পাঞ্জাবের খুব বেশি মানুষকে আমি চিনি না। যাদের চিনি তাদের একজনের পতাকা তোলার গল্প শুনিয়ে যাই-
"মার্চ ১৯৩২ সাল। ওই সময় সবে পরীক্ষা দিয়ে উঠেছি, সায়েন্স প্র্যাকটিক্যাল তখনো বাকি। ভগত সিং এর প্রথম শহিদ বার্ষিকী পালনের কথা হচ্ছে। গর্ভনর এর সেদিন জলন্ধর থেকে ৪০ কিমি দূরে হোসিয়ারপুর দেখতে আসার কথা। জেলা কংগ্রেস কমিটি ঘোষণা করলো যে সেদিন জেলা আদালত প্রাঙ্গনে ইউনিয়ান জ্যাক এর বদলে ত্রিবর্ন পতাকা ওড়ানো হবে। এই কর্মসূচি বানচাল করার জন্য জেলা শাসক আর্মি মোতায়েন করেন আর কেউ পতাকা তোলার চেষ্টা করলে তাকে গুলি করার আদেশ জারি করেন।
সেদিন হোসিয়ারপুর পোঁছে মন খারাপ। শুনলাম পতাকা তোলার কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। কংগ্রেস অফিস সম্পাদক হনুমানজির কাছে দাবি করলাম কেন বাতিল হল। উনি প্রশ্ন করলেন, গুলি চালানোর আদেশ এর কথা আমি জানি কি না। তাই শুনে খেপে গিয়ে পাল্টা বল্লাম, "গুলি খাওয়ার ভয়ে আপনারা হাল ছেড়ে দিলেন ? এত জাতির প্রতি অপমান!" উনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসেন," এতই যদি তোমার সাহস, তাহলে তুমিই পতাকা তুলে দেখাও।"
আমি অফিসের একটি ডান্ডায় লাগানো পতাকা খুলে নিয়ে কোর্টের দিকে দৌড়ালাম। সেই আদালত যাকে সেই সময়ে ব্রিটিশ শক্তির একটা নিদর্শন হিসেবে ধরা হতো। কর্মসূচির নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়াতে তখন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটু ঢিলেঢালা ভাব। তার সুযোগ নিয়ে সিঁড়ি টপকে ছাদে উঠলাম, ইউনিয়ন জ্যাক খুলে নামিয়ে দিলাম। লাগিয়ে দিলাম ত্রিবর্ন পতাকা। তাই দেখার পরে গুলি চালানো শুরু হয়। দুটো গুলি আমার কাছ দিয়ে বেরিয়ে যায়, গায়ে লাগেনি। ডেপুটি কমিশনার বাখলে বেরিয়ে আসেন। আমাকে বাচ্চা ছেলে দেখে তিনি গুলি চালানো বন্ধ করার আদেশ দেন। আমি স্লোগান দিতে শুরু করি। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই, আমি নিরস্ত্র এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে সেনারা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে। আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যায়।
পরের দিন বিচার শুরু হয়। ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞেস করলে বলি, "আমার নাম লন্ডন তোড় সিং।" আসল নাম কিছুতেই বের করতে পারেনি। যা করেছি তার দায় স্বীকার করি, ভগত সিং এর অনুপ্রেরণার কথা বলি। আমার এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। "মাত্র এক বছর ?" ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বাড়িয়ে চার বছর কারাবাস এর আদেশ দেন।"
সেদিন জাতীয় পতাকা তোলার জন্য প্রাণ তুচ্ছ করে এগিয়ে আসা কিশোরের আসল নাম হরকিসেন সিংহ সুরজিৎ। ডান্ডা বেড়ি পরে অকথ্য পরিবেশে হাজতবাস করা সেদিনের সেই কিশোর পরবর্তীকালে ভারতের মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
সুরজিৎ এর ফ্ল্যাগ পোল ছিল ব্রিটিশ কোর্টের ছাদে লাগানো। এর পাশাপাশি লাল কেল্লার র্যামপার্ট এ পতাকা লাগানোর কাহিনী একটু ছোট করে আসুক।
আরএসএস এর ভাষায়, "ভাগ্যের ধাক্কায় ক্ষমতায় আসা লোকেরা আমাদের হাতে তেরঙা তুলে দিতে পারে তবে হিন্দুরা এটি কখনও শ্রদ্ধা করবেন না, নিজেদের বলে মনেও করবেন না। তিন শব্দটি নিজেই একটি শয়তানি শব্দ এবং তিনটি বর্ণের সমাহারে তৈরি একটি পতাকা অবশ্যই একটি খুব খারাপ মনস্তত্ত্ব এর জন্ম দেবে। লালকেল্লায় র্যামপার্ট এ "ভাগয়া ধজ তুলতে হবে "
লাল কেল্লার মাথায় এখনো তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে। র্যামপার্ট এর ফ্ল্যাগপোলে ভাগোয়া ধজ তুলে ধরার ইচ্ছে দেশের মানুষ পূরণ হতে দেয় নি। সেই ইচ্ছে বুকে নিয়ে গুমরে মরা আরএসএস আজ দেশ ভক্তি শেখাতে আসে লন্ডন তোড় সিংদের। হাসি পায়। হাসি।
সূত্র:
১) সাক্ষাৎকার, মানিনী চ্যাটার্জি, আগস্ট ১৬, ২০০৮ ফ্রন্টলাইন পত্রিকা
২) প্রবন্ধ, আমান সিং, মে ২৬, ২০০৯, শিখ ফিলজফি
৩) প্রবন্ধ, ভেঙ্কটেশ রামকৃষ্ণনন, আগস্ট ১৬, ২০০৮, ফ্রন্টলাইন পত্রিকা।
৪) অর্গানাইজার, আর এস এস মুখপাত্র, ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন