বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

“সন্ত” টেরিসা ও কিছু না-ওঠা কথা ~ নগর যাযাবর

মহা সমারোহে মাদার টেরিসাকে "সন্ত" উপাধি দেওয়া হলো, ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠদর্শন প্রতিষ্ঠান ভ্যাটিকান সিটিতে | এমনিতে তা নিয়ে আমাদের খুব কিছু বলার ছিলোনা, পৃথিবীতে সম্ভবত রোজই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান তার কোনো না কোনো সদস্যকে কিছু একটা উপাধি দিচ্ছে, সে দিক | কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ও প্রচারমাধ্যম ব্যাপারটাকে একটা জাতীয় গৌরব ও আনন্দের ঘটনা হিসাবে প্রচার করছে দেখা যাচ্ছে, সুতরাং রাষ্ট্র ও প্রচারমাধ্যমের যৎকিঞ্চিৎ প্রজা হিসাবে দু চারটি কথা আমাদের বলতেই হয়, পছন্দ না হলে কথাগুলো আপনারা "রামায়ণের মধ্যে ভূতের ক্যাচকেচি" হিসাবে ধরতে পারেন |

 

শুরুতেই আমরা সম্মান জানাবো মাদার টেরিসার প্রতি, ইউরোপ থেকে এসে একটা জীবন কলকাতার নোংরাতম রাস্তায় পড়ে থাকা সমাজের বঞ্চিততম মানুষদের তুলে নিয়ে গিয়ে দু-দণ্ড একটু শান্তি দেওয়ার জন্য, অনেক সময় চিকিৎসা, অনেক সময় অন্তত একটু সম্মানজনক মৃত্যুর সুযোগ  দেওয়ার জন্য | মনে রাখা দরকার যে যিনি শুধু দরিদ্রদের সেবা করেছেন, এ-কথা বললে সবটা বলা হয়না | তিনি রাস্তায় পরে থাকা অন্ধ, পঙ্গু, কুষ্ঠরোগীদের, যারা সমাজ-বিতাড়িত, সামান্যতম সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত সমাজের অসহায়তম মানুষ, তাদের রাস্তা থেকে, আবর্জনা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেবা করেছেন | সেই দুর্দশার পরিমান এই লেখার লেখক ও পাঠকের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় | অনুপ্রেরণা যাই হোক, এই কাজে গোটা জীবন নিবেদন করাটা সহজ নয়, সুতরাং সে জন্য মাদার টেরিসাকে আমাদের শ্রদ্ধা |

 

ব্যাপারটা এরমধ্যে, অর্থাৎ মাদার টেরিসার কাজ, তার থেকে পাওয়া তাঁর ব্যক্তিগত আনন্দ ও সমাজের একটা মানানসই স্বীকৃতি, তাঁর তৈরি ধর্মীয় গোষ্ঠী "মিশনারিজ অফ চ্যারিটি"র প্রসার, অনেক প্রশংসা ও কিছু নিন্দামন্দ, ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের খুব একটা কিছু বলার থাকতো না | আমরা তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা, তাঁর আদর্শগত ও রাজনৈতিক অবস্থান, তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ত্ব, তিনি কাদের থেকে অনুদান নিয়েছেন ও সমর্থন করেছেন, তাঁর হোমগুলির অবস্থা ও চিকিৎসার মান, ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, একজন মানুষের চিন্তা বা প্রচেষ্টার সবদিক গ্রহণযোগ্য নাই হতে পারে | কিন্তু ব্যাপারটা নোবেল পুরস্কার, ভারতরত্ন, সীমাহীন (অর্থাৎ ভারসাম্যহীন) খ্যাতি এবং অধুনা "সন্ত" উপাধি প্রদান ও তাই নিয়ে আবার ভারসাম্যহীন উৎসবের স্তর পর্যন্ত গড়ালো বলে তাকে আর একজন ব্যক্তির ঘটনা বলে ভাবা যায়না, বরং একটা সময়ের সমাজের কিছু চরিত্র এর থেকে প্রকট হয় | আর তাই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রয়োজনও তৈরি হয়, কিছু না বললে সময়ের সাক্ষী হিসাবে আমাদের কাজ করা হয় না |

 

মাদার টেরিসা ও তাঁর সংস্থা সারাজীবন বঞ্চিত, অসহায় ও সমাজের দ্বারা প্রবলভাবে অসম্মানিত ও প্রায়-বিতাড়িত মানুষের সেবা করেছেন, এ-কথা প্রথমেই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছি | তারপর এ-কথা বলতে হয় যে এইসব মানুষের এই অবস্থার কারণ তথা সমাজের এই অবস্থার কারণ নিয়ে  তাঁর কোনো সুচিন্তিত মতামত ছিল বলে আমাদের জানা নেই (এই অবস্থা ঈশ্বরের দান এবং তাই দারিদ্র সুন্দর, এই কথা ছাড়া) | অতয়েব মানুষের এই দুর্দশা যাতে না হয় তার কোনো রাস্তা তিনি দেখাননি, তাঁর কথা থেকে মনে হয় দেখতে চানওনি, তিনি দারিদ্রকে-দুর্দশাকে সুন্দর মনে করতেন এবং ঈশ্বরের কাছের জিনিস মনে করতেন | আর এটাকে সমস্যা না মনে করলে তার সমাধানের প্রশ্ন নেই | সুতরাং মাদার টেরিসার কাজ অনেক অসহায় মানুষকে সাহায্য করলেও তাঁর আদর্শগত অবস্থান সংখ্যায় আরো বহু বহুগুন বেশি অসহায় নিপীড়িত মানুষের (যাদের কাছে তাঁর বা অন্য কোনো সংস্থা পৌঁছতে পারছেনা) এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথে অন্তরায়, যেমন অন্তরায় ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এই অবস্থার মধ্যে না পরে সেরকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে | তিনি শুনেছি বলতেন যে কারুর দুঃখদুর্দশার জন্য কেউ দায়ী হলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে,  যেমন ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী ইউনিয়ন কারবাইডকে | কথাটা বাণী হিসাবে ভালো, তবে এরমধ্যে মূল সমস্যা এবং তাঁর সমাধানের মধ্যে না ঢোকার স্পষ্ট প্রবণতা আছে, যা ধর্মের কাজের জন্য ভালো হতে পারে কিন্তু মানুষের উন্নতি ও মুক্তির পথে অন্তরায় | বিশেষ করে যদি কেউ তাঁর সংস্থার জন্য হাইতির ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শাসক ডুভিলিয়ার বা কুখ্যাত মার্কিন ঠগ চার্লস কিটিং-এর কাছ থেকে অনুদান নেন (যেমন মাদার টেরিসা নিয়েছিলেন), তাহলে সেই প্রবণতাকে ক্ষমার চোখে দেখলে অতি-সারল্য এবং যুক্তির চোখে দেখলে ধান্দাবাজি বলে মনে হয় | দেখেশুনে মনে হয় সমাজে ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্যের অবসান ঘটুক এই অবস্থার থেকে মাদার টেরিসার এই অবস্থাই বেশি পছন্দ ছিল যে মানুষ দারিদ্র, অসহায়তার সম্মুখীন হোক আর যুগ যুগ ধরে কোনো নিবেদিতপ্রাণ "সন্ত" তাদের কাউকে কাউকে কোলে তুলে তাদের মৃত্যুকে কিঞ্চিৎ আরামদায়ক করুন ও সেই সূত্রে ঈশ্বরের সাধনা করুন | মাদার টেরিসার খ্যাতি একটা অঞ্চল ও সময়ের মধ্যে সীমিত থাকলে একথা বলার প্রয়োজন হতোনা, কিন্তু আজ এ-কথা আলোচনা করা দরকার, কারণ তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া আর তাই এটা বোঝা দরকার যে তিনি ঠিক কীরকম ব্যবস্থা বা সমাজ চাইতেন?

 

স্বাধারণভাবে তুলনা করার প্রয়োজন ছিলোনা, তাও এক্ষেত্রে করতেই হয় কারণ বর্তমানে মাদার-স্তুতিতে কান পাতা দায় | তাঁর খ্যাতির পরিমানের সঙ্গে মানানসই আরো কয়েকজন মানুষের-জন্য- কাজ-করা লোকের কথা আমাদের মনে পরে | মনে পরে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথা, যিনি মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন ও শান্তির রাস্তার পথিক ছিলেন | কিন্তু যেখানে প্রতিবাদের প্রয়োজন সেখানে তার কোনো শর্টকাট বিকল্প তিনি খোঁজেননি | প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল করেছেন, কালজয়ী বক্তৃতা করেছেন এবং শেষ বিচারে, একদম সরলভাবে ধরলেও, তাঁর আদর্শ এবং কাজের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা মাদারের থেকে বহুগুন বেশি | আমাদের মনে পরে চে গুয়েভারার কথা | তিনি শোষিত নিপীড়িত মানুষের যোদ্ধা ছিলেন, এবং তাদের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন | একবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর, কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়ার পর, তিনি কিউবায় আরামে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন | কিন্তু তিনি তা করেননি, জীবনকে বাজি রেখে আবার ফিরে গেছেন মানুষের জন্য যুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে | সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আজও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একজন প্রতীক হিসাবে চে'র নাম উজ্জ্বল | আমাদের মনে পড়ে মহাত্মা গান্ধী, ভ্লাদিমির লেনিন, নেলসন ম্যান্ডেলা, হো চি মিন, ম্যালকম এক্স, মালালা ইউসুফজাই ইত্যাদি আরো বহু নাম | এঁরা কেউ ধর্মবিশ্বাসী, কেউ অবিশ্বাসী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ ব্যাপটিস্ট, কিন্তু এঁরা কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণগুলির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে দ্বিধা করেননি | আর তাই এঁদের আদর্শ ও কাজের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা মাদার টেরিসার থেকে অনেক অনেক বেশি, মানুষের কল্যাণে তাঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী | নিপাট সমাজসেবার কথা ভাবতে গেলেও, ক্রাই-এর মতো এনজিও সম্ভবত মাদারের সমান বা বেশি এবং আরো সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কাজ করছে, কারণ তারা শিশুদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছে, দারিদ্রের জয়গাথা গাওয়া ও তার বহমানতাকে নিশ্চিত করতে ব্যস্ত নয় |

 

ব্যাক্তিপুজো এদেশের একটা ব্যাধি | তার প্রচুর প্রমাণ প্রতিনিয়ত পাওয়া যায়, যার একটা উদাহরণ "মনীষীদের" নামে বিভিন্ন কিছুর নাম দেওয়া | এই ব্যাধির চরিত্র ও ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, পরে কখনো সময় পেলে হবে, তবে মাদার টেরিসাকে নিয়ে হৈচৈ-টা এই ব্যাধিরই আরেকটি উপসর্গ বলে মনে হয় | এই ঢক্কানিনাদের  মধ্যেও কিছু সাহসী লোক তাঁর কাজের যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং ভক্তির ঠুলি সরিয়ে রেখে তাঁর হোমগুলি ঘুরে দেখে রিপোর্ট করেছেন | সেইসব রিপোর্ট থেকে উঠে আসা চিত্র সবসময় খুব আশাব্যঞ্জক নয়, কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভয়ের, যেমন এই ব্যাপারটা যে তাঁর হোমে একই সিরিঞ্জ ঠান্ডা জলে ধুয়ে বারবার বিভিন্ন লোকের শরীরে ফুঁটিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হতো | সেসবের মধ্যে এখানে ঢুকছিনা, তবে এই লেখকের একবার অবকাশ হয়েছিল আশির দশকে কালীঘাটে তাঁর হোম "নির্মল হৃদয়ে" যাওয়ার | যদিও খুব ছোট ছিলাম, তবু অন্ধকার জেলখানা ধরণের পরিবেশটাকে মোটেও ভালো লাগেনি মনে আছে | একজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়েছিল - তিনি বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন যে তাঁর সংসারে কেউ নেই | আমার অভিভাবক ও সঙ্গী তাঁকে বলেন যে কেন, মাদার আছেন তো | এর উত্তরে তিনি কিছু বলেননি, তবে তাঁর মুখ থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে সেটাকে তিনি বিশেষ কোনো সৌভাগ্য হিসাবে মনে করেননি | এইটুকু অভিজ্ঞতা থেকে কোনো স্বাধারণ মতামতে পৌঁছনো যায়না, তবু সৎভাবে তাঁর কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে এই-সমস্ত রিপোর্ট ও লেখাও পড়ে দেখা দরকার | তবে, আমরা এখানে সেকাজ করছিনা এবং তাঁর ভালো কাজকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিচ্ছি | আমাদের এই লেখার যাবতীয় বক্তব্য সেটুকু মেনে নেওয়ার পরেও |

 

ক্যাথলিক চার্চ খ্রীষ্ঠান ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও তার প্রচারের জন্য "সন্ত" উপাধি দেয় | এর সঙ্গে ভালোমন্দের সম্পর্ক কম, যেমন দেখা যায় অনেক মানবতার শত্রু আগে "সন্ত" উপাধি পেয়েছে | এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, কারণ যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতোই ক্যাথলিক চার্চ যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি-রহিত অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ও বেড়ে ওঠা একটি সংস্থা যা যুগ যুগ ধরে মানুষের বিরুদ্ধে নানাবিধ অত্যাচার করেছে | আমাদের মনে পড়ে যে এই ক্যাথলিক চার্চই গ্যালিলিওর বই বেআইনি ঘোষণা করেছিল ও তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলো কারণ তিনি দূরবীনের সাহায্যে পর্যবেক্ষণের দ্বারা কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে সমৰ্থন করেছিলেন যে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্য গ্রহরা ঘুরছে, সবার মধ্যমণি পৃথিবী নয় যেমন চার্চ বিশ্বাস করতো | চার্চের সঙ্গে জুড়ে আছে আরো বহু অত্যাচারের কাহিনী | সব আখ্যানে যাওয়ার দরকার নেই, তাও উদাহরণ-স্বরূপ আলেক্সান্ড্রিয়ার "সন্ত" সিরিলের কাহিনীটা বেমানান হবেনা |

 

323 খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতি প্রথম টলেমি মিশরের দখল নেন; শুরু হয় টলেমীয় যুগ, যা চলে প্রায় তিনশো বছর | এরমধ্যে অনেকটা সময়ই ছিল সমৃদ্ধির | গড়ে ওঠে, সমৃদ্ধ হয় আলেক্সান্ড্রিয়া ও তার মহান গ্রন্থাগার, যা ছিল প্রাচীনকালের জ্ঞানচর্চার এক শ্রেষ্ঠ পিঠস্থান | ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত আলেক্সান্ড্রিয়ার বন্দর মিশরকে দেয় বাণিজ্যে সমৃদ্ধি | গল্প আছে যে আলেক্সান্ড্রিয়ার বন্দরে নোঙ্গর করা সব জাহাজকে একটা তোলা দিতে হতো | তবে সেটা আজকের অঞ্চলের মস্তান বা রাজনৈতিক নেতাদের নেওয়া তোলার থেকে আলাদা | বন্দরে নোঙ্গর করা সব জাহাজকে জাহাজে থাকা সমস্ত বই আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিকে দিতে হতো কপি করার জন্য | কপি করার পর বই ফেরত পাওয়া যেত, হয় আসলটি নয় প্রতিলিপিটি | এছাড়াও বই জোগাড় করার আর যত রকম আইনি বেআইনি ফিকির হতে পারে, সে সবই ব্যবহার করে এক অত্যাশ্চর্য জ্ঞানমন্দির হয়ে ওঠে এই গ্রন্থাগার | প্রায় সব বইই ছিল প্যাপিরাস | কত বই ছিল সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়না, বিভিন্ন হিসাবে চল্লিশ হাজার থেকে চার লক্ষ বই ছিল আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিতে |

 

কাহিনী অনুযায়ী, এই লাইব্রেরির শেষ অধ্যক্ষা ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রধান গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক, হাইপেশিয়া (355 থেকে 412 খ্রিষ্টাব্দ) | খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের সেই সময়ে যুক্তি ও জ্ঞানচর্চাকে ভালো চোখে দেখা হতো না, যে দুটো জিনিস চলতো আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিতে ও যার সবল ও প্রাণবন্ত নেতৃত্ত্ব দিতেন অধ্যক্ষা হাইপেশিয়া | শেষপর্যন্ত তার দাম তাঁকে দিতে হয় | আলেক্সান্ড্রিয়ার রাস্তায় একদিন যখন তিনি তাঁর রথে চড়ে কাজে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বিশপের লেলিয়ে দেওয়া ধর্মোন্মত্ত জনতা তাঁর রথ থেকে টেনে নামিয়ে আনে এবং জীবন্ত পুড়িয়ে মারে | পুড়িয়ে দেওয়া হয় পৃথিবী-বিখ্যাত গ্রন্থাগারটিকেও | সেই বিশপ সিরিল পরে "সন্ত" উপাধি পান! বলাই বাহুল্য সিরিলের সঙ্গে মাদার টেরিসার তুলনা হয় না, কিন্তু এখানে এইটুকুই শুধু বোঝার যে "সন্ত" উপাধি পাওয়ার সঙ্গে ব্যক্তির মহত্ত্বের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি আনুগত্যের |

 

তবু "সন্ত" উপাধি দেওয়াটা চার্চের ব্যাপার, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার থাকতো না যদি না আমাদের সরকার ও প্রচারমাধ্যম তাই নিয়ে উচ্চগ্রামের আদিখ্যেতা শুরু করতো | করেছে যখন তখন আরো দু-একটা কথা তুলতেই হয় | মাদার টেরিসা তো তাঁর কাজের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি আগেই পেয়েছেন, ভ্যাটিকানের এই "সন্ত" উপাধি-প্রদান আর অতিরিক্ত কীসের স্বীকৃতি? এটা হচ্ছে প্রথমতো এটার স্বীকৃতি যে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ঈশ্বরের অতি কাছের লোক, এবং তার প্রমাণ হিসাবে দেখাতে হয় যে তিনি দুটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন | মাদার টেরিসার ক্ষেত্রে প্রথম অলৌকিক কাণ্ড হচ্ছে যে জনৈক মনিকা বেসরার পেটের টিউমার নাকি মাদারের ছবি থেকে "নির্গত জ্যোতি" আর তাঁর ছবিওলা একটা চাকতি রোগিণীর পেটের ওপর রাখায় সেরে গেছে | এসব শুনলে মনে যে ভাব আর মুখে যে ভাষা আসে সেটা লেখায় প্রকাশ না করাই ভালো, কিন্তু একথা বোঝা দরকার যে যেসব আজগুবি ভূতের গল্প চপ-মুড়ি সহযোগে বর্ষার সন্ধ্যের আড্ডায় ভালো জমে, সেগুলোকেই সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হলো লক্ষ লোকের সামনে, ভ্যাটিকানের চাতালে | যারা দেখে হাততালি দিলো তাদের আর যাই হোক, যুক্তি-বুদ্ধি-মনুষ্যত্বের সমঝদার বলা যায় না | এটুকুই শুধু আশার কথা যে এই বাংলারই বহু লোক এই ছেলে-ভোলানো মিথ্যাটাকে মিথ্যা হিসাবে রায় দিয়েছেন যার মধ্যে আছেন ওই রোগিণীর স্বামী (যদিও পরে তিনি বয়ান পাল্টান), ওনার ডাক্তার এবং বিতর্কে জড়াতে ভয়-না-পেয়ে সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র |



Illustration by Mark Alan Stamaty

 

আমাদের বুঝে নিতে ইচ্ছা করে যে ঠিক কারা বছরের পর বছর ধরে আমাদের এই বেলাগাম মাদার-স্তুতিতে ডোবানোর চেষ্টা করছে | প্রথমত দেখা গেছে দেশ বিদেশের  রাজনৈতিক  নেতা-কর্পোরেট মিডিয়া (উদাহরণ মাদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চরম দক্ষিণপন্থী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান) | মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, যা বহু ক্ষেত্রেই সংগঠিত হয় দুঃখ দুর্দশা বৈষম্য বয়ে আনা নির্মম মুনাফামুখী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, এরা সেই সংগ্রামের বিরোধী | এরা এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় কারণ এরা এর সুবিধাভোগী | এই ব্যবস্থায় মাদার টেরিসার আদর্শ চমৎকারভাবে খাপ খায় - সমস্যার মূলে ঢুকোনা, ক্ষমা করে দাও, অহেতুক ঝুট ঝামেলায় যেওনা | পাশাপাশি আছে সেবা - চ্যারিটি - যা এই অত্যাচারী ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রেখেও কিঞ্চিৎ বিবেকদংশনের উপশম ঘটায় | আদর্শ ব্যবস্থা, সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না, শোষণ অত্যাচারও চললো, বিবেকও খোঁচা খেলনা | এই-জন্যই যা সাধারণ শ্রদ্ধার বিষয় ছিল তা গিয়ে দাঁড়ালো বিশ্বজোড়া খ্যাতি, ভারতরত্ন, নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং "সন্ত" উপাধিতে | এই মাদার-স্তাবকতার নেতাদের অনেকেই ন্যূনতম মজুরির দাবিতে হওয়া শ্রমিক ধর্মঘটের বিরোধিতা করে, এরাই ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষাগুলিকেও বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে, কৃষক আত্মহত্যাকে অশ্লীলভাবে অস্বীকার করে | এই মাদার স্তাবকদের মিছিলে দেখলাম আমাদের বর্তমান রাজ্য সরকারের একটি দলও যোগ দিয়েছে, নেতৃত্ত্বে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী | তা তো দেবেই, যাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীরা হরদম মানুষের বিরুদ্ধে নানাবিধ অত্যাচার করছে, তোলা তুলছে, সম্পূর্ণ হেলদোলহীন হয়ে ঘুষ খাচ্ছে এবং তারপরও একইরকম দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দল তথা সরকারের লোকজন এতো সস্তায় "পুণ্য" করার সুযোগ পেলে যে ছাড়বেনা সেটা সহজেই বোঝা যায়, সঙ্গে আবার রোম বেড়ানোর সুযোগ | অতিভক্তিটা চিরকালই চোরাকারবারিদের লক্ষণ | আর যাঁরা সরল মনে মাদার-স্তুতিতে ব্যস্ত, তাঁরা নেতৃত্ত্ব ও সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘদিনের প্রচার থেকে এটা শিখেছেন যে এই বেশ ভালো চলছে, এই স্থিতাবস্থাকে ঘাঁটিওনা, শুধু মাঝে মাঝে একটু চ্যারিটি করো, যার সাক্ষাৎ প্রতিভূ মাদার টেরিসা, যদিও তিনি সম্ভবত চ্যারিটি করেছিলেন "ঈশ্বরের কাছে" পৌঁছনোর জন্য |

 

মাদার টেরিসাকে এখন থেকে নাকি "সেইন্ট টেরিসা অফ ক্যালকাটা" বলে অভিহিত করা হবে | আগে থেকেই নিরন্তর প্রচারের চাপে বহু সৎ বিদেশী পর্যটকের কাছে (অনেক ভারতীয়র কাছেও) কলকাতার সবচেয়ে বড় ঘটনা মাদার টেরিসা, কলকাতায় এলে আর কিছু না হোক মাদার হাউসটি একবার দেখতে যান, যদিও তাঁরা বেশিরভাগই জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িটির অস্তিত্ত্ব সম্পর্কেই অবহিত নন | বিশ্বজুড়ে লাগামহীন মাদার-স্তুতিকে হাওয়া দিয়ে এই দেশের এবং শহরেরই বহু মানুষ, রাজনৈতিক নেতা ও প্রচারযন্ত্র এই অজ্ঞানতাকে সমৰ্থন ও লালন পালন করেছে, "সন্ত"-উপাধি প্রদান নামক ভাঁড়ামোটি তার সাম্প্রতিকতম সংযোজন | সুতরাং এই ধূলিধূসরিত শহরে জন্মানো, বড় হওয়া যৎসামান্য নাগরিক হিসাবে আমাদের কিছু বলাটা জরুরি | কিছুটা এই শহরে বড় হওয়ার সূত্রেই বিশ্ব-নাগরিকত্ত্বের কিছু বোধ আমাদের আছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ-জাতি-সংস্কৃতিকে আমরা সম্মান করি, নিজেদের ভালো প্রমাণ করার জন্য কাউকে খাটো করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের নেই, নিজেদের হাজারো দোষ-ত্রুটি স্বীকার করতেও কোনো অসুবিধা নেই, আর তাই স্বাধারণভাবে কলকাতা শহর সম্পর্কে আত্মপ্রচার করার প্রশ্ন উঠতো না | কিন্তু যখন শহরের পরিচয়েই একটা ভ্রম থেকে যাচ্ছে, তখন কিছু বলাটা আমাদের বিনীত কর্তব্য |

 

ইউরোপীয় এবং অন্যান্য বহু ভারতীয় শহরের তুলনায় কলকাতা নেহাত নবীন শহর (যদিও এর নগর পরিকল্পনার অভাব দেখে সে-কথা মনে হয়না) | তবু এর তিনশো পঁচিশ বছরের ইতিহাসে ঘটনা নেহাত কম ঘটেনি | সময়ের চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা ও ভাবনাচিন্তার প্রসার ঘটলেও (যার মধ্যে অনেকগুলি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্ভাগ্যজনক), এই শহরের একটা মূল চরিত্র বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের ভূমি হিসাবে - ধর্মীয় সংস্কারের আন্দোলন, মুক্তচিন্তা ও যুক্তির পক্ষের আন্দোলন, প্রতিবাদী রাজনীতির আন্দোলন | পাশাপাশি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও কলকাতার ইতিহাস উজ্জ্বল | এই শহর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটা মূল কেন্দ্র ছিল, কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় মনীষীদের কাছে টেনে নিতে এই শহর পিছপা হয়নি | তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিখাদ মানবতাবাদী অভিপ্রায়ে কাজ করে কলকাতার ইতিহাসে হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল | আমি ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার প্রমুখের কথা বলছি, কলকাতায় যাঁদের অবদানের সঙ্গে মাদার টেরিসার অবদানের কোনো তুলনা হয়না | এঁদের পাশাপাশি কাজ করেছেন এই শহরের ভূমিপুত্ররা | পুরস্কার পাওয়া-না পাওয়া দিয়ে ভালোমন্দের বিচার করাটা নিপাট বোকামো, তবু নিছক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা ধরলেও, বহু প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে এই শহরে জন্মে, বড় হয়ে বা কাজ করে মাদার টেরিসা ছাড়াও চারজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন - রবীন্দ্রনাথ, সি ভি রমন, রোনাল্ড রস এবং অমর্ত্য সেন | নোবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বহু নোবেলজয়ীর থেকে বেশি অবদান রেখে গেছেন এই শহরেরই কেউ কেউ, যাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে মনে পরে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের অতিসুক্ষ রহস্য নিয়ে কাজ করেছিলেন, যাঁর নামেই ব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক কণার নাম - বোসন | শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও কলকাতা বিশ্বের মানচিত্রে নেহাত ফেলনা নয় | শোষণ নিপীড়ণের বিরুদ্ধে, শ্রমের সম্মান ও অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের ব্যাপারেও কলকাতা একটা সামনের সারির নাম, যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মুক্তি দিতে পারে | এঁদের বেশিরভাগেরই প্রতিভা ও মানুষের উন্নতির ক্ষেত্রে অবদানের পাশে মাদার টেরিসা ফিকে হয়ে যান |

 

এসবের জন্য আমাদের "সেইন্ট টেরিসার" প্রয়োজন হয়নি | বস্তুত কলকাতার মাদার টেরিসাকে যতটা প্রয়োজন ছিল, মাদার টেরিসার কলকাতাকে প্রয়োজন ছিল তার থেকে অনেক বেশি | অহেতুক কলকাতার গৌরবগাথা গাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়; ভারতের স্বাধারণ অবস্থার ভাগিদার হিসাবে দারিদ্র, বৈষম্য, নোংরাও এই শহরের নিত্যসঙ্গী | বিশেষ করে বর্তমানে সমাজ ও রাজনীতিতে আমরা একটা তলানিতে আছি মনে হয় | তবে উত্থান পতন যেকোনো শহরের ইতিহাসে আছে এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণও অবশ্যম্ভাবী আর তার জন্য আর কোনো "সেইন্ট টেরিসা"-কে আমাদের প্রয়োজন নেই | তাঁর ভালোটুকু - মুমূর্ষু, সমাজ পরিত্যক্ত, অসহায়তম মানুষের সেবা করা - অতীত ও শ্রদ্ধার, আর আপত্তিজনক অংশটাও - স্বাধারণভাবে মানুষের দুর্দশার মূল কারণ খোঁজা-কে এড়িয়ে যাওয়া, ভালোমন্দের বিচার না করে মানবতাবিরোধীদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া, ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, অলৌকিক ঘটনা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস প্রচার করা  - নেহাত কম নয় | তবু আমরা তাঁর ভালোটুকু নিয়েই থাকতে পারতাম, কিন্তু তাঁকে চূড়ান্ত গৌরবান্বিত করার যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলেছে, তাঁর কাজ ও আদর্শকে একটা প্রশ্নহীন বেমানান উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা চলেছে, তাঁকে কলকাতার প্রায় শ্রেষ্ঠ আইকন হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা চলেছে এবং শেষপর্যন্ত "মিরাকেল"-কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হচ্ছে, তা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর | মানুষ ও কলকাতা শহর এসবের থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পারে, ততই ভালো |

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন