ক্যাপ্টেন সেহগল সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় বারেবারেই ঘুরত। যে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়েছে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে, যিনি ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নিয়ে যে বই পেতেন সেই বইই পড়ে ফেলতেন, যাঁর মনে গভীরতম রেখাপাত করেছিল এডগার স্নো-এর 'Red Star over China', সেই ক্যাপ্টেন সেহগল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন না কেন ? আমি দীর্ঘদিন এর উত্তর ভেবে এসেছিলাম হয়তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সুভাষ-কমিউনিস্ট বিরোধের জন্য ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নিজে মতাদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট হলেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেনের স্মৃতিকথা সহ বিভিন্ন বইপত্র পড়ে দেখেছি বিষয়টি ছিল আদতে উল্টো। ক্যাপ্টেন সেহগল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন -
"যাইহোক, এত কাজ সত্ত্বেও আমার মধ্যে একটা ছটফটানি ছিল, সেটা প্রধানত রাজনৈতিক। যে-ভাবে কাজকর্ম চলছে তাতে আমি একটুও সন্তুষ্ট ছিলাম না। স্বাধীনতার ফলভোগ করছে কেবলমাত্র কয়েকটি লোক। শ্বেতকায়দের জায়গা দখল করেছে কৃষ্ণকায়রা। নিয়ম সব একই রকম রয়েছে, যদি এর পরিবর্তন না হয় তবে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকবে। আমার নিজের বিশ্বাস ছিল, এখনও আছে, যে কেবলমাত্র আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেতে পারে এমন সমাজতন্ত্র আমাদের সমস্যার সমাধান করার সাহায্য করতে পারে। বার্মা থেকে ফেরার পর থেকে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক কাজ করার জন্য। কিন্তু তাঁরা আমায় (ফ্যাসিস্ট) জাপানী যোগাযোগের জন্য এড়িয়ে চলেছেন।"
কংগ্রেসের লোকেরা তাঁকে আরও জঘন্য ভাবে অপমান করেছিল, তার বিস্তৃত বিবরণও তাঁর স্মৃতি কথায় আছে। ভারতীয় জনসঙ্ঘের রাজনীতিকে তিনি প্রবল অপছন্দ করতেন। সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতেও তাঁর ভরসা ছিল না। তিনি শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরাই তাঁকে এড়িয়ে যেতেন। সুভাষচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি ক্যাপ্টেন দায়বদ্ধ ছিলেন। 'যা করেছি ভুল করেছি' এই মুচলেকা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যাপ্টেন সেহগলের পক্ষে দীর্ঘকাল আর রাজনীতিতে আসা সম্ভব হয় নি। সুযোগ হল পার্টি ভাগের পর, বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। সিপিআই-এর সুভাষচন্দ্র বা আই.এন.এ নিয়ে যে মূল্যায়ন বা ছুঁতমার্গ ছিল, নবগঠিত সিপিআই(এম)-এর তা ছিল না। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে স্বয়ং জ্যোতি বসু ক্যাপ্টেন সেহগলকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন কলকাতায় পিপলস রিলিফ কমিটিতে যোগ দিতে। লক্ষ্মী অভিমান করতে পারতেন, কমিউনিস্টদের পূর্ববর্তী শীতলতার, প্রত্যাখ্যানের শোধ নিতে পারতেন। তিনি তার ধারে কাছ দিয়ে গেলেন না, কমিউনিস্টদের তিনি চিরকালই আপন মনে করে এসেছেন, কমিউনিস্টরাই তাঁকে নিজেদের লোক মনে করেনি। যখন এই ব্যবধান দূর করার সুযোগ এল, তিনি সানন্দেই নিলেন। প্রথমে পিপলস রিলিফ কমিটি পরে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তিনি যা কাজ করলেন তা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে সদস্যপদ দেওয়ার কথা হয়। লক্ষ্মী অবশ্য সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে একবার দেখা করেছিলেন পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে। সেখানে সুভাষচন্দ্র আর আই.এন.এ নিয়ে পার্টির নেতাদের মতামত কি সেটা বুঝে নিয়ে তারপরই পার্টিতে যোগ দেন। পূর্বেই বলেছি, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করে না, এমন দলে তিনি যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন না।
ক্যাপ্টেন সেহগলের আজ প্রয়াণ দিবস। তিনি বারবার বলেছিলেন, স্বাধীনতা তিন ধরণের হয় - রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। ভারতে শুধু আমরা প্রথম স্বাধীনতাটি অর্জন করেছি। বাকি দুই স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয় নি। সেই অর্জনের পথে যে বিরাট পাহাড় আছে, তাতেই আমাদের হাতুড়ির ছোট ছোট ঘা মেরে যেতে হবে। একদিন পাহাড় ভেঙে রাস্তা দেখা যাবেই। ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করতেন এই কথা, আমরাও করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন