মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বাঙালী মানে কী ~ রেজাউল করীম

বড় লেখা। না পড়লেই ভালো। পড়লে ক্ষতি হবে না অবশ্য।
জাঁ পল সাত্রে ইহুদি সম্পর্কে বলেছিলেনঃ "ইহুদি" একজন স্বাভাবিক মানুষ। অন্যরা তাকে ইহুদি ভাবে ও তার উপর "ইহুদি" তকমা আরোপ করে। তার উপর যে ঘৃণার পাহাড় গত দুহাজার বছর ধরে নেমে এসেছে তারজন্য তার দায় যৎসামান্য।
এই কথা কটি বলে রাখলাম এজন্য যে আমার পরের কথাগুলো বুঝতে একটু সুবিধা হবে। ১৯৭৯ সাল। গাঁয়ের বাংলা মিডিয়ামে পড়ে কলকাতা শহরে পড়তে এসেছি। ১৫ বছর বয়স আর ত্রিশ কেজি ওজনের বালক মাত্র। ক্লাসে একজন জিজ্ঞাসা করলো, নাম কি? বললাম নাম। বললোঃ ও আমি ভেবেছিলাম, তুমি বাঙালী! এর পরের ধাক্কাটা আরো ভয়ানক। আমার পাশে দুজন আর্টসের ছেলে বসতো। তারা উর্দু মিডিয়ামের কিন্তু নাসির আলির ইংরেজি ক্লাসে তারা আসতো। একজনের নাম এখনো মনে আছে, রিয়াজ। সে বললোঃ তুমি মুসলমান কি রকম? তুমি তো বাংলায় কথা বলছো!
আত্মপরিচয়ের এই সংকট নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। যে হীনমন্যতা পরিচয়ের সংকট থেকে গড়ে ওঠে তা মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি ফেসবুক ও শহরের আনাচেকানাচে বাঙালীত্বের ঝড় উঠবে। আজ সবচেয়ে বেশি মনে রাখার দিন যে বাঙালী একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, কেবলমাত্র একটি বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের মধ্যে তার সীমানা নয়। শুধু ধর্ম আলাদা বলেই কেউ ব্রাত্য নয়, বাঁকাচোখে হাসা নয়।
গঙ্গা-পদ্মা-করতোয়া-লোহিত্য ছাড়িয়ে মগধ ও প্রাগজৌতিষ একসময় ছিল বাঙালীর চারণভূমি।বাঙালী প্রাচীন জাতি, নিদেন পাঁচহাজার বছরের পুরনো। বাঙালী বর্ণসংকর জাতি- মূলতঃ আদি-অস্ট্রেলিয়, মিশর-এশিয় মেলানিড , আলপাইন ব্রাকিড এবং স্বল্প পরিমান নেগ্রিটো ও মঙ্গোলীয় এই সাড়ে বত্রিশ ভাজা বাঙালী জীনে উঁকি মারে। রক্তপরীক্ষা করে দেখা গেছে বাঙালী উঁচু জাতি, নীচু জাত, হাড়ি বাঙালী, ডোম বাঙালী, মুসলমান বাঙালী, খৃষ্টান বাঙালী সবার জিনগত বৈশিষ্ট্য এক। নাকের উচ্চতা, চোয়ালের হাড়, করোটির আকার, মুখ ওচোখের আকার ও উচ্চতার যে বাহ্যিক ফারাক তার কারন হল দীর্ঘ মুণ্ড ও দীর্ঘ বা মধ্যনাসা এসেছে যথাক্রমে তার অস্ট্রেলিয় ও মেলানিড জীন থেকে আর তুলনামূলক গোল মুণ্ড এসেছে ব্রাকিড জীন থেকে।
বাঙালীর যে বিভেদ তারজন্য শুধু ইংরেজের দোষ দিলে ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে করতে হবে। The rise of Islam in eastern frontier বইয়ে ইটন সাহেব লিখেছেন মূলতঃ নীচু শ্রেণীর ১৪টি জাতি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। মূলত চণ্ডাল, লোধ, শবর ও নমস্য শুদ্ররা এবং কারুশিল্পী শ্রেণী মুসলিম হয়। তথাকথিত নীচু শ্রেণীর হিন্দু ও জলচল গোষ্ঠী ও তার উপরের শ্রেণীর নৈমিত্তিক দ্বন্দ্ব ধর্মান্তরের সাথে সাথে বন্ধ হয়নি বরং তা আরো তীব্র হয়েছে। ধর্মত্যাগীর প্রতি বিদ্বেষ হয়তো বেশিই। তাই বাঙালীর ধর্মীয় বিভেদের ইতিহাস ও কম করে হলেও দু হাজার বছরের পুরনো।
আবার এখন যেমন হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ দেখছি, একসময় এই বাংলায় শাক্ত-বৈষ্ণব বিদ্বেষ ছিল। তার আগে ছিল বৌদ্ধ হিন্দু লড়াই। হরপ্রসাদ লিখেছেন: বৃহত বঙ্গে এক কোটি বৌদ্ধ ছিলেন। এই বঙ্গে হেন গ্রাম ছিল না যেখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল না। এখন তার এক খানা ইঁট ও দেখা যায় না। মাঝ খানে ছিল বৌদ্ধ মুসলিম লড়াই। তার ও আগে ছিল উঁচু হিন্দুর সাথে নীচু হিন্দুর লড়াই। বাঙালী ছিল ব্রাত্য। " অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধেহপি চ। তীর্থযাত্রা বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।।" এই ছিল বিধান- এই সব দেশে যেতে পারেন কিন্তু ফিরতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
জরাসন্ধ, ভগদত্ত, নরক, পৌণ্ড্র, বাসুদেব এমনকি কৃষ্ণ-জ্ঞাতি নেমিনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বৌদ্ধ পুঁথি, বৌদ্ধ বিহার নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বৌদ্ধ দেবতা নাম বদলে হিন্দু দেবতা হয়েছেন। তারাদেবী, একজটা, ভদ্রকালি ইত্যাদি। নেড়ে বৌদ্ধ প্রাণভয়ে নেড়ে মুসলিম হয়েছে। অনেকে হিন্দু সমাজে ঠাঁই পেয়েছে অন্তঃজ হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বৌদ্ধ ডোম পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা যায়। মেথর যে বৌদ্ধ তান্ত্রিকের হিন্দু ধর্মে পুনর্বাসিত হওয়ার চিহ্ন তা দীনেশচন্দ্র সহ অনেকেই মনে করেন। যদি চৈতন্যদেব না থাকতেন তাহলে বাংলায় হিন্দু থাকতেন কিনা সন্দেহ আছে (বৃহত বঙ্গ, পৃঃ ১০-১১)।
বাংলায় চারটি প্রখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ছিল। নালন্দা ধ্বংস হয়েছে বখতিয়ারের হাতে। কিন্তু, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুর ও সুবর্ণবিহারের কোন খোঁজ নেই। প্রকৃতপক্ষে, বৌদ্ধযুগের অন্তিমপর্ব থেকে সেনযুগ পর্যন্ত লিখিত ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব আছে। অথচ, অজস্র শাস্ত্রের বই রচিত হলেও যেন, ইচ্ছা করেই সামাজিক ইতিহাস লেখা হয় নি। শঙ্কর বিজয় ও শূন্য পুরানে তার কিছু পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
আজ ভাষা দিবসে বাঙালী কি শিখবে যে বাঙালী মানে যে বাংলায় কথা বলে সে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি? যে বাংলা বলে, বাঙালীর মতো খায়, বাংলায় ভাবে, বাংলায় স্বপ্ন দেখে সেই বাঙালী- এমন স্বপ্ন যে স্বপ্ন বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন আছে তাকে সে আপনার ভাববে। মুসলমান শুনলেই ভুরু কুঁচকে উঠবে না। শুনতে হবে না যে তুমি বাঙালী না মুসলমান।
বাঙালী যেদিন নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শিখবে আস্তে আস্তে সে নিজের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করবে, বাংলায় নাম উচ্চারণ করবে গর্বের সাথে। আরবি উর্দুর প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই কিন্তু ভবিষ্যতের বাঙালী মন প্রাণ দিয়ে নামে-কর্মে-মরমে বাঙালী হয়ে উঠবে। তবু মনে রাখতে হবে উদার বাঙালী যেমন মিশ্র জাতি তার ভাষাও তেমনি মিশ্র।
বাংলা সংস্কৃতিতে আরবীয় প্রভাব আছে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আরবীর চেয়ে ফার্সি প্রভাব বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে দৈনন্দিন কথাবার্তা চালানোই মুস্কিল। মনে রাখা দরকার পারসিরা কিন্তু আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধী। তারাই সর্বপ্রথম কোরান আরবীতে পড়তে অস্বীকার করেছিল।
নীচের অসম্পূর্ণ সারনী গুগল থেকে নেওয়া-
১) বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি ও তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের প্রভাবে মূল বাংলা শব্দেরই বিলুপ্তি ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি বাংলা শব্দ বন্ধনীতে উল্লেখ করা হলো: খরগোশ (শশারু), বাজ (সাঁচান/সয়চান), শিকার (আখেট), নালিশ (গোহারি), বিদায় (মেলানি), জাহাজ (বুহিত), হাজার (দশ শ) ইত্যাদি।
২)দস্তখত জরিমানা, জেরা, অছিয়তনামা, তামাদি, দারোগা, নালিশ, ফয়সালা, ফরিয়াদ, রায়, সালিশ, পারওয়ানে, ফরমান, মুনশি, ওকালতনামা, পেশকার ইত্যাদি।
৩) জমিদার, তখত, তহশিলদার, তালুক, তালুকদার, নবাব, বাদশা, বেগম, বাহাদুর, কামান, তীর, তোপ, ফৌজ ইত্যাদি।
৪) কাগজ, কেচ্ছা, পীর, বুজুর্গ ইত্যাদি।
৫) আতর, আয়না, গোলাপ, গুলদানি, চশমা, দালান, মখমল, ফারাশ ইত্যাদি।
৫)পা, সিনা, গরদান, পাঞ্জা,চশমা।
৬) আচকান, জোববা, চাদর, পর্দা, শালওয়ার, পিরাহান, কামারবান্দ ইত্যাদি।
৭) বিরিয়ানি, গোশত, হালুয়া, কাবাব, কিমা, মোরববা, সব্জি, আনার, কিশমিশ, পেস্তা, বাদাম ইত্যাদি।
৮) হিন্দু, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি।
৯) কারিগর, খানসামা, খিদমাতগার, চাকর, দোকানদার, বাজিকর, জাদুকর ইত্যাদি।
১০) বাবা, মা, দাদা, খালা, দামাদ, কানীজ, দোস্ত, ইয়ার ইত্যাদি।
১১) সরাইখানা, মোসাফেরখানা, ইয়াতীমখানা, কারখানা, বালাখানা, আসমান, যমীন, বাজার ইত্যাদি।
১২) খরগোশ, বুলবুল, কবুতর, বাজ, তোতা, হাইওয়ান, জানোয়ার ইত্যাদি।
১৩) আওয়াজ, আবহাওয়া, আতশ, আফসোস, কম, কোমর, গরম, নরম, পেশা, সফেদ, হুশিয়ার, হরদম, সেতার ইত্যাদি।
ফারসি ভাষা বাংলা ব্যাকরণকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন ফারসি 'মাদী' ও 'মর্দা' (মার্দ) শব্দের প্রয়োগে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়: মর্দা-কবুতর, মাদী-কবুতর; মর্দা-কুকুর, মাদী-কুকুর ইত্যাদি। অপরদিকে ফারসি 'মোর্গ' শব্দটি মোরগ ও মুরগি ।
ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের মাধ্যমে অনেক বাংলা শব্দ গঠিত হয়েছে; আবার অনেক ফারসি শব্দ মূল অর্থসহ বাংলায় ব্যবহূত হচ্ছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফারসি আ বা া-চিহ্ন বাংলায় লোপ পেয়েছে; যেমন: কামার কমর; গারম গরম; নারম নরম ইত্যাদি। আবার অনেক বাংলা শব্দ ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটি স্বতন্ত্র অর্থ ও ভাববিশিষ্টি শব্দ তৈরি করেছে, যেমন: কেরানিগিরি, বাবুগিরি, দর-পত্তর, বে-গতিক ইত্যাদি।
আজ এই ভাষা দিবসে প্রত্যেক বাঙালী নিজের ইতিহাস নিয়ে ভাবুক। কিভাবে ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে, নানা ভাষার সম্মিলনে ভাষা পরিবর্তন হয়েছে, কিভাবে বাঙালী উদারতা অর্জন করেছে।
এই লেখা শুরু করেছিলাম যে কথা দিয়ে সেখানে ফিরে যাই- কোন গোষ্ঠীকে যদি ধর্ম দিয়ে ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়, তার সব সামাজিক সত্ত্বার গায়ে যদি ধর্মের আলখাল্ল পরিয়ে ব্রাত্য করে রাখা হয় তাহলে বৃথা আমাদের বাঙালীত্ব।
বর্তমানে উগ্র ওয়াহাবী চিন্তা-চেতনা ১৮৪০-৭৮ কে মনে করিয়ে দেয়, উগ্র হিন্দুত্ব শশাঙ্কের যুগ মনে করিয়ে দেয়। এই দুই উগ্রতার বিরুদ্ধে বাঁচতে হলে বাঙালীত্বকেই হাতিয়ার করতে হবে। বাঙালী মানে উদারতা, বাঙালী মানে সংস্কৃতির পীঠস্থান, বাঙালী মানে কফি হাউসের আড্ডা, বইমেলা-সংস্কৃতিমেলা, বৈশাখে নববর্ষ উৎসব, বসন্ত উৎসব, দোল, রাখি বন্ধন, ইলিশ উৎসব, রবিবার দুপুরে খাসির মাংস, ফুচকা, ঝালমুড়ি, বাঙালী মানে ঘনাদা-ফেলুদা-টেনিদা-বাঁটুলদা-কেল্টুদা-হাঁদা-ভোদা। আরো কতকি সে লিষ্টির শেষ নেই। মিষ্টিরও শেষ নেই। পৃথিবীতে মিষ্টি দই একমাত্র আমরাই খাই। সাত দশ খানা বাটি সাজিয়ে গাদা গুচ্ছের তরকারি দিয়ে ভাত আমরা ছাড়া আর কেউ খায় না। সুক্তো কেউ খেতে জানে? ফিস্টির নাম কেন পৌষালো কেউ জানে? (বাঙালীর আবেগ ঝরে পড়ে ফিদেলে, চে তে। মাও সে তুং, লিন পিয়াও, মার্কস-এঙ্গেলস- লেনিন- বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন! এটুকু না বললে বাঙালীর বোঝা যাবে না।)
স্বাধীনতার আগে বিশ্বের জিডিপির ২০ শতাংশ আমাদের ছিল। আবার আমরা জগৎ সভায় আসন নিতে চাই। তার জন্য দরকার জনগনমন ঐক্য, চাই শয়নে স্বপনে বাঙালী হয়ে ওঠার সাধনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন