে বেড়ায় রসিক সমাজে। এই সব গল্প ঠেক আড্ডার একটা নিজস্ব জগৎ আছে।এই ঠেকগুলোর আছে নিজস্ব ডাকনাম বা আদরের নাম।  এক দাদার হাত ধরে ভবানীপুরের গ্রীন প্যালেস বারে যাওয়া থেকে সেই জগতে আমার এন্ট্রি। তবে আজকে মদের নয় চাটের গল্প বলতে ইচ্ছে করছে।
নেশাড়ু সার্কিটে গ্রীন প্যালেস বার জিপি নামেই পরিচিত। সেখানে মালের সাথে ফ্রিতে বারের তরফ থেকে চাট ছিল এক বাটি কম মশলার সাদা চানাচুর,ভিনিগারে চোবানো পিঁয়াজ আর সরু সরু করে কাটা আদার সাথে বিটনুন। প্রতি পেগ অর্ডারের সাথে চানাচুরটা রিপিট হত। আমি তখন একপেগ রাম নিয়ে টেবিলে বসে থেকে দাদাদের মুখের গল্প শোনার পাবলিক। এক বয়স্ক নেপালী ওয়েটার ছিল জিপিতে। সবাই তাকে সাথীদা বলে ডাকত। তিনি আমাকে এক প্লেট চানাচুর এক্সট্রাই দিতেন।
উল্টোদিকে যদুবাবুর বাজারের উপরে তৃপ্তি বার। একটা সরু প্রায়ান্ধকার গলি দিয়ে ঢুকে মান্ধাতার আমলের মচমচে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পৌছাতে হয় সেই গুহায়। বড় বড় রাস্তার ধারের জানালা আর গোল গোল শ্বেতপাথরের টেবিল। দাম বেশ সস্তা। তবে বিটনুন আর আদা ছাড়া চাটে আর কিছু দিত না তখন।আলু কাবলি পাওয়া যেত, সেটার পরিমান দুজনের পক্ষে যথেষ্ট। 
    ঠেকের মধ্যেই রকমারি চাটের দোকান সাজিয়ে বসতে দেখেছি খালাসীটোলায়। যাকে বন্ধুরা কেত মেরে কেটি বলে ডাকত। খাঁচার আড়ালের কাউন্টার থেকে বোতল কিনে নিয়ে এসে টেবিলে বসতে হত। এবারে পাশেই সারি দিয়ে লাগানো চাটের দোকান থেকে ইচ্ছামত খাবার কিনে নিয়ে এসো। রকমারি মাছ ভাজা... এমনকি আমি কাতলা মাছের মুড়ো ভাজাও দেখেছি!  কারা মাছের মাথা দিয়ে মদ খায় কে জানে!  চিকেন, খাসির ছাঁট, মেটের তরকারি সাজানো থাকত। আলুকাবলি, চানা, ছোলা এসব তো ছিলই। শুঁটকি মাছের রসা অব্ধি দেখেছি! আমি যদিও দু তিনবারই গিয়েছি কেটিতে। তারমধ্যে একবার শর্মিদির সাথে কবি ফাল্গুনী রায়ের উপর একটা ডকু ছবির শুটিং করতে গিয়ে খুব মজা হয়েছিল। সে অন্য গল্প। 
    অলিপাবে মদ খেতে গিয়ে প্রথম খেয়েছিলাম বিফ স্টেক। আমার খুব একটা সুবিধার লাগেনি যদিও ; আর ছিল চিকেন আলা কিয়েভ। ছুরি দিয়ে কাটলেই এত্তটা গলানো মাখন বেরিয়ে পড়ে! তবে চাটের প্যারাডাইস হল গিয়ে ধর্মতলার মেট্রোগলির শ বার। সন্দীপনের লেখাতে পড়েছিলাম তারা সেই বারের নামকরণ করেছিলেন ছোটা ব্রিস্টল। সন্দীপনের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন শ বারের গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতের নোটশবোর্ডে ওনার ছবি সহ শোকবার্তা ঝুলতে দেখেছি।এখানে ওয়েটারের কাছে আগে পয়সা দিয়ে টেবিলে বসতে হয়! একসাথে তিন চারটে টেবিলের গোটা পনেরো গ্লাস ওয়েটার একের উপর এক সাজিয়ে একসাথে ব্যালেন্স করে নিয়ে আসে আর প্রত্যেকের সামনে অর্ডার অনুযায়ী নামিয়ে রাখতে থাকে!  আমি প্রতিবার ভাবি কার কোনটা গ্লাস মনে রাখে কী করে!! তবে শ বারের আসল মজা হল রানিং চাট এর পসরা। ট্রেতে সাজানো চাটের প্লেট নিয়ে টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকে বিক্রেতারা। রকমারি সিজিনের ফল থেকে নানা রকমের ভাজাভুজি, বাদাম, ছোলা, মটর থেকে চিজ।  মাছ এবং মাংসের বিভিন্ন পদ থেকে মেটে চচ্চড়ি অব্ধি। আর দামও বেশ সস্তা। অনেকে উল্টোদিকের টিপু সুলতান মসজিদের গলি থেকে বিফ শিক কাবাব নিয়ে আসত ঠোঙায় করে। 
    মধ্য কলকাতার বিভিন্ন বারের মধ্যে এককালে মন্টি কার্লোর কথা সবাই বলত মৌরলামাছ ভাজা খাওয়ার জন্য। ইদানীং তার অবস্থা ভাল নয়। পাশের চাংওয়া অবশ্য পর্দাঘেরা কেবিনের জন্য বিখ্যাত।মদের সাথে পর্দার আড়ালে চুমু খেয়েই পেট ভরে যায়। চাট নিয়ে আর ভাবার টাইম থাকে না। সেন্ট্রাল বারে মালের সাথে ধোঁয়া ওঠা ছোলা সেদ্ধ চাট হিসাবে টেবিলে আসে সাথে আসে আদা বিটনুন,জলজিরার বাটি! তবে ইদানীং কালে সবচেয়ে বেশি ক্রেজ ব্রডওয়ে বার নিয়ে।ফেসবুকের চেনাজানাদের মিলনমেলা এখন ওখানেই। ওখানকার একটা চাটের খোঁজ দিয়েই আজকের গল্প শেষ করব। 
    ব্রডওয়ের মেনুকার্ড হাঁতড়েও আপনি সে পদটির সন্ধান পাবেন না। গুরু ধরতে হবে, জানতে হবে। পাশেই আনন্দবাজার এর অফিস,তাদের অনেকেরই নিত্য আনাগোনা ব্রডওয়েতে।আমিও এক আনন্দবাজারের কর্মীর থেকেই সেই গুপ্তধনের আর তার দরজা খোলার চিচিং ফাঁক মন্ত্রের খোঁজ পেয়েছিলাম। আপনারাও পরেরবার গিয়ে এ্যাপ্লাই করে দেখতে পারেন।ফ্লোর ম্যানেজারকে ডেকে বলতে হবে আজ ভালো ভেটকি এসেছে? উনি যদি একগাল হেসে সম্মতি দেন তাহলে বলতে হবে,  এক প্লেট মাস্টার্ড ফিস বানিয়ে দেওয়া যাবে কী?  উনি রান্নাঘরে ঘুরে এসে যদি মুন্ডি হেলিয়ে যান তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন আপনার দিনটা ভালো হয়ে গেলো। তবে যদি ফিরে এসে বলে স্যার মাস্টার্ড চিকেন বানিয়ে দেবো?  তবে আপনার ইচ্ছা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবেন কিনা।

    আমার এক বান্ধবীর সাথে বারকয়েক ব্রডওয়েতে মাস্টার্ড ফিস খেয়ে এই পদটির প্রেমে পাগল হয়ে যৌথভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নি এটা একদিন বাড়িতে বানিয়ে দেখতেই হবে কতটা ধারেকাছে আসে। সেইমত বাজারে আসল কলকাতা ভেটকি কিনতে গিয়ে জোর ধাক্কা খাই। বিয়ের সিজিন, বেটাচ্ছেলে গোটা মাছ ছাড়া বেচবে না!  শেষে বাধ্য হয়ে দুজনের মত ভোলা ভেটকি নিয়ে আসি। কম্পোমাইজময় মধ্যবিত্ত জীবন শালা। কোন রেসিপি ছিল না, স্বাদের অভিজ্ঞতা থেকে রাঁধা। তাই আমিও কোন রেসিপি লিখছি না। আমার বান্ধবী রন্ধনে দ্রৌপদী না হলেও কাছাকাছি। ভালোই নামিয়েছিল পদটা, ছবি দিলাম। সাথে ব্রডওয়ের মাস্টার্ড ফিসের ছবি দিলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন