বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

চিকিৎসা ব্যবস্থা ~ ড: গৌতম মিস্ত্রি

যে ভাবে আমরা এখন হৃদরোগের চিকিৎসা করছি, তাতে সমাজের বৃহদাংশের সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। একটা কাল্পনিক গল্পের মাধ্যমে প্রসঙ্গটা ব্যাখ্যা করি। একজন উচ্চশিক্ষিত সদ্য পাশ করা নবীন চিকিৎসক নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে গেছে। হঠাৎ দেখে, একজন মানুষ নদীতে ভেসে যাচ্ছে। নদীতে ঝাঁপিয়ে তাকে তুলে, নিজের সদ্যপ্রাপ্ত চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে তাকে সুস্থ করে তুললো। এর পর সেই নবীন চিকিৎসক দেখল,  কোন আশ্চর্য্য কারণে নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায় মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। বুদ্ধিমান নবীন চিকিৎসক তার বেশ কিছু সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অক্লান্ত  প্রচেষ্টায় আরও কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারলো। কিন্তু সেই নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায়ের সংখা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।  এরপর নবীন চিকিৎসকের দল যেটা করলো, তাতে সবাই সাধুবাদ দিলো। নদীর পাড়ে একটা হাসপাতাল গড়ে উঠলো চিকিৎসকদের উদ্যোগে আর পরোপকারী(!) কিছু ব্যবসায়ীদের অর্থে। অধিকাংশ মরণাপন্ন মানুষ নদীর জলে ভেসে গেলেও নদীতে ভেসে আসা কিছু মানুষ অবশ্য বেঁচে গেলো।  নদীপাড়ে গড়ে উঠলো বড় জনপদ, অনেক চিকিৎসকের কাজের সংস্থান হল আর হল ব্যবসায়ীদের অর্থ সমাগমের সুবন্দোবস্ত।  

এই সমাজকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডে বাধ সাধলো গুটিকয় খুঁতখুঁতে চিকিৎসক।  এরা নদীর উজান বেয়ে অন্যভাবে হাওয়া খেতে গিয়ে দেখলো, এক দৈত্য একটা প্রকান্ড মুগুর নিয়ে মানুষ মেরে চলেছে। এই খুঁতখুঁতে চিকিৎসকের দল দৈত্যকে মেরে ফেললো।  হাসপাতালের ব্যবসায় মন্দা পড়লো, নবীন চিকিৎসকরা ক্ষুন্ন হলো, তবে সাধারন মানুষ বললো একটা সুচিকিৎসা হলো।

স্বাস্থ্যখাতে সরকারি আর বেসরকারি প্রচেষ্টায় যে পরিমান অর্থ ব্যয় হয়, তার মুখ্যভাগই খরচ হয়ে যায় গুটিকয় শহরের বড় হাসপাতালে।  কোন বেসরকারি হাসপাতালে কালেভদ্রে কোন জটিল অপারেশন হলে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পায়। কিন্তু এতে সামগ্রিকভাবে সমাজের মোট রোগভোগের আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোন হেরফের হয় না। খবরের কাগজের এই চমক জাগানো খবরে হরিপদ কেরানির হাঁপানি রোগের সুরাহা হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনমতেই আমাদেও মত উন্নয়নশীল দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সফলকাম হতে পারেনা।  আপৎকালীন চিকিৎসায় যৎকিঞ্চিত সরকারি পয়সাকড়ি আর স্বেছাসেবী সংস্থার উদ্যোগ নিশেঃষ না করে, প্রতিরোধমুলক চিকিৎসায় জোর দেওয়া হলে হরিপদদের মত মানুষগুলোর রোগের ফাঁদে পড়া আটকানো যায়।  ব্যক্তিগত ও সরকারি চিকিৎসাখাতে খরচের মুখ্যভাগই হৃদরোগ আর ডায়াবেটিস রোগে ব্যয় হয়ে যায়, যদিও এই দুই রোগের প্রকোপ অনেক অল্প খরচেই নিবারণযোগ্য।  যে দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা চলছে, তাতে মুষ্টিমেয় সচ্ছলের রোগউপশম (paliation), চিকিৎসকের আত্মশ্লাঘা পূরণ, আর সর্বোপরি বহুজাতিক ঔষধপ্রস্তুতকারি ও প্রযুক্তি নির্মাণকারী সংস্থার অর্থসমাগমের সুবন্দোবস্ত হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সহজবোধ্য অথচ সস্তা রোগ নিবারণে উদ্যেগের অভাব কেন?

আমার মত অল্পবুদ্ধি নগন্যকে এই সহজ প্রশ্নটা বেশ পীড়া দিলেও এর উত্তরটা বেশ জটিল।  কলেরা বা ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিষেধকের মত হৃদরোগ প্রতিরোধের কোন টিকা নেই, যেটা কিনা অল্প আয়াসে প্রয়োগ করা যায়। হৃদরোগের নিবারণের জন্য চাই বৃহত্তর সমাজের জীবনযাত্রার আর অভ্যাসের পরিবর্তন।  এই বিপুল কর্মকান্ডের সুফল চটজলদি মেলেনা।  আর এর জন্যই এই আন্দোলনটা একক ভাবে অথবা সামগ্রিকভাবে (সরকারি অথবা বেসরকারি) আকর্ষক নয়।  কেবল এই বৈষম্যটাই পীড়াদায়ক, যখন দেখি, এইডসের (aquired immune deficiency syndrome) মত রোগ, যেটা কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করে না, তার প্রতিরোধের বার্তা মিডিয়ার দৌলতে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে। প্রতিবেশী দেশ চিনেও ধূমপান বিরোধী সরকারি বিলবোর্ড আছে। চিনে প্রকাশ্যে, নিভৃতে  ঘরের কোণের বাইরে সিগারেট ফুঁকলে মোটা জরিমানা আপনাকে যৎকিঞ্চিত জরিমানার প্রতিদানে সুস্বাস্থ্য উপহার দেবে।  আমাদের দুর্ভাগ্য, মন্দির-মসজিদ আর সুউচ্চ মুর্তি খাড়া করার বাইরে সফল ও প্রয়োজনীয় জনহিতকার প্রকল্পের কল্পনাও দেশের কান্ডারীদের মাথায় নেই। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা  জানা আছে, কেবল জানা নেই তার সফল প্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক কুটনীতি।

একটা প্রাচীন প্রবচন আছে। চিকিৎসক তিন প্রকারের হয়। উচ্চশিক্ষিত, পরিশ্রমী ও সফলকাম চিকিৎসক জটিল ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে মরণাপন্ন রোগীকে সুস্থ করে তোলেন ।  এঁদের চেয়েও ভালো চিকিৎসক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই অল্প আয়াসে রোগমুক্তি ঘটাতে পারে।  সুচিকিৎসক তার বিদ্যার প্রয়োগে, রোগ নিবারণ করে থাকে। সুচিকিৎসকের কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেলে, প্রথমোক্ত চিকিৎসকদেও অবশ্য কর্মহীন হবার আশঙ্কা থেকে যায়।  সুচিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাঁদের নিষ্কন্টক কর্মকাণ্ড কামনা করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন