১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের পর থেকে চট্টগ্রাম শহরে দিনের বেলাতেই রাত নেমে আসত। সূর্য ঢলে পড়লেই ব্রিটিশ মহিলা পুরুষরা কেউ আর ঘরের বাইরে থাকত না, সে যত কাজই থাকুক না কেন। তাদের গ্রাস করেছিল এক অজানা আতঙ্ক। চারিদিকে তারা ফিসফাস শুনতে পেত ওই, ওই যে আসছে। ওই শুনেই যে যেখানে পারত লুকিয়ে পড়ত। তারা সবাই ভুতের ভয় পেত। সেই ভুতের নাম ছিল মাস্টারদা।
'মাস্টারদা' এই একটা শব্দই প্রত্যেক ইউরোপিয়ানের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলাকায় এলাকায় গল্পগাথা যেত মাস্টারদা নাকি যে কোনো সময়ে যে কোনো রকমের বেশ ধারণ করতে পারেন। কোথাও যদি শোনা যেত যে মাস্টারদা মালির বেশ ধারণ করে কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন তো পরক্ষণেই শোনা যেত অন্য কোনো জায়গায় সেই একই সময়ে মাস্টারদা নাকি সন্ন্যাসির বেশে কোনো গ্রামবাসীর সাথে কথা বলছেন। কেউ কেউ আবার বলে মাস্টারদা নাকি মন্ত্র জানেন। চোখের সামনে তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে যান। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় ব্রিটিশ পুলিশ তখন তন্নতন্ন করে খুঁজে বেরাচ্ছে মাস্টারদা কে। অথচ মাস্টারদা কে ধরা শুধু মুশকিলই নয়, নামুমকিন।
একবার গোপনে খবর পেয়ে এক বাড়ি ঘিরে ফেলল ব্রিটিশ পুলিশ। ইনফরমেশন ছিল ওই বাড়িতে নাকি মাস্টারদা লুকিয়ে রয়েছেন। বাড়ির মালিককে ধরে বেধে পুলিশের কর্তার সামনে হাজির করল কনস্টেবলরা। কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন আপনার নাম কি? উত্তর এলো সূর্য সেন। চমকে উঠল পুলিশের কর্তা। কোন সূর্য সেন? উত্তর মাস্টার সূর্য সেন। পুলিশ কর্তার তখন স্নায়ু উত্তেজন চরমে। ভাবছে সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে লোকটাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরাচ্ছে ব্রিটিশ ইন্টালিজেন্স সেই লোকটাকে এত সহজে ধরে ফেলল সে! হাত পা থরথর করে কাঁপা শুরু হয়েছে পুলিশ কর্তার। লোকটাকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম শহরে ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চে চলে গেল পুলিশ কনস্টেবলরা। সেখান থেকে মাস্টারদা সূর্য সেনের ছবি নিয়ে আসা হল। দেখা গেল এই মাস্টার তো সেই মাস্টার নয়! পরে খোঁজখবর করে জানা গেল এই মাস্টার হচ্ছে স্থানীয় একটা স্কুলের হেড মাস্টার যার নামও সূর্য সেন। মহা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ পুলিশ সাধারণ মানুষের চোখে হয়ে উঠল ইয়ার্কির পাত্র। পুলিশ দেখলেই লোকজন এখনকার ভাষায় যাকে বলে ট্রোল করা, সেই ট্রোল করা শুরু করল।
ছোটবেলা থেকেই অদম্য সাহসী সূর্য সেন ব্রত নিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার। সেই লক্ষ্যে রত ছিলেন আজীবন। কলেজে পড়তে পড়তেই অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। সেখান থেকেই বিপ্লবী জীবনে হাতেখড়ি। কলেজ শেষ করে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দেন। সেই সময়ে দেশে কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ বিরোধী একমাত্র বড় রাজনৈতিক শক্তি। কংগ্রেসে থাকতে থাকতেই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের দেশের প্রতি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করতে শুরু করেন। স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রচুর ছাত্র ছাত্রীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। সেই সুযোগকেই কাজে লাগান। ১৯৩০ সালে গণেশ ঘোষ অনন্ত সিংহ সহ আরো কয়েকজন আর বেশ কিছু স্কুল কলেজের ছাত্র নিয়ে বিপ্লবী দল গঠন করে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরিকল্পনা করলেন। আর তার সাথে টেলিগ্রাফ অফিস টেলিফোন অফিস আর রেলওয়ে দখল করে পুরো ব্রিটিশ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন।
জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অনেক সহযোদ্ধা কমরেড নিহত হলেও সূর্য সেনকে ধরা যায় নি। অবশেষে ব্রিটিশ পুলিশকে অনেক নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর পর ধরা পড়েন মাস্টারদা সূর্য সেন। জেল কাস্টডিতেই প্রভূত অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয় সূর্য সেনকে। মেরে ফেলার আগে ব্রিটিশ পুলিশ সাঁড়াশি দিয়ে সব কটা দাঁত উপড়ে নিয়েছিল। হাত পায়ের সমস্ত নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল সূর্য সেনের। কিন্তু তাও তিনি তাঁর আদর্শের প্রতি জীবনের শেষদিন অব্দি অবিচল ছিলেন।
আমাদের স্মৃতি আসলে খুব দুর্বল। অনেককিছুই ভুলে যাই। এত শত শত বিপ্লবীর আত্মবলিদানও অবলীলায় ভুলে গেছি আমরা। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি আজকের দিনেই অকথ্যা অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছিল মহান এই বিপ্লবীকে। শরীরটাকে মেরে ফেললেও তাঁর আদর্শকে মেরে ফেলা যায় নি। কারণ Ideas are bulletproof.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন