শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

স্মৃতি বিস্মৃতি ও মৃত্যু ~ শৈবাল বিষ্ণু

বিষাণ বসুর ফ্যান ক্লাবের সদস্য সে বহুযুগ হলো! বিয়ের আগেই হবু স্ত্রীএর কাছে প্রচুর সুখ্যাতি আর সুনাম শুনেছি। আমার বৌ যেহেতু সে ফ্যান ক্লাবের সদস্য, তাই আমিও তাই। কিন্তু সে তো শুধু শুনে শুনেই। ভাগ্যিস ফেবু এলো, আলাপ হলো, লেখা পড়লাম। দেখলাম, নাহ এই লোকটা বেশ চিন্তাশীল প্রবন্ধ লেখে তো, কালচার করতে হচ্ছে মশাই! গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে ওর লেখা পত্তর পড়ি, চিন্তার খোরাক পাই। এই পর্যন্ত বেশ চলছিল। হঠাৎ করে একটা নীল বই হাতে এসে গেলো। মানে বইটার মলাট নীল রঙের। শুরু তো করে ফেললাম, কিন্তু এগোতেই পারছিনা। ওদিকে লেখক বারবার জিগায় পড়লাম কি? ভালো লাগলো না খারাপ। আবার নাম করা সাহিত্যিকরা বইটা পড়ে ফেলে উচ্ছসিত প্রশংসা করে ফেলছে। আমি এগোতে পারছিনা।

বইটা আসলে মৃত্যু নিয়ে। সহজ পাচ্য? নাহ! গল্পের বইও নয় যে এক ভাবে টেনে নিয়ে যাবে। সমস্যাটা দাঁড়িয়ে গেলো, যত পড়ি, তত মিল পাই। প্রতি পাতায় এমন কিছু কথা পাই, যেগুলো আমার মনের কথা, যেগুলো আমার জীবনের কথা। যে কথা গুলো বলা হয়নি, ঠিক সেই কথা গুলোই। আর তত দেরী হয়। মিলগুলোর জন্যেই দেরী হয়।
না আমার বাবা বুদ্ধিজীবি ছিলোনা, মা যদিও ইস্কুলে পড়াতো। দুর্গাপুর কারখানার শহর, শ্রমিকদের বসবাস। শ্রমিকদের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। তারাই আমার বাবা, কাকা, কাকু, জেঠু, মামু, মাসী, পিসী, কাকিমারা। পাড়ার, ওপাড়ার, বাবার অফিসের, বাবার পার্টির। পার্টির গোষ্ঠী ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের গল্প গুলোও তো এক। এগোই কি করে হুড়হড়িয়ে। সম্ভব নাকি? আমার বাবা আবার নীরব কর্মী থাকতে পছন্দ করতো, স্টেজে উঠে বক্তব্য রাখার ধরে কাছ দিয়েও যেত না। কিন্তু জীবনানন্দ পাঠে নিবীড় মনোযোগ ছিলো, সেই তাঁবুতে থাকার জীবন থেকেই, যখন ডিভিসি, যখন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ড্যাম তৈরী হচ্ছে, ক্যানেল তৈরী হচ্ছে, বাবারা সুইস কটেজে থেকে সার্ভে করছে। সারাদিনের পরে জীবনানন্দ আর সঞ্চয়িতা টুকুই সম্বল, সভ্যতার সাথে যোগাযোগ। আর দুদিনের পুরোনো ডাকে আসা অমৃতবাজার পত্রিকা।
প্রতি পাতায় এমন কিছু প্রশ্ন, এমন কিছু স্মৃতি, এমন কিছু চিন্তা, এমন কিছু ঘটনা পড়ছি, যে মনে হচ্ছে এ তো আমারও গল্প। বাবার যে বছর আশি হলো, সব দাঁত তুলে দিয়ে বাঁধিয়ে দিলো আমার বৌ। বাবার খুশী আর ধরে না। কোনোমতেই কাছ ছাড়া হতে দিত না সেই বাঁধানো দাঁত দুপাটি। সব দাঁত বাঁধানো হয়ে যাওয়া মাত্রেই বায়না ধরলো দুর্গাপুর যাবে, যাবেই। আর ভালো লাগছেনা। আমার বৌকে বললো আশি তো হয়ে গেলো, অনেকদিন হয়ে গেলো পৃথিবীতে, আর কি হবে বেঁচে থেকে। মনে মনে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতি কি হচ্ছিলো তখন থেকেই? বুঝিনি। বায়না করে দুর্গাপুরে গিয়ে দিন দশেকের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ঠিক সেই ফ্রাকচার নেক অফ দা ফিমার, আরও সাত দিনের মধ্যে চুল্লী তে চললো বাবা, সাথে সেই দুপাটি বাঁধানো দাঁত। রোজই মনে হয়, কত কত কথা বাকি রয়ে গেলো। কত কি জিজ্ঞেস করা হয়নি। কত গল্প ভালো করে শোনা হয়নি। কত প্রশ্ন করা হয়নি। বিষাণ লিখেছে অপেক্ষা করে। সেই ২০০৭ থেকে অপেক্ষা করছি, বৃথাই অপেক্ষা। আর হ্যাঁ আমিও তো স্টেডি ছিলাম। কাঁদিনি, প্রলাপ বকিনি , এমনকি প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ ও করিনি। বিরিভমেন্টের প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছে বিষাণ, ও পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে। বিষাণের এই বই যদি ২০০৭ এ হাতে পেতাম, কিছু সুবিধে হতো? মনে হয় হতো।
বিষাণ বলেছিলো ওর লেখা বই নিয়ে লিখতে। আর আমি আমার কথা, আমার বাবার কথা লিখে চলেছি। আসলে হয়তো এটাই এই বইয়ের মূল সার্থকতা। মনের কোনো কোণে বাবাকে নিয়ে যে চিন্তাভাবনা গুলো কাউকে বলিনি, কোথাও লিখিনি, সেগুলো বেরিয়ে এলো অজান্তেই । বিষাণ প্রতিটা অধ্যায়ে একটা নতুন দিক নিয়ে ভেবেছে, এবং সব থেকে বড় ব্যাপার একজন পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ভেবেছে, দেখেছে, দেখিয়েছে। এটাও কম পাওয়া নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে এতো দৌড়চ্ছি , কেন দৌড়োচ্ছি? যা কিছু দৌড়াদৌড়ি, যা কিছু সঞ্চয় সে কি শুধুই জীবনের শেষের কয়েক ঘন্টা এসি ঘরে, পাঁচ তারা হাসপাতালে চারিপাশে বিপ বিপ শব্দের মধ্যে একটা বেড নাম্বার হয়ে অস্তিত্বহীন, একটা স্টেরাইল, যান্ত্রিক মৃত্যুর জন্যে? জাস্ট কোনো মানে হয়? বিষাণ প্রশ্নটা রেখেছে। আমার মতো এলোমেলো ভাবে নয়, বিশ্লেষণাত্মক ভাবে রেখেছে। তাই বইটা শুধুই যে মৃত্যু নিয়ে তা একেবারেই নয়, বিষাণ বসুর "টুকরো স্মৃতি... ছেঁড়া শোক" প্রকৃত প্রস্তাবে জীবন নিয়েই। যাপন নিয়েই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন