সোমবার, ২৯ মার্চ, ২০২১

নন্দীগ্রাম ~ সুশোভন পাত্র

পাঁচ বছর আগে এক সন্ধ্যায় প্রথমবার আলিমুদ্দিন গিয়ে ঘড়ি ধরে ৩০ সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মাথা ভর্তি সাদা চুল,  গাল ভর্তি দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে বুদ্ধবাবু, 'ফিরে দেখা'র ডিকটেশন দিচ্ছেন। আমি লেখালিখি করার চেষ্টা করি শুনে বললেন, 'লেখ। আমাদের যে ভুলের কথা গুলো কেউ লিখছে না, সেগুলোই সাহস করে লেখ।' 
কাল যখন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রামের স্বীকারোক্তি শুনেছি, পাঁচ বছর আগের সন্ধের ৩০ সেকেন্ডের ঐ অমলিন মুহূর্তটা চোখে ভাসছে বারবার। বুদ্ধবাবু মাফ করবেন। আমি আজ 'আমাদের ভুলের' কথা লিখতে বসিনি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নন্দীগ্রাম এবং পরে সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যে, দেশে, বিদেশে আপনার বিরুদ্ধে, বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে, 'আমাদের' বিরুদ্ধে; প্রতিদিন, 'ভুলের' নামে ষড়যন্ত্রের গালগল্প লেখার, কাব্য করার ছ্যাবলামি অনেক হয়েছে। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!  
তৃণমূল তো ছিলই। গৃহপালিত মিডিয়া তো আছেই। বিসেলেরির ঠাণ্ডা বোতলে চুমুক দিয়ে, কালো সানগ্লাস চোখে চাপিয়ে শহীদ বেদী তে লাথি মারা বুদ্ধিজীবী, কফি হাউসের সিগারেটখোর আঁতেলবাজ, সিপিএম'র থেকে আর একটু বেশি লেনিন জানা স্বাধীন-লিবারেল অণু কিম্বা আর একটু বেশি মার্ক্স বোঝা সংশোধনবাদী সিপিএম কে 'প্রকৃত বিপ্লবের' শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া অতি বাম পরমাণু –নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের আদ্যোপান্ত ষড়যন্ত্র কে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস'-র স্ট্যাম্প মেরে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে অবিরাম। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!
মর্ফড ছবিতে আপনার মুখে ক্যানাইন দাঁত বসিয়ে, আপনার পাঞ্জাবি তে রক্তের দাগ লাগিয়ে, আপনাকে 'খুনি বুদ্ধ' হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে, পুঁজিবাদের দালাল সাজিয়ে দিয়ে, 'পরিবর্তন চাই' ফেস্টুনে দাঁত কেলিয়ে, নেতা-মন্ত্রীর টিকিট বাগিয়ে, রেল কমিটির ল্যাজ ধরে পয়সা কামিয়ে, ক্যাডবেরি খাওয়া 'অনশন'-'আন্দোলনের' দোহাই দিয়ে রাজ্যটাকে ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া অনুঘটকদের মাতব্বরি অনেক হয়েছে। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!  
দৃপ্ত কণ্ঠে, কলার তুলে, বুক বাজিয়ে আবারও বলতে চাই; আগেও বলছি, পরেও বলব –কোন ভুল সেদিন বুদ্ধবাবু করেননি। কোন ভুল সিদ্ধান্ত সেদিন বামফ্রন্ট সরকার নেয়নি। কোন বিচ্যুতি সিপিএম-র হয়নি। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে একইঞ্চি 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' হয়নি। যা হয়েছিল সেটা আগাপাশতলা  নোংরা রাজনৈতিক চক্রান্ত। আদ্যোপান্ত একটা ষড়যন্ত্র।   
টানা বাহাত্তর দিন পুলিশ-প্রশাসনের প্রবেশ নিষিদ্ধ তখন নন্দীগ্রামে। বিস্তীর্ণ এলাকা তখন অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামে। ভাঙা রাস্তা, ভাঙা সেতুর দৌলতে বিপন্ন, বিচ্ছিন্ন জনজীবন নন্দীগ্রামে। 'জমি আন্দোলনে'র সলতেতে সাম্প্রদায়িকতার বারুদ তখন নন্দীগ্রামে। বিরোধী নেতা-সাংসদ'দের মদতে বেআইনি অস্ত্রের পাহাড় জমছে তখন নন্দীগ্রামে। একদিনে সিপিএম'র ২৫টা পার্টি অফিসে আগুন জ্বলছে তখন নন্দীগ্রামে। নিয়ম করে শঙ্কর সামন্ত, সুনীতা মণ্ডলদের লাশ পড়ছে তখন নন্দীগ্রামে। 
লাগাতার হামলা শুরু হয় শিল্পের পক্ষে থাকা গ্রামবাসীদের উপর। কেউ ঘরছাড়া, কেউ খুন, কেউ ধর্ষিতা। প্রশাসনের ডাকা সাত-সাতটা শান্তি বৈঠকে যোগ দিলো না তৃণমূল। ৯'ই ফেব্রুয়ারি যেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু হেড়িয়ার জনসভায় বলেছিলেন "মানুষ না চাইলে কেমিকাল হাব হবে না নন্দীগ্রামে। অধিগ্রহণ হবে না এক ইঞ্চি জমিও"; ঠিক সেদিনেই পেট চিরে পুলিশ কর্মী সাধুচরণ চ্যাটার্জি'র লাশটা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল হলদি নদীর জলে।
কি করত সরকার? বুড়ো আঙুল চুষত? ললিপপ খেতো? ১৪ই মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশকে গোপনে পাঠায়নি বামফ্রন্ট সরকার। ১২ই মার্চ সাংবাদিক সম্মেলন করে পুলিশ যাওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে তবেই নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকেছিল। শখে গুলিও চালায়নি পুলিশ। মাইকে ঘোষণা, কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট, শূন্যে গুলি -আইনি কপিবুকের ক্রনোলজিতে ভুল করেনি সেদিন পুলিশ।
২০১৪'তে নন্দীগ্রামের ঘটনার চার্জশিট জমা দিয়েছিল সিবিআই। সিপিএম'র 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' কোন নিদর্শনই খুঁজে পায়নি সিবিআই। তালপাটি খালে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে 'সিপিএম'র হার্মাদ বাহিনীর হাতে পা চিরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটাও শিশুর লাশ খুঁজে পায়নি সিবিআই। গোটা নন্দীগ্রাম ঘুরে একটাও 'স্তন কাটা মহিলা' খুঁজে পায়নি সিবিআই। 
বরং চার্জশিটে বলা হয়েছিল, সেদিন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া হচ্ছিল। বলা হয়েছিল, হামলাকারীদের হাতে তীক্ষ্ণ অস্ত্র ছিল। বলা হয়েছিল, "নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসন এবং পুলিশ অফিসাররা চেষ্টা করেছিলেন। বৈঠকে বিরোধী দলগুলির নেতা এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অনুপস্থিতির জন্য তা সম্ভব হয়নি।" 
যারা এরপরেও ২০১১-র বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় কে স্বাভাবিক গণতন্ত্রীয় লিনিয়ার ইকুয়েশন মনে করেন, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর কে সিপিএম'র 'ক্লাস ক্যারেক্টার'-র স্খলন বলে মনে করেন, কিম্বা নেত্রী মমতার একক রাজনৈতিক ক্যারিশ্মার জাবর কাটেন, তারা কি বলতে পারেন ক্ষমতায় এসে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের পদন্নোতির ব্যবস্থা কেন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বলতে পারেন, কেন তৃণমূল-মাওবাদী-জামাতের নেক্সাস কে প্রচুর অস্ত্র মজুতে মদত দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? 
আর যারা বিজেপির বাইনারি তে দোল খাচ্ছেন তারা কি বলতে পারেন, কেন্দ্রীয় সরকারের একই সময় অনুমোদিত নন্দীগ্রামের মতই একটি পেট্রো রসায়ন শিল্প তালুক গুজরাটের দাভোসে হল কি করে? আর হলে, এখানে বিজেপি, সেদিন তৃণমূলের শিল্প বিরোধী ষড়যন্ত্রের পার্টনার ছিল কি করে? না, গুজরাটের মত আম্বানিদের বরাত না দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে শিল্প করতে চেয়েছিল বলে বিজেপির গোঁসা হয়েছিল? কিম্বা আরএসএস-র দুর্গা কে পলিটিক্যাল মাইলেজ দিতে হবে বলে কি বিজেপি কসম খেয়েছিল? 
চার আনার পলিটিক্যাল পণ্ডিতরা সেদিন বলেছিলেন বুদ্ধবাবুর 'নৈতিক পরাজয়'। মাননীয়া বলেছিলেন বামফ্রন্টের কৃতকর্মের 'পাপস্খলন' । জানতে চাই কোন পাপস্খলন? কিসের নৈতিকতা? আজ যে, নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া বাংলার যুব সমাজের হিমোগ্লোবিনে প্রতিদিন মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মের আফিম; ভেঙে ফেলা হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি, রাজবংশী-মতুয়ার আইডেন্টিটির টুকরোতে -সেই পাপস্খলনের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা, তার দায় বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা অবশ্য সেদিনও মাননীয়ার ছিল না, আর আজও নেই। রাজ্যের যুব সমাজের এই সামাজিক ও নৈতিক স্খলন চাক্ষুষ করার মত দূরবীন সেদিনও জাতীয় সড়ক অবরোধকারী অনশন মঞ্চে ছিল না, আজও নবান্নের চোদ্দ তলায় নেই। 
না! আজকে নন্দীগ্রামের চক্রান্তের পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে বলে প্রায় শয্যাশায়ী, রোগাক্রান্ত বুদ্ধবাবুর নামে সিম্প্যাথি কুড়িয়ে ভোটের বৈতরণী পেরোনোর চেষ্টা করছে না সিপিএম। হুইলে চেয়ারের মেলড্রামা কিম্বা দাড়ি বাড়িয়ে জোকার সেজে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার বদভ্যাস বামপন্থীদের কোনদিন ছিল না। আজও নেই।   
বরং আপামর দুনিয়ার বহমান কমিউনিস্ট আন্দোলনের ও পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিকতার যে  প্রেক্ষিতে বুদ্ধবাবু বাংলা কে গড়ার চেষ্টা করেছিলেন সেই সময়ে, রাজ্য তো বটেই, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও তার গুরুত্ব বোঝে সিপিএম। ৬২ সাংসদ নিয়ে অপ্রতিরোধ্য বামেদের সেই সময় বোতলবন্দী না করতে পারলে কোন শ্রেণীর মানুষের ক্ষতি হতে পারতো সেই শ্রেণীশত্রুদের চেনে সিপিএম। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর জঙ্গলমহল, কিম্বা গোর্খাল্যান্ড -সেই সময়ের বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে রামধনু জোটের বে-নি-আ-স-হ-ক-লা, প্রতিটা রঙ কে আলাদা করে বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে সিপিএম-র। রাজনীতির রিলে রেসে বুদ্ধবাবুর তুলে দেওয়া ব্যাটন নিয়ে লড়াই করার বারুদ বুকে আছে আমাদের। আর তাই সিম্প্যাথি কুড়োতে নয় লড়তে শিখতে হয় আমাদের।   
ফিদেল বলেছিলেন History will absolve me। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন "একটা বড় চক্রান্তের শিকার রাজ্য। ১০ বছর মানুষ ঠিক বুঝতে পারবেন।" পারছেনও। পারবেনও। History কি Absolve করবে কি করবেনা সেটা সময় বলবে। কিন্তু ইতিহাস পড়ার জন্য নয়, ইতিহাসে গড়ার জন্যই লড়ছি আমরা। লড়ছে মীনাক্ষী, লড়ছে সায়নদীপরা। লড়ছে আকিক ,সাদ্দাম, প্রতিকুর, সৃজনরা। লড়ছে দিপ্সিতা-ঐশী-পৃথা-সেলিম-সুজন-পলাশরা। লড়ছি আমরা, বামপন্থীরা। লড়ছি রাজপথে। লড়ছি আলপথে। হেঁটে এবং নেটে। লড়ছি নির্বাচনেও। লড়ব নির্বাচনের পরেও। লড়ব শেষতক। জিতব শেষতক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন